বিভিন্ন রাষ্ট্রের মত জাতিসংঘও শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সরব হয়েছে। এটি আশার কথা। বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিক আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দান বাংলাদেশের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে যে, ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন ভার বহনের সামর্থ বা সক্ষমতা কোনটাই বাংলাদেশের নেই। পাশাপশি, বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সেই প্রজ্ঞাও প্রদর্শন করতে হবে এবং মিয়ানমারসহ বিশ্ববাসীকে উপলব্ধি করাতে হবে যে, শরণার্থীদেরকে প্রদত্ত এই মানবিক সহায়তা খুবই ‘সাময়িক’। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে এক্ষেত্রে ‘কমজোড়’ হলে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদ আমাদের চারদিক থেকেই গ্রাস করবে। সুতরাং শুরু থেকেই সতর্কতা অনিবার্য। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারত, চীন (প্রয়োজনে জাপান), রাশিয়ার মত বন্ধু রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে।
Advertisement
রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাচৌকিতে ‘জঙ্গি’ হামলার জের ধরে সেখানে সরকার পরিচালিত ‘সামরিক অভিযানে’ সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। জীবিতরা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ-অনুপ্রবেশ করেছে। কেবল মুসলমান বলে নয়- নিপীড়িত, নির্যাতিত ও বিপন্ন বলেই বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছে, এদেশের মানুষও তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষের এটিই সংস্কৃতি। বিপন্ন ও অসহায়কে এইদেশ ও এদেশের মানুষ কখনো তাড়িয়ে দেয় না- ফিরিয়ে দেয় না। তাই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা প্রান্ত মিয়ানমারের বিতাড়িত, বাস্তুচ্যুত, উন্মূল ও অসহায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুতে সয়লাব হয়ে গেছে। কোন কোন পরিসংখ্যান এমনও বলছে যে, অঞ্চল-বিশেষে স্থানীয়দের সংখ্যা অতিক্রম করে গেছে শরণার্থী রোহিঙ্গার সংখ্যা। ফলে, সৃষ্টি হচ্ছে নানামুখি সংকট।
মিয়ানমারের বিতাড়িত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এই জনচাপ বাংলাদেশের মতো ঘণবসতিপূর্ণ একটি রাষ্ট্রের জন্য কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই আগত শরণার্থী ‘ব্যবস্থাপনা’ বাংলাদেশের সামনে এখন বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন মেয়াদে এপর্যন্ত কম-বেশি প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল এখনো অব্যাহত আছে। সুতরাং এই সংখ্যা যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংখ্যাধিক্য জনবসতির এদেশে রোহিঙ্গাদেরকে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাখাই কঠিনতম কাজ। যে-কোন ফুরসতেই তারা আমাদের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের সাথে বাঙালির জাতিগত মিশ্রণ ভবিষ্যতে ভাল ফল বয়ে আনবে না। তাই শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় সরকারকে কঠোর মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি প্রশাসনিক বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে শরণার্থীদেরকে একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা।
শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় আমাদের দুর্বলতায় ভবিষ্যতে গভীর কোন সংকটের সূচনা হতে পারে। সমগ্র বিশ্ব রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায়- জাতিসংঘও চায়। আমাদের বিবেচনায় জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা বা তত্ত্বাবধানের জন্য মানবিকভাবে বিপর্যস্ত এলাকায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের দাবি উত্থাপন করতে পারে। এবিষয়ে বাংলাদেশ আসিয়ানভুক্ত মুসলিম রাষ্ট্রসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের সমর্থন পাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এছাড়া কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্ট সংকটে উন্নত বিশ্বের সমর্থন আদায়েও বাংলাদেশের উদ্যোগ গ্রহণ আজ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
Advertisement
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরকারি প্রজ্ঞাপন থেকে জানা গেল রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কাজটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই সন্দেহ নেই। এটি বিলম্ব হলেও শুভ উদ্যোগ। কিন্তু পেশাগত দক্ষতার মাপকাঠিতে পুলিশ বাহিনীর নিকট থেকে যে সুফল পাওয়া যাবে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যাবে সেনাবাহিনীর দ্বারা কাজটি সম্পন্ন করতে পারলে। আর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর মাধ্যমে করতে পারলে প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত সুঙ্খল হবে। মনে রাখতে হবে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করানোর জন্যও জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।
একটি নির্দষ্ট এলাকার মধ্যে শরণার্থীদের বসবাস নিশ্চিত না করতে পারলে দালালচক্রের সহায়তায় স্থায়ী বাসিন্দাদের সাথে তাদের মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই সংমিশ্রণের ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও ব্যাপক। এই সংকট খাদ্য বা বাসস্থান সংকট-সংকুলানের চেয়ে জাতীয় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ইতোপূর্বেও দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা এদেশের কিছু অসাধু ব্যক্তির সহায়তায় জাতীয় পরিচয় পত্র এমনকি পাসপোর্ট সংগ্রহের মাধ্যমে দেশে বিদেশে নানা অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে। ক্ষুণ্ন হয়েছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। অতীতের বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় কঠোর শৃঙ্খলা প্রবর্তনে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনাকে চৌকস ও দক্ষ করে তুলতে হবে।
জাতিসংঘকেও মনে রাখতে হবে, আভ্যন্তরীণ নানা সংকট ও সমস্যা স্বত্ত্বেও আমরা আমাদের মানবিকতাকে প্রসারিত করেছি। আগামী দু’একদিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দশ লাখে পৌঁছার আশংকাও করছি। নিজস্ব জনসংখ্যার ওপর সৃষ্ট এই শরণার্থী চাপ আমাদের জন্য বিরাট বোঝা। তা স্বত্ত্বেও মানবতাকে আমরা বিসর্জন দিইনি। বরং মানবতাকেই সর্বাগ্রে এবং সর্বোদ্ধে তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সকল প্রতিবেশির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বসুলভ সহাবস্থান চায়। এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে যে-কোন সমস্যার সমাধান করতে চায়। তাই বারবার মিয়ানমার কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলেও বাংলাদেশ ‘ধীর চলো নীতি’ অবলম্বনের মাধ্যমে চরম ধৈর্য্য রক্ষা করে সংকট সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশ সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতে রেখেছে, পূর্বানূমতি না নিয়ে তাদের হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর প্রবেশ করেছে। এজন্য তারা দুঃখপ্রকাশ পর্যন্ত করেনি। এহেন মানবিক বিপর্যয়েরকালে জাতিসংঘের কাছে আমরা মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আশা করছি আসন্ন অধিবেশন থেকেই।
রাষ্ট্রহীন করে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ও জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করছে। রাখাইন রাজ্য ‘রোহিঙ্গা মুক্ত’ করার সরকারি ঘোষণায় এবং সরকারি বাহিনীর দ্বারা ব্যাপকহারে ধর্ষণ ও গণহত্যা পরিচালনা করায় প্রাণভয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। এমনকি এই উন্মূল যাত্রাপথে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুরাও রয়েছে শরণার্থীর দীর্ঘ স্রোতে। তাছাড়া, শত শত নারী পুরুষ ও শিশুর লাশে নাফ নদীর স্রোতেও বিষণ্ন হয়ে উঠেছে! এসব দৃশ্য আন্তর্জাতিক বিশ্ব দেখছে মিয়ানমারের নিন্দা করছে। গণহত্যা বন্ধ করাসহ ও সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী তুমুল আলোচনার ঝড় উঠছে, তবু অং সান সু চি-র সরকার মানবিকতা প্রদর্শনের পথে হাঁটছে না।
Advertisement
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুরোধ-উপরোধ স্বত্ত্বেও এখনো রাখাইনে গ্রামের পর গ্রাম সেনাবাহিনীর আগুনে পুড়ছে। শুধু কি গ্রাম পুড়ছে? একইসাথে পুড়ে ছাই হচ্ছে বিশ্বমানবতা। বাংলাদেশ মানবিকতাকে পুড়ে ছাই হতে দেয় না। বাংলাদেশ নাফ নদীতে লাশের দীর্ঘ মিছিল দেখে পাশবিকতার বিপরীতে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। রোহিঙ্গদেরকে অং সান সু চি-র মিয়ানমার বিতাড়িত করে দিলেও ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ জন্ম নেওয়া শতাধিক রোহিঙ্গা শিশুকে বাংলাদেশ আর এদেশের মানুষ তাকে রোহিঙ্গা বলে ফেলে দেয় না নাফ নদীর জলে আশ্রয় দেয়, জন্মভূমি নয় তবু মাতৃমমতায়।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ‘সাময়িক আশ্রয়’ দিয়েছে। বাংলাদেশের ভূমিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশ প্রশংসা করেছে। অনেক দেশ ত্রাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কোন কোন দেশ ত্রাণ পাঠানোও শুরু করে দিয়েছে। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, ভৌগোলিকভাবে মিয়ানমারের দূরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের এসব মানবিকতা তাৎক্ষণিক। কিছুটা আবেগজাত, কিছুটা ‘মুসলিম’ রোহিঙ্গা বলে, কিছুটা রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু নাগরিক বলে। কিন্তু বাংলাদেশকে উদ্ভূত সমস্যার বোঝা বহন করে চলতে হবে দীর্ঘ দিন- কত দিন তা কেউ জানে না। কিন্তু আমরা বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের নিকট থেকে এবিষয়ে নিশ্চয়তা চাই। নিশ্চয়তা চাই বৈশ্বিক নানা ফোরামে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের। নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করে বুঝিয়ে দেওয়া যে, রোহিঙ্গারা উন্মূল, উদ্বাস্তু বা রাষ্ট্রহীন নয়- রাখাইনই তাদের মাতৃভূমি, মিয়ানমারইই তাদের রাষ্ট্র, তারাও সেদেশের নাগরিক। কিন্তু যতদিন এটি সম্ভব না হবে ততদিন জাতিসংঘকে রোহিঙ্গা শরণার্থীর দায় বহন করতে হবে। আশ্রয় শিবিরের সামগ্রিক ব্যবস্থপনা ও তত্ত্বাবধানের দায় জাতিসংঘকেই নিতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ( ১১.০৯.২০১৭) বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আসা সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। ওই দেশে নিরাপদ অঞ্চল গঠন করে তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। কারণ এ সংকট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। অপরদিকে, সদ্যসমাপ্ত ওআইসি সম্মেলনে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও প্রায় অনুরূপ বক্তব্য প্রদান করে জাতিসংঘে চাপ প্রয়োগের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। বিশ্ববাসীর মত বাংলাদেশও চায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাখাইনে একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন করা। বাংলাদেশ আরো চায় যতদিন রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গঠন না হবে ততদিন বাংলাদেশের ভেতর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিতে হবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর। এখন জরুরি ভিত্তিতে এবিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা উচিৎ।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস