মতামত

রোহিঙ্গা : অনিকেত পরিচয়

সুবর্ণগ্রামে মানুষ এসে ভিড় করছে। নদী পেরিয়ে সুবর্ণগ্রামে আসছে যারা, তারা যেন ইহলোকের স্বর্গে পৌঁছতে চায়। নিজেরা যে ভূমিতে থাকে, সেখানকার তারা ভূমিপুত্র ঠিকই, কিন্তু ঐ ভূমির নাগরিক নন। তাই তারা এসময় এক গ্রামের খোঁজে ছুটে আসছে যেখানে আছে স্বর্গসুখ। নাফ নদী যেনো তাদের কাছে সুবর্ণরেখা। সেই রেখা পেরোলেই ইহলোকের স্বর্গগ্রাম।

Advertisement

পূর্বদিকের যে আরাকান বা রাখাইন অঞ্চল বা মংডুতে তাদের বসবাস, সেখানে তারা সংখ্যালঘু। ধর্মীয়, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ভাবে। সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের ঐ ভূমি থেকে উৎখাতের উদ্যোগ নেয়া হয় ষাটের দশকের গোড়াতেই। তখন থেকেই সরকারি ভাবে মিয়ানমার বা আদি বার্মা মুলুকে যে ৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি আছে সেখানে তাদের অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেই সময় থেকেই সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক ভাবে তাদের অনিকেত প্রান্তরে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি গুলোকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একাট্টা করা হয়। রোহিঙ্গারা যখন ভূমিতে তাদের অধিকার বা নাগরিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামে, তখন তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদ্রোহী গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যা সহজ হয় এই জাতি গোষ্ঠীকে উৎখাতের উদ্যোগে। ষাটের দশক থেকে নানা সময়ে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা নাফের পূর্বপাড় থেকে পালিয়ে এসেছে। এবারই এসেছে প্রায় সোয়ালাখ রোহিঙ্গা। আশির দশকের আগে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা এপারে এলেও তারা ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু আশির পর থেকে যখন আসা শুরু হয়, তখন আর খুব একটা ফিরে যাওয়া হয়নি। তারা শরণার্থী হিসেবে নাফের পশ্চিম পাড় অর্থাৎ বাংলাদেশে রয়ে যায়। প্রায় স্থায়ী আবাস তারা গড়ে তুলেছে এবং মূল জনগোষ্ঠির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে তারা।

এখন যারা আসছে, তারা আজও ভাসমান। সীমান্ত এলাকার পথে পথে তারা স্রোতের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। ওপার থেকে কেউ মাইনের আঘাতে, কেউ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আসছে। একটি বড় সংখ্যার মানুষ নাফ পাড়ি দিতে গিয়ে জলে ভেসেও গেছে। যারা আসছে তাদের বড় অংশ শিশু ও নারী। পুরুষও আসছে, তবে সংখ্যায় আনুপাতিক হারে কম।কারণ পুরুষদের অনেকে ওপারে রয়ে গেছে আরাকানে নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে।

Advertisement

বলছিলাম রোহিঙ্গারা আসছে বাংলাদেশকে সুবর্ণগ্রাম মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশতো তাদের জন্য সুবর্ণগ্রাম হয়ে উঠতে পারেনি। পারবেওনা। কারণ দেশটি নিজেই জনসংখ্যার আধিক্যে আক্রান্ত। এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে অস্থায়ী শরণার্থী হিসেবে হয়তো সাময়িক জায়গা করে দিতে পারবে। কিন্তু তাদের আহারের যোগান, স্থায়ী বসত ও শিক্ষা দেবার সাধ্য বাংলাদেশের নেই। তারচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে গত কয়েক দশকে এই রোহিঙ্গারা জীবিকার প্রয়োজনে, বাঁচার দায়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের খুব অল্প টাকাতেই মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, পেশাদার খুনি, বেশ্যা বৃত্তির জন্য খরিদ করা যায়।শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা ঐ জনগোষ্ঠিকে কয়েক দশকে এমন কাজের সঙ্গেই বেশি জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে।

এরা যে স্থানীয় মৌলবাদী বা জঙ্গি গোষ্ঠির সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে না তা নয়। খুব তরল ভাবেই সেটা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের দিক থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চল আমাদের পর্যটন এলাকা। রোহিঙ্গারা এই এলাকাতে স্থায়ী আবাস গড়লে, এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য নষ্ট হবে, পর্যটকদের আকর্ষণ কমে যাবে। ফলে পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারসাম্য নষ্ট হবে পরিবেশেরও।

ভেবে দেখার আরেকটি দিক হচ্ছে টেকনাফ-কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার অংশীদার হবে রোহিঙ্গারা। এতে স্থানীয় মানুষের জীবন মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আগে থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সেই প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য যে সুবর্ণগ্রাম নয়, একথা তারা আগেই জেনে গেছে। তারপরও তাদের ছুটে আসছে। কারণ ওপারে মনে হয় এখন থেমে গেছে স্বাভাবিক মৃত্যুও। বিদ্রোহী দমনের নামে সাধারণ মানুষেরাও নির্বিচার হত্যার শিকার হচ্ছে।

রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে নিজের বসতিতে এটা স্বাভাবিক। নিজের এক রত্তি ভিটের প্রতিও মানু্ষের টান প্রবল। কিন্তু তাকে ফেরত নিচ্ছে কে? এরই মধ্যে মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জানিয়ে দিয়েছেন- নাগরিকত্বের প্রমাণ না থাকলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে না। যারা এই গোষ্ঠিকে নাগরিক হিসেবেই মানতে না নারাজ, তাদের কোন প্রমাণে তুষ্ট করা যাবে? বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে জায়গা দিয়েছে। কিন্তু তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দরকষাকষিতে খুব কি এগুতে পারবে? কারণ ভারত-চীন যেখানে মিয়ানমারের পাশে! জাতিসংঘ বরাবরের মতোই পর্যবেক্ষণ এবং বিবৃতি দিয়ে তার সামর্থ্য দেখিয়েছে। আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী ও যুদ্ধবাজ দেশ গুলো সমুদ্রসীসীমার সম্পদের হিসেব নিকেশ দেখছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ থাকবে হয়তো। কিন্তু সবকিছুর ভাগ শেষ- রোহিঙ্গারা রইবে দেশহীন হয়েই।

Advertisement

লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি।

এইচআর/পিআর