বিনোদন

ছোটপর্দার দুঃসময়ে তৃপ্তি দিল ‌‘বড় ছেলে’

ঈদ উপলক্ষে প্রচার হয়েছে টেলিছবি ‘বড় ছেলে’। সেই টেলিছবিটিরই একটি ছবি ‌‘ভাইরাল’ হয়েছে। বহুদিন পর ছোটপর্দার কোনো নির্মাণ এতটা আলোচনায় আসল, ইতিবাচকভাবে। টেলিফিল্মটা নিঃসন্দেহে অসম্ভব সুন্দর। এর গল্প, নির্মাণ, নায়ক-নায়িকা অসাধারণ অভিনয় সবই দর্শক হিসেবে তৃপ্তি দিয়েছে।

Advertisement

ধন্যবাদ এর নির্মাতাকে ‌‘আইছস-গেছস’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। কিন্তু তার থেকে বেশি ধন্যবাদ আমাদের সমাজের বাস্তব একটি পরিবেশ উপস্থাপন করার জন্য।

কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশে নাটক হত দারুণ সব গল্প ভাবনায়। যেখানে নিজের মনের কথা টিভি পর্দায় দেখা যেত। যেখানে সম্মান শেখানো হত। ভালোবাসতে শেখানো হতো। জীবনে প্রতিকূল পরিবেশ আসতে পারে, সেটা মোকাবেলার পথ ও উৎসাহটাও দেখানো হত। দর্শক বেছে নিতে পারত রোমাঞ্চ আর বিনোদনে ভরপুর সিনেমা দেখবে নাকি শান্ত পরিবেশে ঠান্ডা হয়ে নাটক দেখবে।

মনে পড়ে যখন নব্বইয়ের দশকে ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ প্রচারিত হত তখন আমি খুবই ছোট। স্মৃতিতেও আসে না কতটুকু ছিলাম। নাটকটির কথা মনেও নেই। তবে এটুকু মনে ছিল ‌‌‘বাকের ভাই’ নামটি। গুগল সার্চ করে লেখা লাগল, ‘বদি’র আসল নাম হচ্ছে আবদুল কাদের। কারণ আমাদের বাড়িতে তাকে দেখলেই বলা হতো ‘এই বদির জন্যই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছে।’

Advertisement

যাই হোক বড় হয়ে যখন নাটকটি দেখলাম তখন হলো আরেক বিপত্তি। পুরো নাটকটি কাজের ফাঁকে দেখতে লাগল তিনদিন। আর ঘুমাতে পারলাম না প্রায় এক মাস। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম বিনা দোষে বাকের ভাইয়ের সাজা হচ্ছে। মোনা (নাটকের নায়িকা) একেবারে একা হয়ে গেছে। স্বপ্নের ভেতর বাকের ভাইকে জেল থেকে বের করার কত যে ফন্দি করতে লাগলাম। ভালোবাসার মানুষকে (বাকের ভাই) চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখার পর যখন ঘুম থেকে উঠতাম, বুঝতাম নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর আর সাহস হয়নি ল্যাপটপে নাটকটি আবার দেখার।

দুঃখিত অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য। ছিলাম ‘বড় ছেলে’ প্রসঙ্গে। বলতে চাচ্ছিলাম নাটকের কাহিনি, ভাষা আর আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে। এরপর আসল গ্রামের কিছু চরিত্র নিয়ে নাটক। একেবারে ‘আইছস-গেছস’ ভাষার নাটক। অথবা প্রেমের নাটক যেখানে নায়ক-নায়িকা বড় রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে। একে অপরকে দামি দামি উপহার দেবে। চিৎকার করে ঝগড়া করবে। ‌‘ব্রেক আপ’ করবে। তারপর নাটকীয়ভাবে আবারও এক হবে।

নাটকগুলো জনপ্রিয় হলো। তারপর শুরু হলো এ সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। আর দর্শক বিশেষ করে তরুণ দর্শক অন্য কিছু না পেয়ে সেটাকেই কখন যেন নিজের জীবনের অংশ বানিয়ে নিল। তাদের মুখের ভাষা হয়ে গেল, ‍‘খাইছো তুমি’। মেয়েরা আশা করতে থাকল তারাও দামি দামি রেস্তোরাঁকে ডেটিং প্লেস বানাবে। বান্ধবীকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন উপহার দেখাবে। আর যেসব ছেলে এসব মেয়ের এতসব চাহিদা পূরণ করতে পারবে না ভেবে প্রেম করতে ভয় পায় তারা শুরু করল হাপিত্যেশ আর হতাশার বড় বড় কথা বলে বেড়ানো।

কিন্তু এগুলো আসল কোথা থেকে? আমি কেবল নাটক কিংবা কেবল সিনেমাকে দোষ দিচ্ছি না। শুধু এটুকু বলার চেষ্টা করছি কোথাও না কোথাও তো সমস্যা হচ্ছে। ভাইরাস তো অবশ্যই ঢুকেছে কারো না কারো সংস্পর্শে। এসব আমাদেরই সাড়াতে হবে। অন্ততপক্ষে আমরা গণমাধ্যম আমাদের দায়িত্বটা না ভুলে যাই। কেবল সমাজে কী হচ্ছে সেটাই হুবহু না তুলে ধরে কী হতে পারত সেটাও দেখাই। দর্শক কোনটা নেবে সেটা তারাই ঠিক করুক। তারা নিষ্ক্রিয় নয়।

Advertisement

আমি বলছি না এটা নাটকের ভাষাগুলো আমাদের ভাষা না কিংবা আমাদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে না। কিন্তু জীবন একেবারে এরকমও না। মুদ্রার অপর পিঠও আছে। যেখানকার ভাষা, গল্প ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্মের সাথে মেলে। জীবন কেবল দামি রেস্তোরাঁ বা প্রাইভেটকারে দিয়াবাড়ি যাওয়া নয়। আবার একইভাবে আমি এখনও দেখিনি গ্রামের মেয়েরা স্কুল-কলেজ বাদ দিয়ে লিপিস্টিক ও কাজল মেখে কাঁঠাল তলায় বসে গল্প করে।

জেলা শহরেও এটা সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে ঢাকায় এটা কমন দৃশ্য। তাহলে ঠিক কোন প্রতিচ্ছবি আমরা উপস্থাপন করছি? টিভি কিংবা ইউটিউবে দেখা নাটকের বড় একটা দর্শককে আমরা কী দেখাচ্ছি? এটা কি আমাদের ভাবা উচিত নয়?

এ লেখায় ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্মের নাম ব্যবহার করা হয়েছে এর মানে এই না যে এটা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। এখানেও অনেক সংকট আছে। কাহিনি, অভিনয় সবকিছুই হয়তো আরও ভালো করা যেত। কিন্তু সেটা বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি সামান্য এক দর্শক। একজন সাধারণ মানুষ। সাধারণ জীবনযাপন করি। আর তাই সাধারণ ঘটনা কিংবা সাধরণ গল্প দিয়েই আমার জীবন সাজানো। সাধারণভাবেই কথা বলি।

তাই যখন সাধরণ কোনো কিছু দেখি বা কাউকে সাধারণভাবে কথা বলতে দেখি তখন সেটা আমার গ্রহণ করতে সহজ হয়। সেটা অবশ্য সবার ক্ষেত্রে সমান নাও হতে পারে। দেশের টিভি নাটক ও টেলিছবির জৌলুস ফেরাতে এইসব সহজ ভাষার নির্মাণ অনেক ফলপ্রসূ হতে পারে বলে বিশ্বাস করি।

প্রসঙ্গত, মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত এই টেলিছবিতে প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন অপূর্ব ও মেহজাবিন চৌধুরী। এটি প্রচার হয়েছে এনটিভিতে।

নাটকটি ইউটিউবে দেখতে ক্লিক করুন :

এফএ/এলএ