হলের ক্যান্টিনে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ- আলোচনায় মগ্ন। সময়টা ২৫শে মার্চ সন্ধ্যাবেলা। দেশের অবস্থা খুব সুবিধার নয় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইছে না। তারা মোটেও বাঙালি নেতৃত্ব মেনে নিতে চাচ্ছে না। নানান টালবাহানা শুরু করে দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই নাকি বলছেন শীঘ্রই খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
Advertisement
ক্যান্টিনে বসে শিক্ষার্থী এসব নিয়েই আলোচনা করছিলেন।
ক্যান্টিন ম্যানেজার কিশোর ব়য়সী রনিকে তাড়া দিয়ে বলল, 'গরম গরম সমুচাগুলো তারাতাড়ি টেবিলে দিয়ে আয়! '
ম্যানেজারের কথামতো সে সমুচাগুলি টেবিলে দিয়ে আসলো। ছাত্ররাও তাকে বেশ স্নেহ করে। একজন বলল, 'রনি দুটো সিঙ্গারা আর প্রত্যেকের জন্য চাও দিস।’'ঠিক আছে আলিফ ভাই। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।'
Advertisement
আলিফ অপর একজন বন্ধুকে বলল, 'দেখেছিস মাসুদ, এই ছোট্ট ছেলেটাও টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না।''হুম, পেটের দায়ে কাজ করতে এসেছে।''এখনও ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিলে ও স্কুলে যেতে চাইবে। আমি একশো ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি।'মাসুদ জিজ্ঞেস করল, 'এই রনি তোর পরিবারে কে কে আছে?'কাজ করার ফাঁকে উত্তর দিল, 'মা আর ছোট বোন।''বাবা নেই? ''না, গত বছর ক্যান্সারে মারা গেছে।'আলিফ বলল, 'দেখেছিস এত অল্প বয়সেই সংসারের গুরুদায়িত্ব এসে চেপেছে ওর কাঁধে!'
গভীর রাত। আলিফ হলে তার কক্ষে বিছানায় শুয়ে আছে। টেবিল ল্যাম্পটা এখনও জ্বলছে। একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে নিজের অজান্তেই। হঠাৎ প্রচণ্ড এক শব্দে তার ঘুম ভাঙলো। কিছু বুঝে উঠতে পারলো না সে। আবার শব্দ। এবার আর বুঝতে বাকি রইল না। সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়েছে। কিন্তু কারা কাকে আক্রমণ করছে?
ইতিমধ্যে অনেকের ঘুম ভেঙে গেছে। উদ্বিগ্ন ছাত্ররা উঁকিঝুকি মারছে ঘটনা উপলব্ধি করার জন্য। গুলির শব্দ হচ্ছে ঠাঠাঠা....। সেই সাথে বোমা বিস্ফোরণের ভয়ংকর শব্দ। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ কেউ! ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার, চেচামেচি আর ছুটোছুটি দেখে আলিফ ঘাবড়ে গেল। এমন সময় রিমন এসে সবাইকে চিৎকার করে বলছে, 'আপনারা সবাই রুমে যান, মিলিটারিরা হামলা চালাচ্ছে। '
কিছুদিন পার হয়ে গেছে। হলের ছাত্রদের অনেকেই যুদ্ধে গেছে। তাদের মধ্যে আলিফও আছে। কেউ কেউ সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা প্রদান করছে।মাসুদ তাদের একজন। কেউ বা প্রাণের ভয়ে ঝামেলা থেকে দূরে থাকার চেষ্টাও করছে। রনি হল ক্যান্টিনে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সকালে খবরের কাগজ বিলি করার কাজও করে।
Advertisement
চারদিকে গা ছমছম করা পরিবেশ বিরাজ করছে। এই বুঝি গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। রনি মিলিটারি ক্যাম্পেও খবরের কাগজ বিলি করে। শুধু তাই নয়, তারা তাকে একটি দায়িত্বও দিয়েছে। হলের যেসব ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে আর যারা তাদের সাহায্য করছে, তাদের সম্পর্কে তথ্য দেওয়া।
পাক সেনারা মাঝে মাঝেই হলে আসতো। কখনও কখনও দু 'চারজনকে ধরেও নিয়ে যেত। কিন্তু যাদের ধরে নিয়ে যেত তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য রনি দেয় নি! তাহলে কি ভেতরেও বিশ্বাসঘাতক আছে! কথাগুলো ভাবছে সে। এমন সময় মাসুদ এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, 'কিরে কি ভাবছিস? ''ভাবছি হলের ভেতরেও মিলিটারিদের চর আছে। ''হুমম, আমারও তাই ধারণা। আর কোনো খবর পেলি? ''না। ''যাহোক, তুই আমাদের আগেভাগে সাবধান না করে দিলে আমরাও যে ধরা পড়ে যেতাম সেদিন। ''এটা আমার দায়িত্ব, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তা করা।''তা বটে, দেশের জন্য তোর এত দরদ! '
আরও কয়েকদিন পর মাসুদ তার কক্ষে বসে রেডিওতে খবর শুনছে। নিকটবর্তী এলাকার পাক সেনাদের ক্যাম্পে আত্নঘাতী বোমা হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছে দশ জন এবং আরও বিশ জন গুরুতর আহত হয়েছে।
রনি হল গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ছয়জন পাক সেনা হঠাৎ তার সামনে উপস্থিত হল। সে কিছুটা চমকে উঠল। তবে ভান করল যেন স্বাভাবিক আছে। টিম কমান্ডার তাকে চেনে। বলল, 'রনি মাসুদের রুমটা একটু দেখিয়ে দিবি, চল।'
বুকটা ধরফর করে উঠল তার। শিরার মধ্য দিয়ে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল। পানি খাওয়ার বা টয়লেটে যাবার অজুহাত দেখালেও কিছুতেই তাকে যেতে দিলো না। অগত্যা বাধ্য হয়ে ওদের সাথেই আসতে হচ্ছে।রনি বলল, ' মাসুদ ভাই ১০৯ নম্বর রুমে থাকে। ''আগে ২০৯ নম্বর রুমে যাব, চল।'
রনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। কারণ তার মাসুদ ভাই ২০৯ নম্বর রুমেই থাকে। সে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে এখন। কিভাবে সে তার মাসুদ ভাইকে বাঁচাবে? মনে মনে চিন্তা করল তার মাসুদ ভাইয়ের রুমটা এককোণায়। বারান্দার রেলিংয়ের সাথে একটি লম্বা গাছ ছোঁয়া ছোঁয়া ভাবে বেড়ে উঠেছে। পালানোর সুযোগ আছে!
সহসা রনি দৌড় দিল এবং চিৎকার করে বলতে লাগল, 'মাসুদ ভাই পালান, মিলিটারি আসসসস......। 'বাক্যটি শেষ হবার আগেই বুলেটের কয়েকটা শব্দ হল। বুলেটের ধাক্কায় মাটিতে আছড়ে পড়ল রনি। শার্টের পেছনে কয়েকটি ফুটো। মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে গেল তার সাদা জামাটি।
এইচআর/পিআর