মি. আন্তিনিও গুতেরেস শুভ সকাল মি. গুতেরেস। ঘুম থেকে উঠুন। আপনি ঘুমিয়ে আছেন নাকি জেগে? জেগে জেগে আর কত ঘুমাবেন মি. গুতেরেস! চোখ মেলে একবার তাকান বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে। বাংলাদেশ সীমান্তের ঠিক উল্টোদিকেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কী ঘটছে একবার দেখুন চোখ খুলে। এতো আপনারই দায়িত্ব। বিশেষত এই নিখিল চরাচরের প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্র এবং সেসবের নাগরিকবৃন্দ যখন তাদের বিপদে-সম্পদে আপনাকেই পাশে চায় তখন আর জেগে জেগে ঘুমাবেন না।
Advertisement
অসহায় মানুষ ভরসা পাওয়ার আশায় আপনার প্রতি তাদের দৃষ্টি প্রসারিত রাখে সর্বদা। সুখের দিনে না হোক অন্তত দুঃখের দিনে চরমতম দুঃখের দিনে বিপদগ্রস্ত নাগরিকেরা আপনার এবং আপনার সংস্থাটির কার্যকারিতা দেখবার জন্য চাতকের মত অপেক্ষায় অধীর। স্ব-স্ব বিপদ থেকে আশুমুক্তির জন্য আপনার প্রতিই তারা উন্মুখ হয়ে আছে। আপনি তাদের ঠিক দেখভাল করছেন না। একজন বিশ্বমুরব্বি হওয়া সত্ত্বেও সকলের প্রতি আপনার ন্যায়ের চোখ সমান বিস্তৃত নয়। অর্থাৎ কিছু মনে করবেন না মি. গুতেরেস, সেক্ষেত্রে আপনাকে একচোখাও বলা যেতে পারে!
আজন্ম দেখে আসছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উত্ত্যক্ত করার জন্য উত্তর কোরিয়া মাঝেমধ্যেই নানা রকমের হুংকার ছড়ায়। এ হুংকার প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তাদের নিজদেশে উৎপন্ন অস্ত্র-শস্ত্রের কি কি উন্নয়ন ঘটেছে তার প্রকাশ মাত্র। আর মার্কিনিরা কল্পিত আক্রমণের আশংকায় প্রস্তুতির চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া জানাতেও বিলম্ব করে না। এদুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিরাজিত স্নায়ুযুদ্ধ সপ্রকাশ হওয়ার কল্পিত শংকা থেকে অনুষ্ঠিত হতে থাকে বিশ্বব্যাপী আলোচনার আসর এবং বৈঠকের পর বৈঠক। আবার এসব বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে আপনার নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ সর্বাগ্রে হস্তক্ষেপ করে।
সাম্প্রতিককালেও এর নজির দৃষ্ট হয়েছে। অথচ মিয়ানমারে একটি জাতিঘাতী ও সম্প্রদায়ঘাতী হত্যাযজ্ঞ দেখেও না দেখার ভাণ করছেন! একটি জাতিগোষ্ঠীর সমুদয় জনগণকে তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, স্বদেশ ও জন্মভূমিহীন করার লক্ষ্যে সরকারিভাবে খুন ও ধর্ষণের পর দেশ থেকে বিতাড়ণ করা হচ্ছে কিন্তু এরূপ খবরে আপনার সামান্যতম উদ্বেগও দেখা যাচ্ছে না।
Advertisement
শত শত নারী ও শিশুর লাশে নাফ নদীর উত্তাল ঢেউ বাংলাদেশের বুকে আছড়ে পড়লেও আপনার দৃশ্যগোচরের বাইরেই থেকে যাচ্ছে মৃতদের মিছিল! নিষ্পাপ মানবশিশুর শতশত বিগলিত লাশ বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোড়ন তুললেও জাতিসংঘের দুর্গ পেরিয়ে আপনার গায়ে তার ‘মৃদু’ হাওয়া পর্যন্ত লাগছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আপনি যে-কোন মানের একটি সভা পর্যন্ত আহ্বানের প্রয়োজন মনে করছেন না। মাত্র একটি জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভার যে সংস্থা নিতে পারে না তার ওপর বিশ্বের সমগ্র জাতির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে! আর আপনি হয়েছেন সেই সংস্থার ‘অধিপতি’!
একা জাতিসংঘই রোহিঙ্গাকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। অথচ এই নির্যাতিতদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা জাতিসংঘ কখনোই করেনি। আপনারতো ভালো করেই জানা যে, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) দায়িত্ব হলো কোন দেশের সরকারের অনুরোধে স্বদেশহীন, জন্মভূমিচ্যুত, বিতাড়িত, বাস্তুহারাদেরকে রক্ষা করা। তাদের অবস্থানকে সমর্থন করাসহ স্বদেশ, নিজ জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যথোপযুক্ত পুনবার্সনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু ইউএনএইচসিআর কার্যত বাংলাদেশে আশ্রিত ইতোপূর্বেকার প্রায় পাঁচ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে কথিত ত্রাণ বিতরণের মধ্যেই নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছে। বাস্তুহারা স্বভূমিচ্যুত লাখ-লাখ রোহিঙ্গাকে নিজদেশে ফিরিয়ে নেবার কোন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
সাম্প্রতিককালের রোহিঙ্গা ইস্যুতেও ইউএনএইচসিআর-এর নীরব অবস্থান আমাদের কেবলই ব্যথিত করছে। শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপনের এই দৃশ্য মানবিকভাবে আমাদেরকে পর্যুদস্ত করছে আবেগগতভাবেও আমাদের বিমর্ষ করছে। পাশাপাশি, বৈশ্বিক ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে দেউলিয়াপনার এক প্রান্তসীমায় হয়তো নিজেদের আবিষ্কার করা সম্ভব হবে এর বেশি কিছু নয়! বিভিন্ন আলোচনায় শোনা যায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আবেগ এবং মানবিকতার চেয়ে নাকি রাজনৈতিক কৌশলের বেশি প্রয়োজন। সেতো খুবই সত্যি। রোহিঙ্গা ইস্যুকে ‘সোনার ডিম দেওয়া হাঁস’ বলেও ব্যাখ্যা আছে। তাই কৌশলেই সমস্যার সমাধান হোক। কিন্তু চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, শতশত রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর লাশ রেখে কৌশলী হতে সময় ক্ষেপন মানেই শরণার্থী ও লাশের সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া কিছুই নয় একথা মনে রাখতে হবে।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে রোহিঙ্গা বিষয়ক কফি আনানেন নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের রিপোর্ট জমাদানের পরদিন ভোর থেকেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে রাখাইন রাজ্য। বিগত প্রায় দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আবারো প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। তাছাড়া, সরকারি বাহিনীর হাতে রাখাইনে মৃতের সংখ্যাও প্রায় হাজার বলে জানা যায়। যদিও সরকারিভাবে এর মধ্যে ‘৩৭০জন জঙ্গি’ নিহতের খবর সেদেশের সরকার স্বীকার করেছে। এসব হত্যাযজ্ঞের বাইরেও বাড়িঘর থেকে পালিয়ে বাঁচার সময় নৌকাডুবিসহ নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যাও শতাধিক। নিরাপরাধ শিশু, নারী এবং বয়োবৃদ্ধ নাগরিকের ওপর মিয়ানমার সরকারের এরূপ অত্যাচার, সরকারিভাবে এরূপ মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন বিরল ঘটনা। সরকারিভাবে নিজদেশের জনগণের ওপর এধরনের নিপীড়ন বিশ্বে দেখা যায় না। নিজদেশের সরকারের অত্যাচারের বলি হয়ে পৃথিবীর কোন দেশের মানুষের এমন সারিবদ্ধ লাশের চিত্র দেখার অভিজ্ঞতাও আমাদের বিরল, মানীয় মহাসচিব! ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বর্তমান মিয়ানমারের ‘রোসাং’-এর অপভ্রংশ ‘রোহাং’ (এককালীন আরকান) অঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল থেকে আরো জানা যায়, রাখাইন প্রদেশে পূর্ব ভারত হতে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ বছর পূর্বে অস্ট্রিক জাতির একটি শাখা ‘কুরুখ’ নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে। ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দু, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোঘল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করে। এ সকল নৃগোষ্ঠীর শংকরজাত নরগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা।
Advertisement
প্রকৃতপক্ষে, রোহিঙ্গারাই আরাকানের একমাত্র ভূমিপুত্র জাতি। জানা যায়, ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে কট্টরপন্থী বৌদ্ধ বর্মী রাজা আনাওহতা আরাকান দখলের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করান। মূলত রাখাইনে দুটি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস দক্ষিণে বামার বংশোদ্ভূত ‘মগ’ এবং উত্তরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাদের দস্যুবৃত্তির জন্য ‘মগের মুলুক’ শব্দটির প্রচলন। একদা ঢাকা পর্যন্ত মগদের দৌরাত্ম্য ছিল। মোঘলরা মগদের বিতাড়িত করে পুনরায় জঙ্গলে পাঠায়।
জানা যায়, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহাঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এরাজ্য দখলের পর চরম বৌদ্ধ-আধিপত্য কায়েম হতে থাকে। এরাজ্য ব্রিটিশদেরও দখলে আসে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত সমগ্র মিয়ানমারের একটি জাতিতাত্তি¡ক তালিকা প্রস্তুত হলে সেখানে ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়। ব্রিটিশদের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক বর্ণিত ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রোহিঙ্গা শব্দটি বাদ পড়ে! ফলে ‘ভূমিপুত্র’ হয়েও তারা পরিণত হয় ‘বিদেশি’ অভিধায়! রোহিঙ্গাদের সেই ট্রাজেডির করুণ আর্তনাদ আজও বাংলাদেশের আকাশ-বাতাসকে ভারি করে তুলছে।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। সেসময় রোহিঙ্গাদের জনপ্রতিনিধিও পার্লামেন্টে ছিল। তাছাড়া, বিভিন্ন পদস্থ পর্যায়েও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিত্বের ইতিহাস আছে। এওতো আপনার অবিদিত কিছু নয়। কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তনের ফলে মিয়ানমারের ইতিহাস ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে থাকে। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের জীবনে নবতর ট্র্যাজেডির অনিঃশেষ যাত্রা। এই দুর্ভাগ্যের যেন কোন শেষ নেই! সামরিক জান্তা সরকার রোহিঙ্গদেরকে ‘বিদেশি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং পরে তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে নেয় কেড়ে নেয় তাদের ভোটাধিকার। ধর্মীয়ভাবেও রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় প্রকাশ্য নামাজ পড়ার ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
হত্যা ও ধর্ষণ হয়ে ওঠে নিয়মিত ঘটনা। সহায়-সম্পত্তিও জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। স্বাস্থসেবার সুযোগ নেই, বিয়ে করার অনুমতি নেই, সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার নিবন্ধন পর্যন্ত নেই! রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ হতে থাকে।
এসবইতো আপনার জানা কথা মি. গুতেরেস! রাখাইনের মানুষ স্বল্পশিক্ষিত বলে, সংখ্যালঘু বলে, বাংলা ভাষার সাথে বিশেষত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সাথে তাদের ভাষার সাজুয্য আছে বলে, তারা মুসলমান বলে কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মাতৃভূমিতে বেড়ে ওঠার অধিকার-বঞ্চিত করবে! মাননীয় মহাসচিব মি. গুতেরেস, কোন রাজনৈতিক খেলা চলছে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যে? খুন, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র একটি জাতিকে একটি রাষ্ট্র কেনইবা অস্বীকারের মাধ্যমে বিলীন করে দেবে তা কি আমরা জাতিসংঘের কাছে জানতে চাইতে পারি না? আর ঘুমিয়ে থাকবেন না মি. গুতেরেস, উঠুন। দ্রুত শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে রাখাইনের শান্তি ফিরিয়ে আনুন। আপনার একটি ঘোষণায় সকলের সকাল শুভ হোক।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/আরআইপি