আশির দশকে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে শুরু হয়েছিল গ্রোথ প্রোমোটার বা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পশুপণ্য অর্থাৎ মাংস, দুধ ও ডিম ভক্ষণের ফলে মানুষের মাঝে পরবর্তীতে (রেসিডিউয়াল) ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। দেখা দেয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
Advertisement
এর ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক উপায় খুঁজতে থাকেন কিভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াই গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। ঔষধিগুণ সম্পন্ন প্লানটেইন (Plantago lnceolata L.) নামক বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের উপর গবেষণা করে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন। পেয়েছেন জাপানের সেরা তরুণ গবেষক, ডীন ও প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড।
প্লানটেইন একটি নতুন আবিষ্কৃত বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ যা বিরূপ প্রভাব ছাড়াই পশুর শরীর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার কিংবা তার চেয়ে বেশি হারে বর্ধিত করবে। জাপান এবং চীন ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণায় অনেকদূর এগিয়েছে। সাধারণ ঘাসের তুলনায় এর মধ্যে অধিক পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ এবং ‘ই’ আছে, যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
আরও পড়ুন: গবাদি পশুর জন্য নেপিয়ার ঘাস
Advertisement
এছাড়া এর মাঝে এমন কিছু বায়োঅ্যাকটিভ উপাদান আছে যা সাধারণ ঘাসে নেই। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবেও রয়েছে এর চমৎকার কার্যক্ষমতা। যা ফ্রি র্যাডিকেলের কার্যকারিতা বন্ধ করে প্রাণীদেহের কোষ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্লানটেইন জাতীয় ঘাস খাইয়ে উৎপাদিত মাংস কম চর্বিযুক্ত হয়, যা জাতির সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। তাই মেধাবী ও সুস্থ জাতির জন্য পশুখাদ্যে ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
২০০৪ সালে জাপানের ইউয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন। তখন ওই দেশে এই ঘাসের উপর গবেষণা করে সফলতা পান তিনি। গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন বলেন, বাংলাদেশে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে, স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। আশির দশকে শুরু হয়েছিল গ্রোথ প্রোমোটার বা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
এটি এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্নভাবে পশুর মেটাবলিজমের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু এসব সিনথেটিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার প্রাণিদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করে। এসব ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত পশুপণ্য অর্থাৎ মাংস, দুধ ও ডিম ভক্ষণের ফলে মানুষের মাঝেও ব্যবহার পরবর্তী (রেসিডিউয়াল) ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
Advertisement
৯০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে পশুখাদ্যে এসব ব্যবহার নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্বে প্রায় তিন দশক ধরে গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের পর এর ক্ষতির দিক অনুধাবন করে ২০০৬ এর ১ জানুয়ারি থেকে পশুখাদ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করে।
আরও পড়ুন: যেভাবে চাষ করবেন জার্মান ঘাস
গবেষণায় দেখা যায়, মেডিসিনাল উদ্ভিদ বা প্রাকৃতিক হার্বস হতে পারে বিকল্প পশুখাদ্য। যদিও ঔষধিগুণসম্পন্ন উদ্ভিদের ব্যবহার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে খুব পুরনো। ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ এরই মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রিন গ্রোথ প্রোমোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন ঔষধিগুণসম্পন্ন উদ্ভিদ রয়েছে। যেমন সজিনা, পেঁয়াজ, গার্লিক ইত্যাদি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ।
কিন্তু উদ্ভিদটি শীতপ্রধান অঞ্চলের হওয়ায় ড. মামুন আশা করেন এটিকে কিভাবে দেশের প্রাণীজ মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজে লাগানো যায়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে পিএইচডি ও পোস্টডক্টরেট শেষে বাংলাদেশে ফিরে উদ্ভিদটি নিয়ে দেশীয় আবহাওয়ায় জন্মানোর চেষ্টা করেন এবং সফলতা পান। শীতপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় তিনি শীতকালকে বেছে নেন তার গবেষণার উপযুক্ত সময় হিসেবে।
এটি ৬০-২৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। তবে ২০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ঔষধি গুণাগুণ থাকে। উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় দেশের কৃষকরা এটি ব্যবহার করলে খুব কম খরচেই অধিক লাভবান হবেন বলে জানান তিনি।
চাষাবাদ সম্পর্কে ড. আল-মামুন বলেন, নভেম্বরের শুরুতে বীজ ছিটিয়ে দিলে তেমন কোনো যত্ন নেয়া ছাড়াই এটি যেকোনো ধরনের মাটিতে জন্মায়। বীজ বপনের ৪৫-৫৫ দিন পর প্রথম কাটিং দেওয়া যায়। এর এক মাস পর দ্বিতীয় কাটিং এবং দ্বিতীয় কাটিং এর এক মাস পর তৃতীয় কাটিং দেওয়া যায়।
তিনি এর উপকারিতা সম্পর্কে বলেন, রোমন্থক প্রাণী যেমন গরু, ভেড়া ইত্যাদিকে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে খুব সামান্য পরিমাণে (পোল্ট্রিতে ১%, ভেড়ায় ৪%, গরুতে ৫-১০%) ফ্রেশ প্লান্টেইন এবং এর পাউডার মিশিয়ে খাওয়ালে প্রাণীর হিট স্ট্রেস কমিয়ে প্রোটিনের সিনথেসিস বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় মাংসের উৎপাদন, স্বাদ ও রং বৃদ্ধি পায় এবং পচন রোধ করে।
এটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দুগ্ধবতী ও গর্ভবতী প্রাণীর দুধের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা জন্ম দেয়। একইসঙ্গে ফ্যাটি এসিডের (ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩) অনুপাত কমাতে সহায়তা করে। এতে করে মানুষের হার্ট ভালো থাকে। বয়স ধরে রাখতে সহায়তা করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল বাড়ায়। রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। ক্যান্সার ও অটিজম প্রতিরোধ করে।
তাই অ্যানিমাল অ্যাক্ট যথাযথ প্রয়োগ ও সুনিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। গ্রোথ প্রোমোটারের বিকল্প কিছু আবিষ্কার ও ব্যবহারে গবেষকদের সার্বিক সহযোগীতা করার দাবি জানান সরকারের কাছে।
উল্লেখ্য তার এ গবেষণাটি অ্যানিমাল জার্নালসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
শাহীন সরদার/এফএ/এমএস