ঘটনাটা গত বছর কোরবানির একটি হাটের অর্থাৎ ২০১৬ সালের। আব্দুল গফুর (ছদ্মনাম) এর বয়স সত্তরের উপর। সাতক্ষীরা থেকে খুলনার একটি হাটে এসেছিলেন দুইটি গরু নিয়ে। সাথে তার বড় নাতি। কোরবানির হাটে গরু দুইটি বিক্রি করবেন বলে বাড়তি যত্ন নিয়েছিলেন প্রায় ছয় ধরে। প্রথম গরুটি বিক্রি করার পর গরু বিক্রির ৭৫,০০০ টাকা বাড়ি (সাতক্ষীরা) যেয়ে রেখে আসে। ঈদের আগের দিন রাতে দ্বিতীয় গরুটি ৬১,০০০ টাকায় বিক্রি করে দাদা-নাতি বাড়ি চলে যায়।
Advertisement
ঈদের দিন সেই ৬১,০০০ টাকা থেকে প্রতিবেশীর ধারের ১০,০০০ টাকা শোধ করতে গেলে বিপত্তি বাধে। কারণ ৬১,০০০ টাকার মধ্যে ১,০০০ টাকার ৮টি নোট জাল ছিল। তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার জন্য গরু বিক্রির টাকা ভালো করে দেখে নিতে পারেন নি। ফলে ৮,০০০ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল দরিদ্র কৃষক পরিবারটিকে। ঈদের আনন্দটুকুও মাটি হয়ে গেল। কতখানি অধঃপতন আমাদের! কোরবানির টাকার মধ্যেও জাল টাকা দিচ্ছি।
বড় নোটের ক্ষেত্রে জাল করার ঘটনাগুলো বেশি ঘটে থাকে। এজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ১০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংবলিত আসল ব্যাংক নোটের কিছু সহজ বৈশিষ্ট্য, যা খালি চোখে দ্রুত বোঝা যায়, আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন-
কাগজ : নোটটি সিনথেটিক ফাইবার মিশ্রিত অধিক টেশসই কাগজে মুদ্রিত।
Advertisement
ইন্টাগ্লিও লাইন : নোটের ডানদিকে আড়াআড়িভাবে ইন্টাগ্লিও কালিতে ৭টি সমান্তরাল লাইন আছে।
অসমতল ছাপা : নোটের সামনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুদ্রিত।
অন্ধদের জন্য বিন্দু : ১০০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৫টি ছোট বিন্দু; ৫০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৪টি ছোট বিন্দু এবং ১০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য ৩টি ছোট বিন্দু রয়েছে যা হাতের স্পর্শে উচু নিচু অনুভূত হবে।
রং পরিবর্তনশীল হলোগ্রাফিক সুতা : নোটের বাম পাশে ৪ মিলিমিটার চওড়া নিরাপত্তা সুতা; যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের লগো ও ১০০/৫০০/১০০০ টাকা লেখা আছে; সরাসরি দেখলে লগো ও ১০০/৫০০/১০০০ টাকা সাদা দেখাবে; কিন্তু পাশ থেকে দেখলে বা ৯০ ডিগ্রিতে নোটটি ঘোরালে তা কালো দেখাবে।
Advertisement
জলছাপ : কাগজে জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি; প্রতিকৃতির নিচে অতি উজ্জ্বল ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপে ১০০/৫০০/১০০০ লেখা আছে এবং জলছাপের বামপাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের উজ্জ্বলতর ইলেক্ট্রোটাইপ জলছাপ রয়েছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড মুদ্রণ : ১০০/৫০০/১০০০ টাকার নোটের সামনের দিকে পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা অফসেটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ রয়েছে।
নোটের পেছন ভাগ : ১০০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতীয় সংসদ ভবন মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ৫০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে বাংলাদেশের কৃষি কাজের দৃশ্য মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ১০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে ঢাকার তারা মসজিদ মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙ্গুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে।
রং পরিবর্তনশীল কালি: ১০০০/১০০ টাকার ডানদিকের কোণায় ১০০০/১০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালী এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে। ৫০০ টাকার ডানদিকের কোণায় সরাসরি তাকালে ৫০০ লেখাটি লালচে এবং তির্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে।
তথ্য মতে, ঢাকা ও আশপাশের জেলায় জাল টাকা তৈরির ৩০ চক্র তৎপর হয়ে আছে। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশির ভাগ র্যা ব-পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর জামিনে মুক্ত হয়ে জাল টাকার জাল বিস্তার করছে। তাদের তৈরি কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের জাল নোট অর্ধ শতাধিক দলের মাধ্যমে এরই মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট ২০ হাজার ৭৯০টি জাল নোট ধরতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্ধারকৃত নোটের মধ্যে ১০০০ টাকা মূল্যমানের জালনোটের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭৮০টি ।
‘সহজেই জাল টাকা সনাক্ত করবেন যেভাবে’ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে কিছু সহজ উপায় উল্লেখ করা হয়েছে। জাল টাকার টাকার নোটগুলো নতুন হবে। কারণ জাল টাকার নোটগুলো সাধারণ কাগজের তৈরি; তাই পুরাতন হয়ে গেলে সেই নোট নাজেহাল হয়ে যায় বা তা অতি সহজেই বোঝা যায়। জাল টাকার নোট ঝাপসা দেখায় । আসল নোটের মত ঝকঝকে থাকে না। সেটা নতুন হোক আর পুরাতন হোক এবং কিছুটা পাতলা বা হালকা ধরনের যা একজন আরেকজনের কাছ থেকে টাকা লেন দেন করার সময় একটু মনযোগ সহকারে দেখলেই বোঝা যায়।
জাল নোট হাতের মধ্যে নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলে তা সাধারণ কাগজের মতো ভাঁজ হয়ে যাবে। আর আসল নোট ভাঁজ হবে না। যদিও সামান্য ভাঁজ হবে তবুও তা জাল নোটের ক্ষেত্রে তুলনামূলক অনেক বেশি। টাকা সবসময় দুটি অংশ দিয়ে তৈরি হয়। টাকার দুই পার্শে দুটো নোট জোড়া লাগানো থাকে এবং এটা হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি বলে পানিতে ভেজালেও খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে না। আর জাল নোট পানিতে ভেজানোর সাথে সাথেই তা ভেঙে যাবে। আসল নোট সবসময় খসখসে হবে ।
জাল নোট সনাক্ত করতে হলে আমাদের আসল নোটের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা দরকার। প্রত্যেকের সচেতনতা বাড়াতে হবে। জাল নোটের সম্পৃক্ত সকলেই জঘন্যতম কীট। দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক জাল নোট সরবরাহের কাজে লিপ্ত এই চক্রের কড়াল গ্রাস থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে প্রিয় বাংলাদেশকে।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।riazul.haque02@gmail.com
এইচআর/এমএস