মা খরমিনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের। মিয়ানমারে স্বামীকে রেখে কীভাবে পালিয়ে এসেছেন, সে গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি। পাশে থাকা ছোট্ট ইয়াসির কান্না করেই যাচ্ছে। কোনোভাবেই তাকে থামানো যাচ্ছে না। মা তাকে কোলে নিয়ে বারবার আদর দিচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
Advertisement
খরমিনা বেগম জানান, ইয়াসিরের বাবা নদীতে মাছ ধরতো। সেই মাছ বিক্রি করে ভালোই চলতো তাদের। বাড়িতে দু’বেলা ভাত-মাছ খেতো ইয়াসির। বাংলাদেশের আসার পর গত দু’দিন মায়ের বুকের দুধ ছাড়া ইয়াসির কিছুই মুখে তোলেনি।
মঙ্গলবার সকালে কুতুপালং সড়কের ধারে খোলা আকাশের নিচে ১৪ মাস বয়সী ইয়াসিরকে নিয়ে বসে ছিলেন খরমিনা। ত্রাণবাহী গাড়ির পর গাড়ি যাচ্ছে। অনেকে গাড়ি থামিয়ে ত্রাণ দিচ্ছেন। আর সে ত্রাণ নিতে হুড়োহুড়ি করতে দেখা যায় অনেককে। কিন্তু কোলের শিশুকে নিয়ে ত্রাণের গাড়ির কাছে পৌঁছাতে পারছেন না খরমিনা। কান্নাও থামাতে পারছেন না ইয়াসিরের। আসছে দিনগুলোতে ইয়াসিরসহ পাঁচ সন্তানের কান্না কীভাবে থামাবেন তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন মা খরমিনা।
খরমিনা জাগো নিউজকে জানান, স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মিয়ানমারের আচারবিল এলাকায় থাকতেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর সেদেশের সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলি আর নির্যাতনের মুখে স্বামীকে ফেলেই পায়ে হেঁটে চলে আসেন কক্সবাজারে।
Advertisement
‘গণ্ডগোলের সময় একদিন দেখলাম মানুষকে গরুর মতো জবাই করা হচ্ছে। তখন পাঁচ সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। স্বামী কোথায় আছে জানি না, বেঁচে আছে কি না তাও বলতে পারব না!’
খরমিনার মতো প্রতিদিন হাজার হাজার মা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছেন। কারও কারও সঙ্গে দুটি-তিনটি কিংবা এরও অধিক সন্তান। অনেকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে কোনোরকম শিশুসন্তানদের প্রাণ বাঁচিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
খরমিনা বলেন, ‘সন্তানদের মুখে তেমন কোনো খাবার তুলে দিতে পারিনি। মহিলা হয়ে আমি তো অন্যদের (পুরুষ) সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে পারব না। দেখছেন না, বাচ্চাটাও আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না।’
সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, জানি না কী করব? এভাবে রাস্তার ধারে ধুকে ধুকে মরতে হবে। দয়া করে কেউ যদি কিছু দেয়... অঝোরে কাঁদতে থাকেন মা খরমিনা।
Advertisement
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে মোট চার লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন৷ তাদের মধ্যে শিশু দুই লাখ ৪০ হাজার, এক বছরের কম বয়সী শিশু ৩৬ হাজার, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি নারী ৫২ হাজার৷
শিশুবিষয়ক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন’র আশঙ্কা, চলমান সহিংসতায় বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ছয় লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। দু’দেশের সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। সেখানে গত ১৫ দিনে অন্তত ৪০০ শিশু জন্ম নিয়েছে।
ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি। শিশুদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুর হার ২৩ শতাংশ, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ২১ শতাংশ এবং এক বছরের কম বয়সের শিশুর হার ৭ শতাংশ।
কক্সকাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় তিন লাখের জরুরি ভিত্তিতে পুষ্টি সহায়তা প্রয়োজন৷ বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জরুরি ভিত্তিতে পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন।
তিনি জানান, ১২টি স্পটে সবার জন্য একই ধরনের খাবার দেয়া হচ্ছে৷ মা ও শিশুদের জন্য আলাদা করে পুষ্টিকর খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়নি৷ বিষয়টি আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানিয়েছে। বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোকেও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এআর/এমএআর/আইআই