খেলাধুলা

সাড়ে ৩ কোটি টাকার দল কৃষ্ণারা

টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার আগে ১ বছরের প্রস্তুতি- বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়াদলের জন্য এটা অলিক কপ্লনা; কিন্তু সেটাই করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), নারী অনূর্ধ্ব-১৬ দলকে ১২ মাস ক্যাম্পে রেখে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ সামনে রেখে গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ক্যাম্প শুরু হয়েছে নারী ফুটবলারদের। দীর্ঘ এই প্রস্তুতি শেষে কৃষ্ণারা শুক্রবার উড়াল দেবে থাইল্যান্ডের পথে। দেশটির চুনবুরিতে ১০ সেপ্টেম্বর শুরু হবে এশিয়ার ৮ দেশের লড়াই। বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট শুরু হবে পরের দিন বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে।

Advertisement

গত বছর ২৭ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের বাছাই পর্বের ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে থাইল্যান্ডের টিকিট পেয়েছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দল। বাছাই পর্বের প্রতিপক্ষ ইরান, সিঙ্গাপুর, কিরগিজস্তান, চাইনিজ তাইপে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের চেয়ে চূড়ান্ত পর্বের দলগুলো অনেক শক্তিশালী।

এক কথায় পার্থক্য নদী আর সাগরের মতো। সাঁতার কেটে নদী পার হওয়া মেয়েরা যাতে সাগরে ঝাপ দিয়ে তলিয়ে না যায় সেজন্যই বাফুফে তাদের দীর্ঘ অনুশীলন করিয়েছে। থাইল্যান্ডের জন্য কৃষ্ণাদের প্রস্তুত করতে সাড়ে ৩ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে বাফুফের।

বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মহিলা কমিটির চেয়ারপারসন মাহফুজা আক্তার কিরণ বুধবার মেয়েদের বছরব্যাপী প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। ‘গত বছর যখন মেয়েরা বাছাই পর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে নাম লিখিয়েছে তারপরই আমরা পরিকল্পনা করি তাদের বছরব্যাপী অনুশীলনের। কারণ, বাছাই আর চূড়ান্ত পর্বের দলগুলোর শক্তির পার্থক্য অনেক। আমরা কেবল তাদের ঘরেই অনুশীলন করাইনি, ৫বার বিদেশে পাঠিয়ে ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট খেলিয়েছি। মেয়েরা ২বার জাপান এবং একবার করে সফর করেছে সিঙ্গাপুর, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া। এর মধ্যে প্রথমবার জাপান সফরের বিমানভাড়া দিয়েছিল জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (জেএফএ)। বাকি ৪টি সফরের বিমানভাড়া আমাদের দিতে হয়েছে’-বলছিলেন মাহফুজা আক্তার কিরণ।

Advertisement

বাফুফের মহিলা কমিটির প্রধান জানিয়েছেন, মেয়েদের চারবার বিদেশে পাঠাতে বিমানভাড়ায় গেছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার মতো। ক্যাম্প খরচ হয়েছে গড়ে মাসে ৬ লাখ টাকার মতো। এখানে কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ হয়েছে। ক্যাম্প খরচের বিস্তারিত জানাতে গিয়ে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন,‘ক্যাম্পে এখন আছে ৩৭ জন। গড়ে প্রতি মাসে ৩০ জনের বেশি ছিল গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে। মেয়েদের ৩ জন কোচ এবং বাবুর্চি ও তার সহকারী মিলে ৭ জন।’

মেয়েদের কেবল মাঠের অনুশীলনেই রাখেনি, তাদের পড়াশুনার বিষয়টিও দেখেছে বাফুফে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ চারটি বিষয়ে পড়াশুনার জন্য ৩ জন শিক্ষকও নিয়োগ দিয়েছিল বাফুফে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের পরীক্ষা দেয়ারও সুযোগ করে দিয়েছিল দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থাটি। সর্বশেষ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন নারী ফুটবল দলের ৪ জন। ১৪ জন দেবেন জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা।

খরচের বিস্তারিত জানাতে গিয়ে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘মেয়েরা যখন বিদেশে গেছে তখন আয়োজকদের সরবরাহকৃত খাবারের বাইরেও আমাদের নিজস্ব উদ্যোগে কিছু দিতে হতো। এখানে একটা ব্যয় ছিল। প্রতিটি সফরে মেয়েদের পকেটমানি হিসেবে দিয়েছি ৫০ মার্কিন ডলার করে। স্পোর্টস গিয়ার্সের বিষয় তো আছেই। বুট-জার্সিতে বড় খরচটি হচ্ছে থাইল্যান্ড যাওয়া উপলক্ষ্যে। মেয়েদের জন্য ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের স্পোর্টস গিয়ার্স আনা হয়েছে থাইল্যান্ড থেকে।’

চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতি শুরু হওয়ার পর থেকেই মেয়েদের বেতন দিয়ে আসছে বাফুফে সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিনের বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এসএস স্টিল ও এসএস সলিউশন। গত বছর বাছাই পর্বের দলের ২৩ জনকে দেয়া হয়েছে মাসে ১০ হাজার টাকা করে। আর ক্যাম্পের বাকিদের মাসিক বেতন ৩ হাজার টাকা করে। এখানেই খরচ আছে ৩০ লাখ টাকার বেশি।

Advertisement

দীর্ঘ এক বছরের অনুশীলন এবং ৫ বার বিদেশ সফর। এতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে গ্রাম-গঞ্জ থেকে উঠে আসা মেয়েদের? ‘মেয়েদের পরিবর্তনকে আমি দুই ভাগে দেখবো। এক. তাদের মাঠের পারফরম্যান্সের পরিবর্তন এবং দুই. তাদের বাহ্যিক আচরণের পরিবর্তন। দুই বিভাগেই মেয়েদের ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। ফুটবলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফিটনেস। যেখানে আমরা অনেক পিছিয়েছিলাম। এখন ফিটনেস অনেক ভালো মেয়েদের। মেয়েরা এখন ৯০ মিনিট একতালে খেলতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মেয়েরা এখন বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আচরণেও এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। ইংরেজিতে কথা বলা থেকে শুরু করে বিদেশ সফরে কখন, কোথায় কী করতে হবে সেটা এখন ভালোভাবেই বোঝে মেয়েরা। এ দলটির সঙ্গে আমি কোন দেশ সফর করিনি। তবে আমার দুই কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ও মাহবুবুর রহমান লিটুর মাধ্যমে সব সময় মেয়েদের খবর রেখেছি। বিদেশে প্রতিটি ম্যাচের আগে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের উপদেশ দিয়েছি। এটা না বললেই নয়, মেয়েদের এভাবে তৈরি করার পেছনে বড় অবদান দুই কোচের।’

চূড়ান্ত পর্বের ‘বি’ গ্রুপে খেলবে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উত্তর কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া বাছাই পর্ব উৎরে এসেছে। উত্তর কোরিয়া ও জাপান সরাসরি খেলছে ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হিসেবে।

বাছাই পর্বের ‘সি’ গ্রুপে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে ইরানকে, ৫-০ গোলে সিঙ্গাপুরকে, ১০-০ গোলে কিরগিজস্তানকে, ৪-২ গোলে চাইনিজ তাইপেকে এবং ৪-০ গোলে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পরাজিত করেছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া বাছাই পর্বের ‘ডি’ গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া ২৮-০ গোলে ফিলিস্তিনকে, ১৪-০ গোলে হংকংকে, ৮-০ গোলে ইরাককে, ৬-০ গোলে ভিয়েতনামকে এবং ৯-১ গোলে উজবেকিস্তানকে পরাজিত করেছে।

আরআই/আইএইচএস/জেআইএম