রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অবশেষে প্রকাশ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সুচি। স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৪ মিনিটে টেলিভিশনে ভাষণ দেন তিনি।
Advertisement
গত মাসে সহিংসতা শুরুর পর থেকে প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিশ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সু চি বলেছেন, যারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে যারা পুনর্বাসনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন যে কোনো সময় তাদের সঠিক অবস্থান যাচাই করবে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর এই প্রথম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন সু চি। ভাষণে সু চি বলেন, আন্তর্জাতিক চাপে ভীত নয় মিয়ানমার। তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। শান্তি না আসা পর্যন্ত সেনা অভিযান চলবে। আমরা শান্তি এবং ঐক্য চাই। যুদ্ধ চাই না।
সু চি আরো বলেন, এই সংকট তৈরি হওয়ার শুরু হওয়ার আগেই আমরা নিশ্চিত করেছিলাম যে, সবার জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাখাইনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। আমরা শান্তি এবং উন্নতি চাই। আমরা শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং দেশে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি।
Advertisement
রাখাইনসহ মিয়ানমারের সর্বত্র শান্তি নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন সু চি। তিনি বলেন, এতো মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে কেন যাচ্ছে সেটা তদন্ত করব আমরা। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করব যে তারা কেন এটা করছে।
সু চি বলেন, রাখাইনে অবস্থিত সব সম্প্রদায়ের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে অনুভব করে মিয়ানমার। তিনি বলেন, আমরা শান্তি, স্থায়িত্ব এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরো বলেন, মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কাছে সমস্যার সমাধান চাচ্ছে। এই সংকট সমাধানে ১৮ মাস খুবই অল্প সময়।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। প্রতিদিনই নতুন করে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
Advertisement
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছে, সেনাবাহিনী রাখাইনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, লোকজনকে হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার।
সু চি বলেন, অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইন থেকে পালাননি এবং সেখানে সহিংসতাও শেষ হয়ে গেছে। অথচ গত বুধবার মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জাও হাতে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোর মধ্যে একশ ৭৬ টিতেই কোনো জনমানব নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান তিনি।
জাও হাতে জানিয়েছেন, তিনটি পৌরসভায় মোট চারশ ৭১ টি রোহিঙ্গা গ্রাম রয়েছে। তার মধ্যে একশ ৭৬ টি গ্রাম জনশূন্য হয়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী ৩৪ টি গ্রামে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
রোহিঙ্গা সংকটে নিজের অবস্থানের কারণে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন সু চি। তবে এসব সমালোচনা সু চির মন গলাতে পারেনি।
টেলিভিশনে ভাষণ দেয়া প্রসঙ্গে সু চি বলেন, তার পক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেই তিনি এই ভাষণ দিলেন।
তিনি বলেন, তার সরকার এই পরিস্তিতিতে কি করছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে চান তিনি। সব ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সু চি বলেন, রাখাইনে যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
গত আগস্টে বেশ কয়েকটি পুলিশ চেক পোস্টে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাখাইনে সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় সেনাবাহিনী। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতেই দেশ থেকে পালিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনের শামিল বলে উল্লেখ করেছে।
বেসামরিকদের ওপর কোনো ধরনের অত্যাচার চালানো হয়নি বলে উল্লেখ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলছে, তারা ওই অঞ্চল থেকে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতেই অভিযান চালিয়েছে।
রাজধানী নাইপিতাও থেকে টেলিভিশনের ভাষণে সু চি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই। আমরা আমাদের দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন পুণরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে তেমন কিছুই বলেননি শুধু বলেছেন, সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ থেকে কোনো ধরনের সশস্ত্র সংঘর্ষ বা জাতিগত নিধনের মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
তিনি বলেন, অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মানে এটাই নির্দেশ করে যে পরিস্থিতি এতটাই তীব্র নয়।
ভাষণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন সু চি। টেলিভিশনে দেয়া ওই ভাষণে বারবার রাখাইনের মুসলিম শব্দটি উল্লেখ করলেও রোহিঙ্গা মুসলিম উল্লেখ করেননি শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নেত্রী।
সূত্র: বিবিসি, এএফপি
টিটিএন/জেআইএম