গল্পটা এক কথা’র একজন ভদ্রলোকের। সব সময়ই ওই ভদ্রলোক বলেন, তার বয়স ৩৫ বছর। এটা শুনে তার আড্ডার সার্কেলের একজনের বক্তব্য, ৫ বছর আগেও না আপনি বললেন যে আপনার বয়স ৩৫ বছর। কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে ওই ভদ্রলোক জবাব দিলেন- ভদ্রলোকের এক কথা। আমি সব সময় এক কথার মানুষ। ওই এক কথা বলা ভদ্রলোকটির সঙ্গে দারুণ মিল বাংলাদেশের টেস্ট দর্শনের। সর্বান্তকরণে এক-এর অনুসারী বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট।এক নীতি, এক কৌশল! পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রতিপক্ষ এসব মোটেও বিবেচ্য নয় বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট থিংক ট্যাংকের কাছে। আর তাই টেস্ট সিরিজ খেলার সময় নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যে স্ট্র্যাটেজি তার কোনো বদল হয় না উপমহাদেশের ভারত , পাকিস্তানের মত দলগুলোর বিপক্ষেও। ওই যে এক কথা! ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট সিরিজে চার জন স্পিনার নিয়ে টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ। আর দলে স্পেশালিস্ট পেসারের সংখ্যা মাত্র একজন। ঐতিহ্যগতভাবেই স্পিন বিষের সবচেয়ে ওস্তাদ ওঝা ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা। ভারতের বিপক্ষে মুখোমাুখি হওয়া মানেই স্পিনারদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়া।ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সামনে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার বিবেচিত শেন ওয়ার্নের যে কি বেহাল দশা হয়েছিল তা আর নতুন করে বলার কিছু নাই। টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রতিটি উইকেট শিকারের জন্য ওয়ার্নের খরচ মাত্র ২৫.৪২ রান। আর ভারতের বিপক্ষে প্রতি টেস্ট উইকেটের জন্য এই কিংবদন্তির লেগ স্পিনারকে খরচ করতে হয়েছে ৪৭.১৯ রান। মোট কথা ভারতের বিপক্ষে সাধারণ নয় এ চ্যাম্পিয়ন লেগ স্পিনার অতি সাধারণ। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সামনে বারবার নাকাল হওয়া ওয়ার্ন তো একাধিকবার বলেছেন, ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও স্পিন খেলতে পারে।সহজ কথায় ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সামনে স্পিন নির্ভর বোলিং শক্তি যে কার্যকর নয় এটা অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। সেখানে এক/দুই জন নয় ফতুল্লায় চার চার জন স্পিনার খেলাচ্ছে বাংলাদেশ। যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। বাংলাদেশের স্পিনারদের নিয়ে ছেলে খেলা করেছে সফরকারী ব্যাটসম্যানেরা। টেস্ট খেলা পাঁচ দিনের। কিন্তু প্রথম ঘন্টাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সব অসুখের এক ওষুধ হয় না। ভারত তো বটেই, স্পিনের বিপক্ষে সব সময়ই দুর্দান্ত খেলে উপমহাদেশের দলগুলো। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশের বিপক্ষেও তিন জন স্পেশালিস্ট পেসার নিয়ে মাঠে নেমেছে ভারত। বলা বাহুল্য, এ মুহুর্তে ভারতীয় দলের সেরা ফাস্ট বোলার মোহম্মদ সামি ইনজুরির কারণে বাংলাদেশ সফরে আসেননি। তারপরও স্পিনারদের চেয়ে পেসারদের উপরই আস্থা রেখেছে ভারতীয় থিংক ট্যাংক। কারণটাও সুস্পষ্ট। উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা পেস বোলিংয়ের চেয়ে স্পিন বোলিংযে বেশি স্বচ্ছন্দ। এই ভারতই যদি উপমহাদেশের কন্ডিশনে উপমহাদেশের বাইরের দেশগুলোর বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামে তাহলে গ্রহণ করে ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি। সেক্ষেত্রে পেসার কমিয়ে তারা শক্তিবৃদ্ধি করে স্পিনে। কেননা উপমহাদেশের বাইরের দলগুলো স্পিন বোলিংয়ের সামনে খুব স্বচ্ছন্দ নয়। ঘরের মাঠে স্পিন থেরাপিতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিনিয়তই ঘায়েল করে আসছে ভারত। কন্ডিশনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্পিন জালে বিপক্ষ দলকে ঘায়েল করা যায় সেই অভিজ্ঞতা তো বাংলাদেশেরও আছে। বিশ্বকাপের আগে তিন টেস্টের সিরিজে সফরকারী জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডুবিয়েছে বাংলাদেশ। ওই সিরিজে চার জন স্পিনার খেলিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ওই একই কৌশল যে উপমহাদেশের দলগুলোর বিপক্ষে খাটবে না এটা বুঝতে কি আর বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে। সর্বশেষ পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের অভিজ্ঞতা থেকেও কোনো শিক্ষা নেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যানেজম্যান্ট। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুজন পেসার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে নিজের দ্বিতীয় বলেই আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন শাহাদাত হোসেন রাবি। পুরো ম্যাচে একজন পেসার নিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে বোলারদের। স্পিনাররা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি। পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের ওপর যতটুকু চাপ সৃস্টি করতে পেরেছেন তা ওই অভিষেক সিরিজ খেলতে নামা পেসার মোহাম্মদ শহীদ। দলে প্রমাণিত স্পিনাররা থাকতেও ভারত যদি তিন জন স্পেশালিস্ট পেসার নিয়ে মাঠে নামে তাহলে বাংলাদেশ কেন একজন পেসার খেলাবে, এই প্রশ্নটা এখন সবার মুখে মুখে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে তাও ইনজুরির অজুহাত দেয়ার সুযোগ ছিল। প্রথম টেস্টে ইনজুরি আক্রান্ত হওয়ার কারণে ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে পারেননি ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেন। এ সিরিজের আগে পুরোপুরি ফিট হয়ে উঠছেন রুবেল। তাকে স্কোয়াডভুক্তও করা হল। কিন্তু জায়গা দেয়া হলো না সেরা একাদশে। রুবেলকে টেস্টে না খেলানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানেজম্যান্টের যুক্তিটাও খুবই অদ্ভুত। বাংলাদেশের লঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংয়ের ভাষায়- ওয়ানডে সিরিজের জন্য রুবেলকে রেখে দেয়া হয়েছে।তাহলে টেস্ট স্কোয়াডে রুবেলকে রাখা কেন? এর কোনো উত্তর নাই আমাদের টিম ম্যানেজম্যান্টের কাছে। পেসারদের ঘাটতি আছে- শুধু এুটুকু বলে দায়িত্ব পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নাই। একটা টেস্ট ম্যাচে দুজন কিংবা তিন জন পেসার খেলানোর সামর্থ্য নাই এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরেই দলের বাইরে রাখা হয়েছে পেসার আল আমিনকে। স্কোয়াডে রাখলেও খেলানো হয় না পেস অলরাউন্ডার আবুল হাসান রাজুকে। ভারতের বিপক্ষে স্পিন অ্যাটাক খুব একটা কার্যকর হবে না এটা তো জানা কথাই। তাহলে পেসারদের সুযোগ দিতে সমস্যা কোথায়? কন্ডিশন, পরিবেশ, প্রতিপক্ষ এসব কোনো কিছুই বিবেচ্য নয় বাংলাদেশের টেস্ট দর্শনে। ওই এক কথা বলা ভদ্রলোকের মতই এক নীতি আঁকড়ে আছে টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ।এইচআর/পিআর
Advertisement