যারা ঢাকা বা এর আশেপাশে থাকেন; তারা খুব সহজেই ঘুরে আসতে পারেন ময়মনসিংহে অবস্থিত প্রকৃতিকন্যা খ্যাত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাস থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত করবে। তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন আজই।
Advertisement
কৃষি জাদুঘর৬২০ বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট অষ্টভুজ মিউজিয়ামটি। এ সুদৃশ্য ভবনের মধ্যবর্তী অংশ সূর্যালোকের জন্য উন্মুক্ত রেখে প্রবেশ লবি ও অফিসের জন্য একটি করে মোট ২টি অফিস রুম এবং প্রদর্শনীর জন্য ৬টি সুসজ্জিত ও মনোরম কক্ষ রয়েছে। প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত এই মিউজিয়ামটি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র কৃষি মিউজিয়াম।
‘কৃষি মিউজিয়াম’ নামে এই জাদুঘরে বাঁশ ও বেতের তৈরি টুকরি, ওচা, মাথলা, ঝুড়ি, টুরং, কুরুম, তেরা, খালই, গরুর ঠোয়া, হুক্কা, চালুন, কুলা ও ডুলি সংরক্ষণ করা হয়েছে। আরও আছে লাঙল, জোয়াল, মই, কোদাল, দা, নিড়ানি, কাস্তে, ঢেঁকি, পলো, চেং, বাইর, উড়ি ও সানকি।
বিজয়পুরের চীনা মাটি, এঁটেল মাটি ও দো-আঁশ মাটিসহ আরও নানা ধরনের মাটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরে। বিভিন্ন ধরনের সারের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ধান, পাট, ডাল, ছোলা, সরিষা, টমেটো, বাদামও সংরক্ষণ করা হয়েছে। আরও আছে বিভিন্ন জাতের শস্যবীজ, বিলুপ্ত প্রায় মাছ। সংরক্ষণ করা হয়েছে মাটি পরীক্ষার সামগ্রী, ইনসেক্ট কালেক্টিং বক্স ও পাহাড়ি চাষাবাদসহ কৃষি কাজের বিভিন্ন মডেল। আছে অজগরসহ নানা বন্যপ্রাণীর কংকাল। শনিবার ছাড়া সপ্তাহে প্রতিদিন সকাল ৯টা-বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রদর্শনীতে কোন টাকা নেওয়া হয় না।
Advertisement
মৎস্য জাদুঘরনয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের পশ্চিম দিকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে দ্বিতলবিশিষ্ট জাদুঘরটি সংগ্রহ ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ মাছের জাদুঘর। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় জাদুঘরটিতে সজ্জা ও মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে ভ্রমণের আকর্ষণীয় কিছু স্থান : শেষ পর্ব
দোতলায় জাদুঘরটি মূল সংগ্রহশালা অবস্থিত। জাদুঘরটিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আপনি প্রথমেই দেখবেন বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত মাছের তালিকা, সিঁড়ির নিচে বহু পুরাতন বাঁশের মোথা, বাবুই পাখির বাসা, মাছ ধরার যন্ত্রপাতি।
জাদুঘরটি মোট চারটি সুপরিসর গ্যালারিতে প্রদর্শিত। প্রতিটি মাছের চিত্রের একটি ক্যালেন্ডার সাথে মাছটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও বৈজ্ঞানিক নাম রয়েছে। ক্যালেন্ডারটির নিচেই ফরমালিনের কাচের পাত্রে রয়েছে উপরের চিত্রে প্রদর্শিত মাছটি। ফলে শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীরা সহজেই মাছটি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করতে পারবে।
Advertisement
পূর্বপাশের ১ম গ্যালারিতে রয়েছে সিপ্রিনিফরমিস বর্গের ৮৭ প্রজাতির মাছ। এরমধ্যে রয়েছে ৮১ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ। গ্যালারিতে মাছের মধ্যে রয়েছে কার্প, রুই, কাতলা, মৃগেল, মলা, ঢেলা, কালিবাউস, বউ, মহাশোল প্রজাতির মাছ। এখানে জাপান থেকে আনা শতবর্ষী কচ্ছপের কঙ্কালও রয়েছে।
দ্বিতীয় গ্যালারিতে সিলুরিফরমিস বর্গের মাছের অবস্থান। যারা ক্যাটফিশ নামেও পরিচিত। এসব মাছে বিড়ালের গোঁফের মত বার্বেল থাকায় এ নামকরণ করা হয়েছে। এখানে ১৩টি পরিবারের ৬১ প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৫৩টি প্রজাতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখানে বোয়াল, মাগুর, শিং, টেংরা, পাবদা, বাতাসি, আইর, বাঘাইর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য প্রজাতির মাছের দেখা মিলবে।
অপর গ্যালারিতে পার্সিফরমিস বর্গের ২২টিঁ পরিবারের ৫৪টি প্রজাতি রয়েছে। এখানে কই, চান্দা, বেলে, খলসে, ভেটকি, টাকি, শোল মাছের দেখা মিলবে। প্রধান তিনটি বর্গ ছাড়াও বাংলাদেশে আরো দশটি বর্গ রয়েছে।
স্বাদু পানির শুশুক ও অন্যান্য মাছ নামক গ্যালারিতে রয়েছে ৫০টি প্রজাতির মাছ। এদের মধ্যে ইলিশ, চিতল, ফলি, কানপোনা, চাপিলা, কাকিলা, কাচকি, পটকা, বাইন মাছ সুপরিচিত। এছাড়া এখানে ২৮ বছর বয়সের ১৯৯ সেন্টিমিটার লম্বা একটি শুশুকের কঙ্কাল রয়েছে।
সর্বশেষ চতুর্থ গ্যালারিতে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিলুপ্ত মাছ ও অন্যান্য প্রাণির জীবাশ্মের সংগ্রহ। স্টারলি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে যুক্তরাজ্য থেকে এই চমৎকার জীবাশ্মগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গ্যালারিতে ৪০টি জীবাশ্ম ও কঙ্কাল রয়েছে।
জাদুঘরটি সপ্তাহে দুইদিন শুক্রবার ও শনিবার সকাল ৮টা-১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এটা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং প্রদর্শনীর জন্য কোন টিকিটের প্রয়োজন হয় না।
জার্মপ্লাজম সেন্টারউদ্ভিদের অন্যান্য সংগ্রহশালা, এটি গবেষণায় বিশ্বের মধ্যে প্রথম এবং আয়তনে দ্বিতীয়। প্রায় ১১ হাজার ফলের প্রজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে জার্মপ্লাজম সেন্টারটি গত ২২ বছরে ৬৭টি ফলের নতুন জাত আবিষ্কার করেছে।
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিকৃষি বিষয়ক বই সংগ্রহের বিচারে এশিয়ার বৃহত্তম লাইব্রেরি। পুস্তক সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ১২ হাজার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনতলা বিশিষ্ট এই ভবনে একটি সাইবার কক্ষ রয়েছে।
ভেটেনারি ক্লিনিক প্রশিক্ষণ, পশু চিকিৎসা সেবা প্রদানের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম পশু চিকিৎসালয়।
প্লান্ট ডিজিজ ক্লিনিকউদ্ভিদের রোগ নির্ণয়, গবেষণার কাজে ব্যবহৃত এই ক্লিনিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম উদ্ভিদ চিকিৎসালয়।
নদের পাড়পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রধান সড়কের বাম পাশের পুরোটাই নদ। তাই নদের পাড় হাঁটতে হাঁটতে আপনি ক্লান্ত হতে পারেন। পাড় ঘেঁষে ইটের মেঠোপথ, মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চ রয়েছে। ইচ্ছা হলে বিকেলটা নৌকায় কাটিয়ে দিতে পারেন।
অন্যান্যআপনি চাইলে ঈশা খাঁ লেকের পাড়ে বসে থাকতে পারেন। ক্যাম্পাস চত্ত্বরে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। রেল লাইনে আনমনে আপনজনের হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটতে পারেন। অথবা লিচু বাগান, হর্টিকালচার সেন্টার, আম বাগান, কলা বাগানের রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়াতে পারেন নির্বিঘ্নে। লালন চত্ত্বর, বঙ্গবন্ধু চত্ত্বর ফ্যাকাল্টির করিডোর বা নদের পাড়ে বসে বসেও সুন্দর সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন।
আরও পড়ুন- প্রকৃতির মায়ায় জড়ানো মহামায়া ইকো পার্ক : শেষ পর্ব
খাওয়া-দাওয়াবিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে জব্বারের মোড়, রেল লাইন, কেআর মার্কেট, করিম ভবনে রয়েছে অনেক খাবার হোটেল। এসব হোটেলে মাছ, মাংস, ভর্তা, খিচুড়ি সব পাবেন স্বল্পমূল্যে। টিএসসিতেও খেতে পারেন। এছাড়া ক্যাম্পাসের সাথেই ফসিলের মোড়, রেশষ মোড়ে পাবেন অনেক দোকান। চাইলে বাড়ি ফেরার সময় ময়মনসিংহ শহর থেকে স্পেশ্যাল মালাইকারি নিয়ে যেতে পারেন। মালাইকারির জন্য মা-মণি সুইটস এবং কৃষ্ণা কেবিন বিখ্যাত।
যেভাবে আসবেনমহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বেশ কয়েকটি বাস ছেড়ে যায় প্রতি ১৫-২০ মিনিট পর পর। সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। গাড়িতে আসলে ভাড়া নেবে ১২০-২২০ টাকা। এছাড়া আপনি ট্রেনেও যেতে পারেন। ময়মনসিংহ এসে মাঝকান্দা বা ব্রিজ মোড় নামিয়ে দেবে। মাঝকান্দা থেকে ক্যাম্পাসে আসতে অটোতে লাগবে সর্বোচ্চ ২০ টাকা করে। ব্রিজ মোড় থেকে অটোতে নেবে ১০ টাকা করে।
যেখানে থাকবেনক্যাম্পাসের কাছেই ময়মনসিংহ শহরে গঙ্গাদাস গুহ রোডে হোটেল আছে। ভাড়া নেবে সিঙ্গেল ৫০০ টাকা, ডাবল ৮০০ টাকা। ভালো হোটেলে ভাড়া ১৬০০ টাকা থেকে শুরু। হোটেল এসি ডাবল রুম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, সিঙ্গেল ১ হাজার ২০০ টাকা, নন-এসি ডাবল ৮০০ টাকা, সিঙ্গেল ৫০০ টাকা। এছাড়া একটি হেটেলে এসি ডিলাক্স ২ হাজার ৫০০ টাকা, এসি ডাবল ১ হাজার ৭৫০ টাকা, সেমি ডাবল ১ হাজার ৪৫০ টাকা, সিঙ্গেল ১ হাজার টাকা, নন-এসি ডাবল ১ হাজার ১০০ টাকা, সিঙ্গেল ৫০০ টাকা। তবে ডাবল রুমে ১৫%, সিঙ্গেল রুমে ১০% ডিসকাউন্ট রয়েছে। আরো কম টাকায় থাকতে চাইলেও হোটেল রয়েছে।
এছাড়া ক্যাম্পাসে বিনার ডরমেটরি, বিএফআরআই ডরমেটরি, গেস্ট হাউজ, জার্মপ্লাজম চাষী ভবন, টিআই ডরমেটরি। যোগাযোগ করে ক্যাম্পাস চত্ত্বরে ও মনোরম পরিবেশে স্বল্পমূল্যে থাকতে পারেন। জিটিআই ডরমেটরিতে প্রতি কক্ষ ৩০০ টাকা থেকে শুরু।
মো. শাহীন সরদার/এসইউ/পিআর