মতামত

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট কেন

অর্থমন্ত্রী, কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর কর্মকর্তাদের ধারণা সম্ভবত এই যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার ছড়াছড়ি, সব ধনিক শ্রেণির ছেলে মেয়েরা এখানে পড়ে। কিংবা এমন ধারণাও হয়তো আছে, এরা টাকা না দিয়ে যাবে কোথায়? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক টাকা বেতন বাড়ালে গাড়ি ভাংচুর থেকে শুরু করে হেন নৈরাজ্য নেই যা করা হয় না। কারণ এদের ছাত্র সংগঠন আছে, ক্যাডার বাহিনী আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েতো আর এসব নেই। সুতরাং যা পারো চাপিয়ে দাও। এবং তারই নমুনা দেখা গেল বাজেটে। অর্থমন্ত্রী তার ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ আরেক ধাপ বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ঘোষণা দিয়েছেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর উপর ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হবে। এই বাড়তি ভ্যাটের বোঝা শিক্ষার্থীদেরই বহন করতে হবে। এই ভ্যাট আরোপ করে প্রকারান্তরে সরকারই এই দর্শন আরোপ করছেন যে, শিক্ষা পণ্য বিক্রির মতোই একটি বাণিজ্য। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত যাই বলি না কেন, সব পরিবারের সন্তান বা অভিভাবকের প্রথম পছন্দ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ হলো, খরচ। সকলেই কম খরচে পড়তে চায়। একান্ত উপায়হীন না হলে কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। এবং এরা সবাই ধনকুবেরের সন্তান, এটা ভাবার বাস্তবিক কোনো কারণ নেই। আমি নিজে দু’একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত থেকে দেখেছি, সব শিক্ষার্থী উচ্চবিত্ত পরিবারের নয়। অতি সাধারণ পরিবারের অনেক ছেলেমেয়ে এখানে অনেক কষ্ট করে পড়ার খরচ যোগায়। এমন শিক্ষার্থীও আমি দেখেছি যারা টিউশনি করে, এবং এই উচ্চ খরচের পড়ালেখা চালিয়ে যায়। এই বাড়তি খরচ যে তাদের কষ্ট আরো বাড়াবে সে বিষয়টি  সরকারের নীতি নির্ধারকরা হয়তো কোনোদিনই ভাববেন না। সরকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি দেয়। সেই ভর্তুকির পরিমাণও অনেক। এই ভর্তুকি শতগুণ বাড়ে, কারণ এগুলো প্রায় সবগুলোই সেশন জটে আক্রান্ত। পাঁচ বছরের কোর্স শেষ হতে আট বছরও লাগে কোনো কোনোটিতে। সামান্য ফি বাড়ালে এখানকার শিক্ষার্থীরা যে নৈরাজ্য করে, তার ভয়ে সরকার আর সেদিকে হাত বাড়ায় না।      সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি থাকুক, আরো বেশি করে তাদের সংখ্যা বাড়ুক। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ বা বৈষম্য নিশ্চয় উৎসাহিত করা যায় না। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, উচ্চ শিক্ষার প্রসারের জন্যই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং সরকারই আইন করে এগুলো স্থাপনে ভূমিকা রাখে। আজক বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় পড়তো, যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না থাকতো? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়, টেনেটুনে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে জায়গা দিতে পারে। বাকি ৬০ ভাগ ছেলেমেয়ে পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। দেশে বর্তমানে ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। স্বীকার করতে হবে, অনেক গলদ আছে, অনেক গুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন আছে, অনেকেই নিয়ম বহির্ভূত কাজ করছে। একথা কি সত্য নয় যে, নিয়মের বরখেলাপ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও হচ্ছে, সেখানকার মান নিয়েও আজ প্রশ্ন উঠছে, সেখানকার শিক্ষক আর ছাত্র রাজনীতি নিয়ে জাতির উদ্বেগ আছে। এবং উভয় ক্ষেত্রেই অভিভাবকের ভূমিকায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যার কাজ হলো সব কিছু নজরদারির মধ্যে রাখা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হতে পারতো এগুলোর জন্য অনুসরণীয় যদি ঠিকভাবে পড়াশুনা, গবেষণা হতো। ছাত্ররাজনীতির কারণে মারামারি খুনাখুনি, আর শিক্ষক রাজনীতির কারণে সে অবস্থায়ও নেই  এসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধারণা বদলাতে হবে সরকারকেই যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখার দর্শন থেকে সরকারকেই আগে সরতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে। আমি যেখানে থাকি, সেখানে দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও একটি বাংলা মাধ্যমের স্কুল চোখে পড়েনা। বাধ্য হয়ে কত সাধারণ পরিবারের মানুষ সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ান, তাকি সরকার বাহাদুর জানবে কোনোদিন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খরচ বেশি হওয়ায় ড্রপ-আউট রেট বা ঝরে পড়ার হার এমনিতেই অনেক। এখন এই বাড়তি খরচের চাপ অনেককেই সরিয়ে নেবে এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সমাজে যেমন ধারণাই থাকুক, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ আছে কী? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বেশি খরচ হলে তা শিক্ষার্থীদের উপরই চাপ তৈরি করে। শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের উপর থেকে যেকোনো ধরনের চাপ কমানোই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর সেজন্য ইউজিসি’র ভূমিকা আরো বড় হতে পারে। তারাই ঠিক করতে পারে টিউশন ফি কতোটা হবে, যেন ইচ্ছামতো টিউশন ফি আদায় করতে না পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকার তা করছেইনা, উল্টো খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করছে। আসলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে রাজস্ব আদায়ের খুব সরল পথে হাঁটছে সরকার। তার একটি হলো মোবাইলে কথা বলার উপর শুল্ক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর ভ্যাট।   বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো বিবেচনা করার সরকারের মানসিকতা না বদলালে এগুলোতে বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড আরো বাড়বে আগামী দিনগুলোতে। দেশের শিক্ষাকে বিশ্বমানে নিতে চাইলে শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করার চিন্তা ছাড়তে হবে।  এইচআর/এমএস

Advertisement