মতামত

রোহিঙ্গা বিষে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড

ইস্যু বাতিকে টুকটাক গোলমাল থাকলেও গোটা দেশ এখন রোহিঙ্গা বিষে কাবু। শুধু কক্সবাজার সীমান্ত বললে তা হবে খণ্ডিত তথ্য। এ বিষের যন্ত্রণা গোটা বাংলাদেশেই। বেদনার প্রতিক্রিয়াও মোটামুটি একমুখী। ছুতানাতায় পরস্পরের বিরুদ্ধে নেমে পড়ার নোংরা দৌড়ও কমে এসেছে। নন ইস্যুকে ইস্যু করারও সময় নেই কারো। এক টিস্যুতে জাহেরি-বাতেনি প্রায় সব ইস্যুই আপাতত ধুয়ে-মুছে শেষ। কথাবার্তা-প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা মাত্রাবোধও খেয়াল করার মতো। চেপে বসা রোহিঙ্গা আপদ রাজনীতির মাঠেও একটা লেভেল প্লেয়িংয়ের আবহ তৈরি করে দিয়েছে।

Advertisement

তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার না থাকাতেই দেশে রোহিঙ্গারা ধেয়ে আসছে, বিএনপি থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত এ ধরনের দোষারোপ আসেনি। আবার সরকার থেকেও বলা হয়নি, বিএনপির ষড়যন্ত্রের কারণেই এতো রোগিঙ্গার অনুপ্রবেশ। বরং সরকার থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মানবিক হ্ওয়ার আবেদন সরকারবিরোধীদের কাছেও আবেদন তৈরি করেছে। সীমান্তে নির্দিষ্ট জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়সহ বিএনপির দাবিও এমনই। এছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চীন-ভারতসহ বিভিন্ন দেশ সফরের পরামর্শটিও রাজনীতির বাঁকে বাঁকা চাঁদের হাসির মতো আশা জাগানিয়া। এই পর্যন্ত লক্ষণ ভালোই। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় মানুষ কেন, বাঘ-মহিষকেও এক ঘাটে পানি খেতে হয়।

চীনের সাথে আমাদের একাত্তরের চরম দিনের পরমবন্ধু ভারতও কেন মিয়ানমারের পক্ষে গেলো- এ বিতর্কের কিনারা মেলা সহজ নয়। আবার এর পেছনে সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা খুঁজেও ইন্টারেস্টিং হওয়ার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা ইস্যূতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ না হলেও হয়ে গেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বিরোধ নেই।

সরল অংকে বাংলাদেশ বড় জোর তৃতীয় পক্ষ হতে পারে। কিন্তু ভূ-রাজনীতিসহ আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় বাস্তবতায় মিয়ানমার পারলে বাংলাদেশকে প্রথম পক্ষই বানিয়ে ফেলে। মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ইস্যূ এসে চেপেছে বাংলাদেশের ওপর। বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়সহ সহায়তার মানবিক দায় বাংলাদেশের।

Advertisement

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সম্বোধন করে 'বাঙালি সন্ত্রাসী' নামে। তাদের দাবি- মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর ২৫ আগস্টের হামলার পরিকল্পনা হয়েছে তৃতীয় একটি দেশে। সেটি বাংলাদেশ। অভিযোগ করেই ক্ষ্যান্ত নয় তারা। বার্ন অ্যান্ড কিল থিওরিতে রোহিঙ্গাদের কচুকাটার পাশাপাশি বাংলাদেশের গায়ে পড়ে যুদ্ধ বাঁধানোর সব চেষ্টাও করছে। সীমান্তে ভূমিমাইন বিস্ফোরণও বাদ দেয়নি। ১৬/১৭ বার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করেছে। জল-স্থলে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করেই চলছে। শত- হাজার ছাড়িয়ে তার দেশের লাখ লাখ নাগরিককে ঠেলে পাঠিয়েছে বাংলাদেশে। বিপরীতে বাংলাদেশ অবিরতভাবে দিয়ে যাচ্ছে মানবিকতার প্রমাণ। সরকারের বাস্তব উপযোগী এ মানবিক কূটনীতির ফলও মিলতে শুরু করেছে।

রোহিঙ্গা ইস্যূতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ‘ডিপ্লোম্যাটিক পারফরমেন্স’ বিশ্ব নেতাদের অনেককেও মুগ্ধ করেছে। বিরোধীমতের অনেকেও বলছেন, কূটনীতি আর মাঠের বক্তৃতা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, তা আবারও দেখালেন শেখ হাসিনা। এরইমধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্রোত ঠেকাতে সেখানে জাতিসংঘের মতো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে কয়েকটি সেইফ জোন গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রস্তাবটির পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে ওঠার লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে।

রাজনীতির ময়দানের মানুষদের কারোই বোঝার বাকি নেই কী বিষে আক্রান্ত বাংলাদেশ? বিশ্ববাস্তবতাই বা কী? নাটকের ঘনঘটা্ও প্রচুর। কারো জন্যই তা সুসংবাদের নয়। এই বোধবুদ্ধির নমুনা্ও বিদ্যমান। এখনও দেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে চলছে বন্যা। এর আগে, আগাম বন্যায় হাওর এলাকায় তলিয়ে গেছে এবারের পুরো বোর ফসল। আর তখুনি ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ এই রোহিঙ্গা শরণার্থী। সমস্যাটি শুধু কিছু মানুষকে আশ্রয় আর খাওয়া-পরা দেয়া পর্যন্তই নয়।রোহিঙ্গা সংকটে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও কেন বাংলাদেশের স্বার্থ বা ন্যায্যতার পক্ষে বিশ্ব জনমত পেতে সময় লাগছে? ভারত, চীন সঙ্গে রাশিয়াও কেন সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে? সৌদি আরবের অবস্থানও কেন স্বচ্ছ নয়?

জাতিসংঘ কী করছে? আরাকানে গণহত্যা-জ্বালাও- পোড়াওয়ের পাশাপাশি কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবানসহ আশপাশের পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে?- এসব নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। হওয়াও উচিৎ।কিন্তু দলকানা, দলান্ধ, দলদাস হবার সময় নয় এখন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অপরাজনীতিতে সরকারকে হয়তো এক হাত দেখে নেয়া যাবে, কিন্ত সব কূল বাঁচিয়ে যুক্তিসঙ্গত-সহনীয় সমাধান না এলে সমূহ শঙ্কা ভয়ঙ্কর সামজিক বিপর্যয়ের। সর্বনাশের মধ্যে আলুপোড়ার সুযোগ দিলে নিজের ঘরও যে পুড়তে পারে।

Advertisement

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম