নওগাঁ জেলার মান্দা থানার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রাম পিঁড়াকৈর। প্রত্যন্ত হলেও তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের দু'টি মাদ্রাসার একটির অবস্থান এই গ্রামে। রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গ্রাম্য বাজারও।
Advertisement
পিঁড়াকৈর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। শিক্ষার্থী এবং ফলাফলের দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি উপজেলার মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
অনেক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে শতভাগ পাসের জন্য এলাকায় বেশ সুনামও ছিল। সে কারণে আশেপাশের গ্রামগুলো তো বটেই দূর-দূরান্ত থেকেও শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানটিতে আসতে শুরু করে।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সাইকেলে চড়ে, ভ্যানে করে যাতায়াত করে থাকেন। পিঁড়াকৈরের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী শ্রীরামপুর, মল্লিকপুর, সাটইল, ভারশো, কেশবপুর, সাবাই, তেলিপাড়ার অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করেন। এমনকি একই পরিবারের কয়েকজন এই প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসেন।
Advertisement
এছাড়া তুলনামূলক দূরের গ্রাম শংকরপুর, রুয়াই, যতিশমাইল, শালদহ, ভাতহণ্ডা, জয়পুর ও তেঁতুলিয়া থেকেও অনেকেই সাইকেলে চেপে সুনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানে আসেন।
কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার একেবারে নাজেহাল অবস্থার কারণে বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠানে আসছে না এক সময়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা। এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী আসতে পারছেন না বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মামুনুর রশিদ হেলাল। অনেক শিক্ষার্থী ভোগান্তি পোহাতে না পেরে অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছেন।
মামুনুর রশিদ হেলাল বলেন, ‘পড়ালেখার প্রতি এই এলাকার মানুষের ব্যাপক ঝোঁক রয়েছে। যেখানেই রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, লোকজন নিজের ঝাড়ের বাঁশ কেটে ছেলে-মেয়েদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে শ্রীরামপুরের শিক্ষার্থীদের আসতে অসুবিধা হচ্ছিল। বেশ কিছু জায়গায় পানি জমে থাকতো। বিভিন্ন গ্রামের অভিভাবকরা মিলে বাঁশ দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করেছিল। পরে সিখানে কাঁচা রাস্তা করে দিয়েছে ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান।’
Advertisement
‘তবে বর্তমানে মাদ্রাসার চারপাশের রাস্তা ভেঙে গেছে। এখানে যে রাস্তা ছিল এটাই বোধ হয় অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবে না। পিঁড়াকৈর স্কুলের দিক থেকে আসা ছেলেমেয়েদের আসার পথ ভেঙে পুকুরের মধ্যে চলে গেছে। সরকারিভাবে রাস্তা করতে চাইলেও স্থানীয় গোপীরমন ছনা মণ্ডল, অনুকূল প্রামাণিক ও সন্তোষের ছেলে মিলে তা হতে দিচ্ছে না। যদিও সেই পুকুরটি খাস (সরকারি)।’
‘রাস্তাটা হয়ে গেলে ছেলেমেয়েদের প্রায় এক কিলোমিটার পথ ঘুরে আসতে হতো না। এখন এতদূর পথ খামাখা ঘুরে আসতে হচ্ছে ওদের।’
রুয়াই, শালদহ, শংকরপুর, ভাতহণ্ডা ও জয়পুর থেকে আসা শিক্ষার্থীদের পিঁড়াকৈর গ্রামে আসার আগেই একবার পানিতে নামতে হয়। অনেক বার বলার পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ সাহা তিন হাজার আটশ টাকায় একটি নৌকা কিনে দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের জন্য। তবে সেটা ব্যবহার হবে চক এবং আনদোলের বিলে। যা ষ্যান্ডেল থেকে পিঁড়াকৈর ঘাট পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী পারাপারে ব্যবহার করা হবে।
তবে মাদ্রাসার চারদিকের রাস্তা একেবারে চলাচলের অনুপযুক্ত হওয়ায় নৌকা দিয়েও ভোগান্তি কমছে না তেমন। সাইকেলে চড়ে আসা শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসায় না এসে বাড়িতে বসে আছেন। অনেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে আর আসবেন না। গত বছরও যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্কটের কারণে বেশ কিছু শিক্ষার্থী অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেছেন। নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতেও হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক মুহাম্মদ রেজাউল করিম সেলিম জানান, ‘ছাত্র-ছাত্রী কীভাবে আসবে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে। আমরাই তো গ্রামের মধ্যে অনেক দূরে মোটরসাইকেল রেখে কাদার মধ্যে দিয়ে মাদ্রাসায় যাই। শুকনো মৌসুমেও প্রতিষ্ঠানে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসলে মাইক্রো নিয়ে ঢুকতে পারে না।’
তিনি আরও জানান, ‘আগে চলাচলে কোনো সমস্যা হতো না। সমস্যাটা হয়েছে রাস্তাঘাট ভেঙে পুকুরের মধ্যে চলে যাওয়ার কারণে। অথচ ২০ থেকে ৩০ গজ রাস্তা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের এক কিলোমিটার পথ কমে যায়। সব চেয়ে বড় কথা, এখন তো প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত পৌঁছানোরই কোনো পরিবেশ নাই।’
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল গাফফার, রেজাউল করিম সেলিম ও আজহার আলী মিলে চেয়ারম্যানকে খুব করে অনুরোধ করাতে তিনি নৌকাটি কিনে দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা দেয়ার। যেনো অন্যদের দেয়া অর্থের সঙ্গে মিলিয়ে তা দিয়ে কোনো ব্যবস্থা করা হয়।
এ ব্যাপারে মাদ্রাসার সুপার জানান, ‘প্রতিশ্রুতি অনেকেই দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কেউই কিছু করে দেয়নি। সাংসদ থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান রশিদ সাহেবও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উপজেলার বড় বড় নেতারাও রাস্তা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিছুই করে দেননি।’
এভাবে চলতে থাকলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে গিয়ে ফলাফলে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটারও আশঙ্কা করেন তিনি। সুনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে ধ্বংসের দিকে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
রেজাউল করিম সেলিম জানান, ‘মাদ্রাসার বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বাৎসরিক তাফসীর মাহফিলে এসেও অনেকে অনেক কিছু করে দিতে চান। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে সামান্য রাস্তাটুকু করে দিলে অনেকেরই উপকার হবে। কারণ এই রাস্তা দিয়ে আগে প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ যাতায়াত করতো; রাস্তা হলে সুবিধা তাদেরও হবে।’
গ্রামের লোকজনও রাস্তাটি মেরামতের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাস্তাটি সংস্কার হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর জন্য আইলের মতো যে চিকন জায়গাটি ছিল চলাচলের জন্য, সেটাও ভেঙে গেছে। পুকুরের পাড় পর্যন্ত ভেঙে সেখানে জাল দিয়ে ঘিরে মাছ আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এলাকার সবাই চান, শিগগিরই যেনো রাস্তাটি সংস্কারে এগিয়ে আসেন তাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
কেএ/আরএআর/আইআই