জাতীয়

সীমান্তে মাইন, এরপরও ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ হাজারও রোহিঙ্গা

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত। ২০ গজ দূরেই মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা। পাহাড়ের ঢালু সীমান্তে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সীমানারেখা নির্ধারণ করা। তবে কোনো বেড়া নেই। বরং ঢালু পাহাড় থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য তৈরি করা হয়েছে সিঁড়ি। মাঝে নো ম্যান্স ল্যান্ড। সীমান্তঘেঁষে মিয়ানমারের ওপারের প্রথম গ্রামটির নাম তুমব্রু রাখাইন স্টেট।

Advertisement

গত ৮ সেপ্টেম্বর এই সীমান্তের পাশেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোতা মাইন বিস্ফোরণের নিহত হয়েছিলেন ছয়জন। বিস্ফোরিত এলাকার ২০ গজ দূরেই এখনও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, বাইশফাড়ি, আশারতলি, চাকঢালা, সাপমারাঝিরি, লেমুছড়ি সীমান্তে গিয়ে প্রায় এক হাজারের অধিক রোহিঙ্গাকে কালো সামিয়ানা টাঙিয়ে বসবাস করতে দেখা গেছে।

তুমব্রুর খালটির পাশের নো ম্যান্স ল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন প্রায় ‘স্বাভাবিক’। কেউ ঘরের বাইরে বসে গল্পগুজব করছেন কেউবা খালের পানিতে গোসল করছেন। খালের পানিতে থালাবাসন মাজতেও দেখা যায় অনেক রোহিঙ্গা নারীকে। অনেকে আবার খাল পার হয়ে বাংলাদেশে আসছেন।

Advertisement

সেখানে রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলেও পরিস্থিতি যেন থমথমে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা তাদের চোখে চোখে রাখছেন। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে হালকা কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। মাত্র ২০ গজ দূরেই মিয়ানমার সীমান্ত। সেখানেই চলছে দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন। অথচ রোহিঙ্গাদের কারও চোখে-মুখে ছিল না আতঙ্কের ছাপ। থাকবেই বা কেন! ইতোমধ্যে তারা নরকচিত্র দেখে ফেলেছেন। দেখার তো আর কিছু বাকি নেই তাদের।

নো ম্যান্স ল্যান্ডে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইলে এক বিজিবি সদস্য বলেন, কাছাকাছি যেতে পারেন, কিন্তু কোনোভাবেই সীমান্তের কাছে যাবেন না।

একটু এগিয়ে গিয়ে কথা হয় এক রোহিঙ্গার সঙ্গে। ‘কয়েকদিন আগেও এখানে মাইন বিস্ফোরণ হলো, ভয় লাগে না? কীভাবে এখানে বসবাস করছেন? জবাবে শাহাবুদ্দিন বলেন, আমরা পাঁচ-ছয়দিন ধরে এখানে আছি। বার্মায় (মিয়ানমারে) মারা যাওয়ার চেয়ে, এখানে মরাই ভালো। মাইন বিস্ফোরণ হলে তো একবারেই মরে যাব। কিন্তু তারা (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) তো গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে। আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করছে

‘এখানে আছি, এরপরও তো বেঁচে আছি। এখান থেকে আপনি তুমব্রু স্টেটের কিছু ঘর দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ভেতরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্তঘেঁষা কয়েকটা ঘর রেখে ভেতরের সব পুড়িয়ে দিয়েছে। এখনও কালোধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ভেতরের নরক থেকে এখানে মৃত্যু অনেক ভালো।’

Advertisement

সৈয়দ সবুজ নামের অপর এক যুবক বলেন, প্রথম কয়েকদিন বিকট বোমা আর গোলাগুলির শব্দ ছিল। এখন তা অনেক কমে এসেছে। নিজ গ্রামে জীবনের অনেক ঝুঁকি ছিল, এখানেও আছে তবে স্বস্তিতে আছি। প্রথম কয়েকদিন কিছুই পেটে পড়েনি। এখন পরিমাণে কম হলেও বাংলাদেশিরা আমাদের জন্য ত্রাণ পাঠাচ্ছে। তারা খুবই আন্তরিক, ভাইয়ের মতো সাহায্য করছে। দেখি কতদিন এখানে থাকা যায়।

‘জায়গা পেলে কক্সবাজারের রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের দিকে যাব। আপাতত মিয়ানমারের নরকে যাওয়ার ইচ্ছা নাই’- যোগ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’র নামে রাখাইন রাজ্যে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন দেয়ার মতো ঘটনা ঘটায়।

২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা চার লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের স্রোত এখনই থামবে না। এ সংখ্যা আরও কয়েক লাখ ছাড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন সঙ্কটের মুখোমুখি রোহিঙ্গারা, অন্যদিকে সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও।

গত ২৬ দিনে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার সুরাহা হলেও অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা না করা হলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা।

তবে প্রশাসন বলছে, তারা ধীরে ধীরে পরিস্থিতি গুছিয়ে আনছেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলেও জানান প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এআর/এমএআর/আইআই