জাতীয়

যেখানে মলমূত্র ত্যাগ, সেই পানিতেই রান্না

সবকিছুই হারিয়েছেন তাসমিন (২২)। মিয়ানমারের মংডুর আনডং গ্রামে সুখের সংসার ছিল তার। সেনাদের এক রাতের অভিযানে সবকিছু পুড়ে ছাই। একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় বর্তমানে আশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে।

Advertisement

এখন অতীত নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। সব চিন্তা বর্তমানকে ঘিরে। আট মাস বয়সী ছেলে ফিরোজ আমিনের সুস্থতাই একমাত্র কামনা।

কথা হয় তাসমিনের সঙ্গে। জানান, বাংলাদেশে আসার পর থেকে ছেলে ফিরোজ আমিনের ডায়রিয়া, জ্বর ও কাশি। কোনোভাবেই সুস্থ হচ্ছে না সে।

‘কোনো ডাক্তারের কাছে যেতে পারছি না। এখানে আমি তো কাউকে চিনি না।’ উখিয়ার বালুরঢালা সড়কের পাশে অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়ে উৎভ্রান্ত মা কথাগুলো বলছিলেন। গত শনিবার থেকে তারা সেখানে অবস্থান করছেন। সামান্য মাথা গোঁজার মতো কোনো ছাউনি জোগাড় করতে পারেননি তাসমিনের স্বামী। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, প্রকৃতিও যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে হতভাগা রোহিঙ্গাদের ওপর।

Advertisement

‘গত ২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের সেনারা আমাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। এরপর উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। মিয়ানমারের পাহাড়-জঙ্গলে নিদ্রাহীন দু’দিনের পথচলা। এরপর নাফ নদী পার হয়ে টেকনাফ সীমান্তে প্রবেশ। টানা সাতদিন রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘোরাঘুরির ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে শিশুটি।’

গত এক সপ্তাহে পরিবারটি মাত্র দুই বেলা খিচুড়ি খেতে পেরেছে। বাকি সময় চটকানো ভাত (পান্তা), মুড়ি ও বিস্কুট খেয়ে পার করেছে। স্থানীয়রা এগুলো তাদের সরবরাহ করে।

‘শিশুকে যে দুধ খাওয়াব, সেই অবস্থাও নেই। আমি নিজেই খেতে পাই না। শিশুকে দুধ খাওয়াব কীভাবে?’

‘আপনি কি আমাকে কোনো ডাক্তারের খোঁজ দিতে পারবেন’- এ প্রতিবেদকের কাছে প্রবল আকুতি তাসমিনের।

Advertisement

শুধু তাসমিন নন, এমন শত শত মা-ই তাদের নবজাতক ও বাড়ন্ত শিশুদের নিয়ে চিন্তিত। যারা কুতুপালং, বালুখালী, বালুরঢালি ও টিয়াখালী অস্থায়ী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ আগস্টের আগে বাংলাদেশ সীমান্তে নিবন্ধভুক্ত ও অনিবন্ধিত শিবিরে দুই লাখের অধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল।

গতকাল রোববার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আরও এক লাখের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ ও উখিয়ায় অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে অবস্থান নিয়েছে। সোমবারও হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করছে। টেকনাফ সীমান্ত থেকে জাগো নিউজের প্রতিনিধি এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সর্বশেষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক লাখের মধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী শিবির পায়নি। ফলে দিনের পর দিন রোদ-ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের। সবচেয়ে বেহলা দশা নবজাতক, বাড়ন্ত শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের।

সেখানে দায়িত্বরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আগে নির্মিত শিবিরগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলেও নতুন করে নির্মিত স্থায়ী ও অস্থায়ী শিবিরে সেসব সুবিধা নেই। ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নতুন আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ও স্থানীয়ভাবে খাবার এবং বোতলজাত পানি সরবরাহ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এসব শিবিরে পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, যে পানি দিয়ে রান্নাবান্না করা হচ্ছে সেই পানি দিয়েই গোসল ও বাথরুমের কাজ সারা হচ্ছে। এছাড়া উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করায় নতুন শিবিরগুলোতে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে।

এখনই এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত অন্যান্য রোগ মহামারি আকারে দেখা দেবে বলে বেসরকারি সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তারা জানান।

সাতদিন হলো বালুখালী পানবাজার শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন রেহেনা বেগম (৪০)। বলেন, ‘গত চারদিন হলো তিন বছরের সন্তান নিয়ে এ ক্যাম্পে আছি। এখানে আসার পর থেকে ছেলের পাতলা পায়খানা ও জ্বর। কোনোভাবেই ভালো হচ্ছে না। আমারও শরীরে চুলকানি দেখা দিয়েছে।’

‘পাশেই একটি পুকুর আছে। সেখান থেকে পানি নিয়ে রান্নাবান্নার কাজ সারি। পুকুরে গোসল ও কাপড় ধোয়া মানা। গত ১০ দিন ধরে একই কাপড় পরে আছি।’

কোথায় পায়খানা-প্রস্রাব করেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটাই তো বড় সমস্যা। একটি গর্ত খুঁড়ে সেই কাজ সারছিলাম। কিন্তু সেটিও ভর্তি হয়ে গেছে।’

বালুখালী স্বাস্থ্য ক্যাম্পের সিনিয়র নার্স বিউটি বড়ুয়া বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেকেই ঠান্ডা-জ্বর, ত্বকের রোগে ভুগছেন।

এছাড়া মিয়ানমার থেকে আসার সময় আহত হয়ে অনেকে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে রোগীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

‘গত ৫ সেপ্টেম্বর আমরা মাত্র অসুস্থ ২৬ জনকে পেয়েছিলাম। এখন প্রতিদিন ৮০ জন রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি, যার অধিকাংশই শিশু।’

বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ‘কোস্ট’ ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক তারিক সৈয়দ হারুন বলেন, পরিস্থিতি ‘মহামারি’ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সংস্থার পক্ষ থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্যসহায়তা দিচ্ছি। কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল।

‘জ্বরসহ অনেক শিশুর শরীরে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ দেখা দিয়েছে’ বলেন তিনি।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম জানান, গত কয়েকদিনে উল্লেখযোগ্য হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ‘আমি নিজে সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখেছি, বালুখালীর একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন চারশ’র অধিক রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’

‘উখিয়া ও টেকনাফের রোগাক্রান্তের চাপ গত সপ্তাহে তিনগুণ বেড়েছে’- যোগ করেন তিনি। যদিও প্রকৃত সংখ্যা তিনি জানাতে পারেননি।

সালাম জানান, কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ২০টি মোবাইল টিম কাজ করছে। তারা আশ্রিতদের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছে। খোলা উৎস থেকে সরবরাহ করা পানি কীভাবে বিশুদ্ধ করবে- সেই বিষয়েও তারা রোহিঙ্গাদের ধারণাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন উপদেশ দিচ্ছে।

‘কিন্তু পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও অন্যান্য উপকরণ খুবই অপ্রতুল’ বলেও স্বীকার করেন ডা. আব্দুস সালাম।

‘নিবন্ধিত শিবিরে আমরা বিশুদ্ধ খাবার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে পারলেও নতুন নির্মিত শিবিরে সেগুলো করা সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়েও সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে’- উল্লেখ করেন তিনি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি ১৫

ক্ষতজনিত কারণে গতকাল রোববার ১৫ রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে আহত ৮৪ রোহিঙ্গাকে এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

চিকিৎসারত অবস্থায় গতকাল রোববার চট্টগ্রাম মেডিকেলে দু’জন মারা যান। সুস্থ হওয়ার পর আটজনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক মো. আলাউদ্দিন এ তথ্য জানান।

তিনি আরও জানান, গতকাল (রোববার) ভর্তি হওয়া ১৫ রোগীর মধ্যে গুলিতে আহত ১৩ রোগী রয়েছেন।

ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে নিহত ৩

মিয়ানমার সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিবি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, গত শনিবার সীমান্ত থেকে ১০০ মিটার দূরে তারা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান।

বিস্ফোরণে আহত এক রোহিঙ্গার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে তিনজন নিহত হন। আহত হয়ে শুধু এক রোহিঙ্গা বেঁচে ফিরতে পারেন।’

তার শরীর ও মুখে অসংখ্য স্প্লিন্টারের চিহ্ন ছিল, যা ‘স্থলমাইন’ বলে আমাদের ধারণা।

গতকাল রোববার রাতে টেকনাফ সীমান্তবর্তী কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মাইন বিস্ফোরণে আহত দুই যুবকসহ আরও পাঁচ রোহিঙ্গাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় বলে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক আমির হোসেন জানান।

এমএআর/এমএস