জীবন বাঁচাতে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে অন্যদের মতো বাংলাদেশে এসেছেন ৩০ বছর বয়সী এহসান। রাখাইনে নিজের গ্রাম চীনখালী ছেড়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন আল জাজিরার কেটি অারনল্ড।
Advertisement
এহসান জানান, ‘রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব শুরুর আগে নিজ গ্রামে চাষাবাদ করতাম। কৃষিকাজ করলেও আমি বাচ্চাদের ইংরেজি শেখাতাম। সে কারণে আমি ছিলাম অত্যন্ত ব্যস্ত একজন মানুষ।’
‘২৫ আগস্ট সকালে পরিবারের সবার সঙ্গে নাশতা করতে বসেছি; ঠিক এরকম সময় সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে এসে গুলি চালানো শুরু করে। তারা বাছবিচারহীনভাবে হত্যা শুরু করে; আমার পরিবারের পাঁচজন সেদিন মারা গেছে।’
‘ঘরের মেঝেতে আমার মাকে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। তার পিঠে গুলি লেগেছে। আমার বোনের মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এটা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ছবি ছিল।’
Advertisement
তবে এসবের বাইরেও আরেকটি ব্যাপারে আমার ভয় বেশি ছিল যে, সেনাবাহিনী আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।’
‘এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর একজন আমার বোনকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু ওই লোক আমার বোনকে আঘাত করেই চলেছে। তারপর এখন পর্যন্ত আমার বোন কোনো কথা বলছে না। আমার ভাই-বোনকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছি। আসার সময় কম্বল আর হাতে লাঠি ছাড়া কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি।’
‘বাংলাদেশে আসার পথে আমরা বিভিন্ন ধরনের দৃশ্য দেখেছি। রাস্তার পাশে মৃতদেহ, বাচ্চাদের কান্না, ক্ষুধার্ত বৃদ্ধদের দেখেছি। বাংলাদেশে আসার সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নদী পার হয়ে আসার চেষ্টা করতেও দেখেছি। এমনকি নৌকায় চড়ে আসার সময়ও অনেককে দেখেছি, যারা তাতে ওঠার চেষ্টা করেছে।’
‘বাংলাদেশে এসেও আমাদের জীবন দুঃখে ভরা। আমরা যথাযথ সমর্থন পাচ্ছি না এখানে। এখানে চাহিদামাফিক স্যানিটেশন সুবিধা নেই; এমনকি রোহিঙ্গাদের ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত স্থান নেই।’
Advertisement
‘আমরা বেঁচে আছি; কিন্তু মৃত্যু বোধ হয় এর চেয়ে ভালো হতে পারে। আমার ভয় হয়; রোহিঙ্গারা শিগগিরই মারা পড়বে। মিয়ানমারে থাকলে আমরা মারা পড়তাম; আর এখানে এটা তো কোনো জীবন নয়।’
‘আমি খুবই আশাবাদী যে, সারাবিশ্ব থেকে আমাদের সহযোগিতা করা হবে। পৃথিবীর কাছে আমাদের কথা তুলে ধরতে চাই। বলতে চাই, অন্যদের মতো আমরাও মানুষ; তারপরও সবাই কোনো না কোনো দেশের নাগরিক; কিন্তু আমরা নই।’
‘সারা পৃথিবীর কাছে আমার আবেদন, দয়া করে আমাদের একটি দেশের নাগরিকত্ব দেন; আপনাদের মতোই আমাদেরও বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেন।’
বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে এহসানের সঙ্গে কথা বলেন আল জাজিরার কেটি অারনল্ড। পরিষ্কারভাবে এহসানের কথাগুলো তুলে ধরার জন্য অর্থ ঠিক রেখে সম্পাদনা করা হয়েছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে জীবন বাঁচাতে ২৫ আগস্টের পর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন লাখ ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যাই বেশি।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সেখানে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ এবং গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়াকে জাতিগত নিধন হিসেবে উল্লেখ করেছে। সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকার এবং অং সান সু চিকে চাপ দিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মহল। তারপরও সহিংসতা সমানহারে চলছে। বাংলাদেশে আসছে হাজার হাজার শরণার্থীর ঢল।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইন রাখাইন প্রদেশের সহিংসতার ঘটনাকে পাঠ্যপুস্তকে পঠিত জাতিগত নিধনের উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সূত্র : আল জাজিরা
কেএ/জেআইএম