নিখোঁজ হওয়া ১১ যুবকের মধ্যে তিনজন ঘরে ফিরেছেন। ফেরেননি সাতজন। তাদের খোঁজ এখনো মেলেনি। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে তারা নিখোঁজ হন।
Advertisement
এই ১১ জনের মধ্যে শুধু ইমাম হোসেন নামে এক যুবককে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করে র্যাব। তবে নিখোঁজদের মধ্যে তিন যুবকের ব্যাপারে র্যাবের বক্তব্য- ‘তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।’
সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ হন কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহম্মেদ। তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন নাকি অপহৃত হয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে একযোগে সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসেন খান পাভেল, সুজন ঘরামি ও মেহেদী হাওলাদার নামে চার যুবক নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। মেহেদী হাওলাদার, সুজন ঘরামি এবং পাভেল ঘরে ফিরলেও শুধু ফেরেননি সাফায়েত।
Advertisement
ওই বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানার মাটিকাটা এলাকা থেকে কেয়ার মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী ইমরান ফরহাদ ও ৫ ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকে সাঈদ আনোয়ার খান নিখোঁজ হন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তাদের উদ্ধার করতে পারেনি।
সাফায়াতের বাবা মো. আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, গত বছরের ২ ডিসেম্বর বনানী থানায় জিডি করেছি (জিডি নং ১১৯)। সাফায়েত জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে বলে বিশ্বাস করেন না তিনি।
তিনি বলেন, চারজনের মধ্যে শুধু আমার সন্তানই ফেরেনি। আশায় বুক বেঁধে আছি আমার সন্তান ফিরবে অথবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেবে।
অন্যদিকে চলতি বছরের জুনে রাজধানীর বনানী থেকে একই দিনে ইমাম হোসেন (২৭), তাওহীদুর রহমান (২৬), কামাল হোসেন (২৪) ও হাসান মাহমুদ (২৬) নামে চার যুবক নিখোঁজ হন। নিখোঁজদের মধ্যে ইমাম হোসেন ও হাসান মাহমুদ বনানীর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে অনার্স করেন।
Advertisement
কামাল হোসেন নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেন। তিনি বনানীর সি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৬৭/এ, মোস্তফা ম্যানশনের পঞ্চম তলায় ইন্টারকম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও টেলেক্স লিমিটেড নামে একই মালিকের দুটি প্রতিষ্ঠানে বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। নিখোঁজ হাসান মাহমুদ ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। আর ইমাম হোসেন ওই প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। নিখোঁজ চারজনের মধ্যে তাওহীদুর রহমান বাদে বাকি তিনজন চট্টগ্রামে একই পরিবারে বিয়ে করেছেন।
নিখোঁজের ঘটনায় ৩ জুন রাতে কামাল হোসেনের মামা রশিদ আলম বনানী থানায় একটি জিডি করেন। পরদিন ইমাম হোসেনের বাবা বিল্লাল হোসেন বনানী থানায় আরও একটি জিডি করেন।
এই দুই জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা বনানী থানার এসআই বজলুর রহমান জানান, নিখোঁজদের মধ্যে ইমাম হোসেনকে র্যাব গ্রেফতার করেছে বলে জেনেছি। বাকিদের খোঁজ আমরা এখনো পাইনি।
চলতি বছরের জুনে বনানীতে চার যুবকের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গুরুত্ব সহকারে তদন্ত শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি সংস্থা। জঙ্গিবাদের অর্থের জোগান দেয়ার অভিযোগে র্যাব ইমরান আহমেদ নামে এক গার্মেন্টস মালিককে গ্রেফতার করে।
র্যাবের ভাষ্য, ইমরান আহমেদ জবানবন্দিতে জানান, ইমাম হোসেন ও তাওহীদুর রহমান আত্মঘাতী সেলে যোগ দিয়েছেন। এই দুজনের মধ্যে ইতোমধ্যে ইমাম হোসেনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১। গ্রেফতারের পর র্যাব জানায়, ইমাম হোসেন নব্য জেএমবির গুলশান শাখার আমির। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, ইমাম হোসেন গ্রেফতারের পর কারাগারে রয়েছে। বাকি তিনজন এখন পর্যন্ত নিখোঁজ।
আর তাওহীদুর রহমান গুলশানের একটি মসজিদের এক মোয়াজ্জিনের ছেলে। র্যাব বলেছে, তাওহীদুর আগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট বলছে, চলতি বছরের জুনে নিখোঁজ হওয়া চার তরুণের মধ্যে তাওহীদুর ২০০৩ সাল থেকে হুজির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ওই সময় থেকে তিনি হুজির বড় বড় নেতার সঙ্গে কারাগারে দেখা করতেন। তবে হুজি দুর্বল হয়ে পড়লে সাজিদের মাধ্যমে তিনি নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। সাজিদের আরেক নাম আইয়ুব বাচ্চু।
সিটিটিসির ধারণা, এই আইয়ুব বাচ্চু বর্তমানে নব্য জেএমবির প্রধান। তবে র্যাব দাবি, নব্য জেএমবির বর্তমান প্রধান আবু মুহারিব।
অপরদিকে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইশরাক আহম্মেদ (২০) ছুটি কাটাতে চলতি বছরের জুনে ঢাকায় আসেন। এরপর ধানমন্ডি এলাকা থেকে গত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় নিখোঁজ হন। এ বিষয়ে সন্তানের সন্ধান চেয়ে ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বাবা জামাল উদ্দীন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ঢাকার ম্যাপল লিফ স্কুল থেকে এ লেভেল পাস করে গত বছর কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীনের বড় ছেলে ইশরাক। চলতি বছরের জুন মাসে ছুটিতে বাড়ি আসেন তিনি। ঈদের পরের দিন ৩ সেপ্টেম্বর তার কানাডায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।
থানায় নথিভুক্ত জিডিতে উল্লেখ করা তথ্য সূত্রে জানা যায়, ইশরাক বন্ধুদের নিয়ে স্টার কাবাব এলাকায় খেতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। রাত প্রায় সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তারা ধানমন্ডির ইডেন মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের পাশের গলিতে আড্ডা দেন। খাওয়াদাওয়া করেন। ওই এলাকার একটি ভবনের সিসি ক্যামেরায় তাদের আড্ডা দিতেও দেখা যায়। পরে সকলেই যে যার মতো চলে যান। ইশরাককে সর্বশেষ স্টার কাবাবের দিকে চলে যেতে দেখা যায়। এরপর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহিল কাফী জাগো নিউজকে বলেন, নিখোঁজ ইশরাকের খবর জানতে তার বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সন্ধান করতে পারিনি। তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
জেইউ/জেডএ/জেআইএম