ইদানিং, নির্দিষ্ট করে বললে, ১৬ বছর আগে ৯/১১ এ যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে, বিশ্বের কোথাও কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই আমি প্রবল শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করি। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যে হামলাকারী হিসেবে মুসলমান কারো নাম আসবে, কোনো একটা জঙ্গী সংগঠন দায় স্বীকার করবে। আর তারপর শুরু হবে শান্তির ধর্ম ইসলামকে নিয়ে নানান কচলাকচলি। পশ্চিমা মিডিয়ার কাজই হলো সন্ত্রাসের সাথে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলতে টানা অপপ্রচার চালানো। কিছু সন্ত্রাসী ইসলামের নাম ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে, অল্প কয়েকজন মানুষের অপকর্মের দায়ে তো আপনি বিশ্বজনীন একটি ধর্মকে কোনঠাসা করতে পারেন না। কিন্তু ১৬ বছর ধরে তাই হয়ে আসছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাই ঘটুক, খুঁজে খুঁজে মুসলমান কারো ঘাড়েই দায় চাপানোর চেষ্টা হয়। মুসলমান নাম হলেই বিশ্বের বিভিন্ন বিমানবন্দরে হয়রানি করা হয়। এমনকি এ হয়রানি থেকে রেহাই পান না ভারতের রাষ্ট্রপতি বা তারকা অভিনেতাও। মুসলমান হওয়ার অপরাধে হয়রানির শিকার হতে হয় মার্কিন যুক্তকরাষ্ট্রের স্কুলছাত্রকেও!
Advertisement
ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই কোনো মানুষকে ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, জাতি দিয়ে লিঙ্গ দিয়ে বিবেচনা করি না। আমার একমাত্র বিবেচনা মানুষ। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে কোনো মানুষ নির্যাতিত হলে, আমি তার নাম জানতে চাই না, ধর্ম জানতে চাই না, নারী না পুরুষ, সাদা না কালো জানতে চাই না। স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরীদের প্রতি আমার সমর্থন আছে, বেলুচদের ন্যায্য দাবির প্রতি আমার মমতা আছে। কুর্দিদের স্বাধীনতার আকাঙ্খায় আমার সহানুভূতি আছে। এমনকি বাংলাদেশের আটকেপড়া পাকিস্তানিদেরও আমি মানবিক জীবন চাই। এই যেমন এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে গণহত্যা চলছে, বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে যে মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে; তার প্রতি পশ্চিমাদের নির্লিপ্তি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। তাদের কাছে মানবিকতাটা আপেক্ষিক। মানুষ নয়, তাদের কাছে স্বার্থটাই বড়।
মিয়ানমার যে ১০/১২ দিনে তিন হাজার মানুষকে মেরে ফেলে, ৩ লাখ মানুষকে দেশছাড়া করলো; পশ্চিমা মিডিয়ার আওয়াজ আপনার কানে এসেছে? ধর্মকে বিবেচনায় নিতে চাই না, কিন্তু ভাবুন তো একবার রোহিঙ্গারা যদি মুসলামান না হয়ে খ্রিস্টান বা ইহুদি হতো; সারাবিশ্বে এতক্ষণে যুদ্ধ বেঁধে যেতো না। এরা যদি হিন্দু হতো নরেন্দ্র মোদি কী পারতেন অং সান সু চির অন্যায়কে সমর্থন করতে? সবার ক্ষেত্রেই মানবাধিকার, মানবতা আপেক্ষিক। অথচ মানবতার কোনো দেশ, ধর্ম, জাতি থাকার কথা নয়।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চলছে। পুরো একটি জাতিকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। সেটা হয় মেরে, নয় তাড়িয়ে। গত দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাখাইনে গণহত্যা হচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের টার্গেট একটাই কিছু লোককে মেরে বাকিদের ভয় দেখানো। তাতেও না হলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া, যাতে তারা জান বাঁচাতে বাংলাদেশে ছুটে যায়। শত বছর, হাজার বছর ধরে রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের অং সান সু চি বাঙালি বলেন! তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে চান। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ৩০ বছর ধরে অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস করছে। তবে অং সানর সু চির মিয়ানমার এবার মনে হয় শেষ চেষ্টা করছে এবং সাফল্যের সঙ্গে। গত দুই সপ্তাহে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। রাখাইন রাজ্যে তো সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নেই। টেকনাফ সীমান্তে দাঁড়ালে দেখা যায় প্রতিদিনই সেখানে আগুন জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখলে বোঝা যায়, যে অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা এখনও সেখানে আছেন, তারা না যাওয়া পর্যন্ত আগুন জ্বলবেই।
Advertisement
একবিংশ শতাব্দীতে মানবাধিকারের প্রতীকে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ গত ৩০ বছর ধরে যেমন, এখনও তেমন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সীমান্ত খুলে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের বুকে আশ্রয় দিয়েছে। এখন বাংলাদেশে যত রোহিঙ্গা আছে, তার সিকিভাগও নেই রাখাইনে। ভারত আর চীনের সহায়তায় নোবেল বিজযী অং সান সু চি সারাবিশ্বের সবার চোখের সামনে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছেন। একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার দাবিদার বিশ্ব নেতাদের কি একটুও লজ্জা লাগছে না নিজেদের সভ্য দাবি করতে। নানা জন নানা কথা বলছেন, নানা উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে; কিন্তু এই ফাঁকে তো অং সান সু চি তার লক্ষ্য পূরণ করে ফেলছেন। সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে মাইন বসিয়ে সীমান্ত সিল করে দেয়ার পর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে লাভ কি? টুকটাক বিবৃতি, নিন্দা, এই করা উচিত, সেই করা উচিত বলে তো মিয়ানমারকে থামানো যাচ্ছে না। তারা যাতে শোনে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ তো কোথাও দেখছি না। যা করার এখনই করতে হবে। প্রথম কাজ হলো, বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পাশে মানবিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়ানো। তারপর তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ। কিন্তু মিয়ানমারে এখন নানা দেশের নানা স্বার্থ। ভারত আর চীন প্রতিযোগিতা করে মিয়ানমারের বন্ধু হতে চাইছে। কারণ মিয়ানমারের সমূদ্র বন্দর তাদের দরকার, প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের দরকার, তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা দরকার। সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় খালি মানুষ। রোহিঙ্গারা যে নির্বিচারে মরে যাচ্ছে, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, তা নিয়ে কারো ভাবনা নেই।
রাখাইনের চিত্র আমরা সরাসরি দেখতে পারছি না, শুনছি। কিন্তু বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে গেলেই যে কেউ টের পাবেন, মানবতার কত বড় বিপর্যয় ঘটছে সেখানে। সাম্প্রতিক সময়ে এত বড় মানবিক বিপর্যয় আর কোথাও হয়নি। তুরস্কের সমূদ্র সৈকতে এক আয়লানের মরদেহ সারাবিশ্ব বিবেককে কাঁদিয়েছিল। আর আজ নাফ নদীতে শত শত আয়লানের লাশ ভাসছে, বিশ্ব বিবেক আজ বুঝি ঘুমাচ্ছে। ঘুমাও বিবেক ঘুমাও, জেগে দেখবে তোমার বিবেক মরে গেছে।
অন্য সব বিষয়ে মুসলমানদের ভিক্টিম বানানো হলেও, আমার ধারণা ছিল অন্তত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলমানরা নির্যাতিত হিসেবেই বিবেচিত হবে। কিন্তু ধূর্ত অং সান সু চি রোহিঙ্গা ইস্যুকেও জঙ্গী ইস্যু বানিয়ে ফেলতে চাইছেন। রাখাইনের গণহত্যাকে তারা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আবরণ দিতে চাইছেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের রিপোর্টেই ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সূত্র। তিনি আইন মেনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া এবং বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এই রিপোর্ট দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেনা ক্যাম্পে হামলাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিশ্চিহ্ন করার মরণ কামড় দেয় মিয়ানমার সেনারা। কারা চায়নি কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হোক? অবশ্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাহলে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসার এই হামলায় সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে কাদের? অবশ্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার আগেই যারা পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে চেয়েছিল, তারাই আরসার হামলাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। মিয়ানমার আগে থেকেই রাখাইন এলাকায় সৈন্য সমাবেশ বাড়িয়েছে। তার মানে সব তৈরি ছিল। খালি একটি হামলার অজুহাত দরকার ছিল ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। আর এখন তো জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই হামলার প্লট তৈরি করেছিল। বাংলাদেশে বিপাকে ফেলতে পাকিস্তানের চেষ্টা তো ৪৬ বছর ধরেই চলছে।
একটি জাতির ওপর যুগের পর যুগ আপনি নিপীড়ন চালালে, সেখানকার মানুষ প্রতিবাদ করবেই। অং সান সু চিও তো বছরের পর বছর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি তো জানেন মানুষ কেন প্রতিবাদ করে। তাই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রোহিঙ্গারাও প্রতিবাদ করবেই। আর কোনো উপায় না পেলে তারা হয়তো অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে পারে। তবুও অস্ত্র হাতে তুলে নেয়াকে আমি সমর্থন করছি না। কিন্তু গতবছর অক্টোবরে বা গত ২৫ আগস্টে ক্যাম্পে হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী যা করছে, তা কি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান? নাকি পরিকল্পিত গণহত্যা, জাতি নির্মূল অভিযান? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান দেখেছি। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গীবিরোধী কঠোর অভিযান চলছে। কিন্তু এসব অভিযানে তো শুধু সন্ত্রাসীরাই মারা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ নিরাপদ থাকছে। কারণ সাধারণ মানুষের জীবন নিরাপদ করার জন্যই তো সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান। কিন্তু মিয়ানমার রাখাইনে যা করছে, তা কোনোভাবেই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান নয়। সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান হলে সেখানে সাধারণ মানুষ, নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে কেন?
Advertisement
জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে যা হচ্ছে, তা পরিস্কার জাতি নিধন। মিয়ানমার জানে এটা স্বীকার করলেই তারা বিপাকে পড়বে। তাই তারা একে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান বলতে চাইছে। আর মিয়ানমারের এই দাবি মিথ্যা জেনেও কিছু দেশ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের দাবির অসারতা প্রমাণে বাংলাদেশ সীমান্তে সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার তাতে সায় দেয়নি। দিলেই যে গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।
রোহিঙ্গামুক্ত মিয়ারমার গড়ার স্বপ্নে বিভোর অং সান সু চি নিশ্চয়ই সাফল্যে বগল বাজাচ্ছেন। কিন্তু মিয়ানমার যে সারাবিশ্বে খুনী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছেন, তার খেয়াল কি আছে? আর ১৬ কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট বাংলাদেশ তারপরও পরম মমতায় আশ্রয় দিয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে, কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকেও খাওয়াতে পারবেন। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি আজ রক্তখেকো ডাইনি, আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে মমতার প্রতীক।
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
probhash2000@gmail.com
এইচআর/পিআর