আন্তর্জাতিক

‘রাখাইনের রাস্তায় বইছে রক্ত বন্যা’

সকাল ৮টার পর পরই রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে হানা দেয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। একেবারেই যুদ্ধংদেহী অবস্থায় তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকাশের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়; এরপরে পলায়নরত রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে চলে তাদের গুলি। গুলিতে আহত অনেকেই রাস্তায় কিংবা ধানখেতে লুটিয়ে পড়েন; প্রাণ নিয়ে বাঁচার নিষ্ফল চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠে না।

Advertisement

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশের তল্লাশি চৌকি আক্রান্ত হওয়ার পর দিন থেকে প্রত্যেকদিন এভাবেই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে চলে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। সেনা তাণ্ডব থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গারা মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, রাখাইনের রাস্তায় বইছে রক্তের ধারা।

রাখাইনের কৃষক মোহাম্মদ রশিদ। বন্দুকের গুলি শব্দ শোনার পর স্ত্রী সন্তানসহ পালিয়ে যান। কিন্তু তার ৮০ বয়সী বাবা তাদের ক্ষিপ্রগতির হেঁটে চলার সঙ্গে লাঠিতে ভর করে হাঁটতে পারছিলেন না।

রশিদ বলেন, তিনি দেখতে পান এক সেনাসদস্য তার বাবা ইউসুফ আলীকে জাপটে ধরে। ছরি চালিয়ে তার গলা কেটে ফেলেন ওই সেনাসদস্য। ওই সেনাসদস্য এতটাই হিংস্র রূপ ধারণ করেন যে, বৃদ্ধ ইউসুফ আলী মাথা প্রায় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

Advertisement

৫০ বছর বয়সী রশিদ বলেন, ‘আমি ফিরে গিয়ে তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক আত্মীয়-স্বজন আমাকে থামিয়ে দেয়। কারণে সেখানে প্রচুর সেনাসদস্য ছিল।’

‘এটা অামার জীবনের সবচেয়ে দুঃজনক ঘটনা যে, আমার বাবার জন্য কোনো কিছুই করতে পারি নাই।’

বার্মার মং নু হ্যামলেট ও এর আশপাশের কয়েক ডজন গ্রামে দেশটির সেনাবাহিনী জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ পরিচালনা করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত এই অভিযানে রোহিঙ্গা স্রোত এখন বাংলাদেশমুখী।

জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযান জাতিগত নিধনের শামিল। তিন সপ্তাহ ধরে চলমান সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়েছে ৪ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা। আগামী কয়েকদিনে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী এই স্রোত আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

Advertisement

নতুন পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গা কক্সবাজারের অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে, রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে, কাঁদা মাটিতে কোনো রকমে দিন পার করছেন। শরণার্থী শিবিরের আশ-পাশে ত্রাণবাহী ট্রাক দেখলেই ছুটছে সেদিকে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণের কাপড় বিতরণের সময় শুক্রবার দুই শিশুসহ এক রোহিঙ্গা নারী পদদলিত হয়ে মারা গেছেন।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রাখাইনের ধ্বংসযজ্ঞের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে রোহিঙ্গাদের কয়েক মাস এমনকি বছরের পর বছর লাগতে পারে। স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবিতে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও, বেসামরিক মানুষকে সেনাবাহিনীর হত্যার চিত্র উঠে এসেছে।

মিয়ানমার সরকার বলছে, রাখাইনের ১৭৬ গ্রাম জনমানব শূন্য। সেনাবাহিনী রাখাইনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় সেখানে প্রাণহানির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না।

মং নু হ্যামলেটের এক ডজন গ্রামবাসী একেবারে শেষ মুহূর্তে সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের কুতুপালং সীমান্তে দুই কথা হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকের। গত সপ্তাহে তারা এই সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইসট বলছে, মং নু এবং এর আশ-পাশের তিনটি গ্রামের অন্তত ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।

সোয়ে উইন নামে একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা আমি হিসাব করতে পারি নাই। সেনাবাহিনী যা করছিল আমরা শুধু সেসব দেখছিলাম। তারা একের পর একজনকে জবাই করছে। রাস্তায় রক্তের ধারা বইছে।’

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশের ৩০টি তল্লাশি চৌকি ও একটি সেনাক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১২ পুলিশ নিহত হয়। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনী ও রাখাইনের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে এই অভিযান শুরু করে। মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতেই সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগ অভিযান চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।

গত বছরের অক্টোবরে এবং গত আগস্টে পুলিশের পোস্টে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) বিদ্রোহীদের হামলার পর এই সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় বৌদ্ধরা আরো প্রতিকূলতায় রয়েছেন। কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের সংঘাত চলে আসছে। রোহিঙ্গাদেরকে বাঙালি হিসেবে দাবি করে বৌদ্ধরা।

রাখাইনের অনেক বৌদ্ধর বিশ্বাস, তারা শেষ পর্যন্ত সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। এমনকি তাদের পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে তাদের। রাখাইন জাতীয়তাবাদী পার্টি এএনপি স্থানীয় বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। বৌদ্ধদের জন্য পুলিশেরও শক্তিশালী সহানুভূতি রয়েছে। পুলিশের প্রায় অর্ধৈক কর্মকর্তাই রাখাইনের বৌদ্ধ।

তবে বাংলাদেশ সীমান্তের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যের আসল ক্ষমতায় সেনাবাহিনী। এই রাজ্যে প্রবেশ অত্যন্ত সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত। দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং পরিষ্কার করে বলেছেন যে, রোহিঙ্গাদের জন্য তার কোনো ধরনের সহানুভূতি নেই।

সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, রয়টার্স।

এসআইএস/জেআইএম