জাতীয়

ক্যাম্পে যেভাবে রাত কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গারা

পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’ কবিতাটি হয়তো সবার মনে আছে। কবিতাটির বাস্তব চরিত্র দেখতে হলে এখন যেতে হবে মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে।

Advertisement

‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।’

নবনির্মিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বাস্তাবচিত্র যেন এমনই। কোনোরকম বাঁশ আর কালো প্লাস্টিক পেঁচিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু করা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ছে পানি। নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। ক্যাম্পজুড়ে কর্দমাক্ত ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। আসমানীর মতো এক লাখের অধিক রোহিঙ্গা শিশুর বসবাস এমন পরিবেশে।

এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারে প্রতিদিন সকালে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। চলছে দুপুর পর্যন্ত। স্যাঁতসেঁতে কাদা আর পানি। ক্যাম্প-রাস্তা- সব জায়গায় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের। এর মধ্যে প্রতি বেলায় খাবার সংগ্রহের চেষ্টা, দৌড়ঝাপ; দিনভর চলে এমন দুর্ভোগ।

Advertisement

দিনে তো এ অবস্থা। রাতে কী করে রোহিঙ্গারা? জানতে বুধবার রাতে উখিয়া থেকে টমটমে (ইজিবাইক) রওনা দেয়া। উদ্দেশ্য কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্প।

উখিয়া বাজার থেকে কুতুপালং ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। টেকনাফ যাওয়ার মহাসড়কটিতে নেই কোনো আলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে টমটমের হেডলাইটের আলোই একমাত্র ভরসা।

উখিয়া বাজার থেকে দুই কিলোমিটার পার হতেই রাস্তার ডান পাশে চোখে পড়ল রোহিঙ্গা নারীদের লাইন। অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে চার-পাঁচজন করে একত্রে বসে আছে। পাশেই রাখা আছে কাপড়ের পুটলি। ৩০ সেকেন্ড দূরত্বেই চোখে পড়ল আরও কয়েকজন। ইজিবাইক থামিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করা হলো, ক্যাম্পে না থেকে এখানে কেন? বোরকা পরা একজন উত্তর দিলেন, ‘আমরা ক্যাম্পে জায়গা পাইনি। এখানে আত্মীয়ের বাসায় থাকব। রাস্তায় বসে আছি, যদি কেউ কিছু দেয়।’

এরই মধ্যে একটি ত্রাণবাহী ট্রাক রোহিঙ্গাদের দেখে থামল। ত্রাণভর্তি একটি বস্তা ফেলে চলে গেল। সেটি নিয়ে হুলুস্থুল বেধে গেল। ত্রাণের আশায় রাস্তায় বসে থাকা অনেকে আবার উখিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা বলে জানা গেল। রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের সুযোগে তাদের যদি একটু কপাল খোলে।

Advertisement

ফের ক্যাম্পের উদ্দেশে যাত্রা। আধা ঘণ্টার মধ্যে ক্যাম্পের সামনে পৌঁছে দিল টমটমচালক। ক্যাম্পে প্রবেশ করতেই টর্চলাইট হাতে দু-তিনজন নিরাপত্তাকর্মী এগিয়ে এলেন। পরিচয় পেয়ে ক্যাম্পে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ভয়াবহ এক চিত্র...

ক্যাম্পের ভেতর বাঁশের সঙ্গে কালো প্লাস্টিক পেঁচিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে দুর্ভাগা রোহিঙ্গাদের। অনেকের মাথার ওপর শুধু কালো পলিথিনের আবরণ, চারপাশ ফাঁকা। পরিবারের বয়স্ক পুরুষদের আশ্রয় হয়েছে এসব খোলা ঘরে। তারা সেখানে জড়োসড়ো হয়ে রাত কাটান। বাকি ঘরগুলোতে তরুণী, নারী আর শিশুদের আশ্রয়।

সময় তখন রাত ৮টা। বেসরকারি একটি সাহায্য সংস্থার (এনজিও) তৈরি কমিউনিটি সেন্টারে কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউ জেগে আছেন। কমিউনিটি সেন্টারের হলরুমে শুধুমাত্র নারী আর শিশুদের আশ্রয় হয়েছে। দুই হাজার স্কয়ার ফিটের ওই সেন্টারে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে তিন শতাধিক হতভাগা রোহিঙ্গা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যাও বাড়ে। শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়ে যায় বলে জানান কমিউনিটি সেন্টারের নিরাপত্তারক্ষী।

কোনো কোনো হলরুমে পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও থাকতে দেখা গেছে।

রাতে ক্যাম্পের সামনে ও ভেতরে অসংখ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেল। কেউ সশস্ত্র অবস্থায়, কেউ মোটরসাইকেলে টহল দিচ্ছেন। রাতে হেঁটে হেঁটে রোহিঙ্গাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

প্রতি ২০ গজ দূরত্বে একজন করে নিরাপত্তারক্ষী। তাদের সবাই পুরনো রোহিঙ্গা। ১৯৯১ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় হয়েছে তাদের।

কুতুপালং ক্যাম্পটির একটি অংশ পাহাড়ের মধ্যে। রাতের বৃষ্টিতে ক্যাম্পের চারপাশ কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে গেছে। ক্যাম্পের ওই অংশে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে রোহিঙ্গা নারীরা সামিয়ানা টানাচ্ছেন। যেসব ঘর প্রস্তুত আছে সেগুলোতেও গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন অনেকে। আবার কেউ বসে গল্প করছেন, মিয়ানমারে থাকাবস্থায় দুঃসহ স্মৃতিগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন।

আফসানা বেগম নামে একজন বলেন, আমাদের ফকিরা বাজার গ্রামে চার-পাঁচশ’র মতো মানুষ ছিল। মাত্র ২০-২৫ জন পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পেরেছি। বাকিদের কাউকে গুলি করে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ক্যাম্পজুড়ে নীরব-নিস্তব্ধতা। যেন ভীতিকর একটি পরিবেশ। নারী ও শিশুদের থাকা হলরুমে আলোর ব্যবস্থা থাকলেও বাঁশ, ত্রিপল ও প্লাস্টিক শিট দিয়ে তৈরি ঘরগুলোতে কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। নারী ও শিশুদের থাকা হলরুমগুলো দিনের বেলা কমিউনিটি ক্লিনিক হিসেবে ব্যবহার হয়। এ কারণে সেখানে আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সেখানে মোট সাতটি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে। সবগুলোর চিত্র প্রায় একই।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’র নামে রাখাইন রাজ্যে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন দেয়ার মতো ঘটনা ঘটায়।

২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা চার লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের স্রোত এখনই থামবে না। এ সংখ্যা আরও কয়েক লাখ ছাড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন সঙ্কটের মুখোমুখি রোহিঙ্গারা, অন্যদিকে সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও।

গত ২৬ দিনে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার সুরাহা হলেও অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা না করা হলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা।

তবে প্রশাসন বলছে, তারা ধীরে ধীরে পরিস্থিতি গুছিয়ে আনছেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলেও জানান প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এআর/এমএআর/আইআই