দেশজুড়ে

থামছে না রোহিঙ্গা আসার ঢল

চেহারা ও গঠন প্রকৃতি বাঙালিদের মতো হওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ফলে স্থল ও জলসীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকছে অসংখ্য নারী-শিশু ও পুরুষ। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকলেও অনুপ্রবেশকারী অনেকে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছেন।

Advertisement

এ পর্যন্ত জাতিসংঘের হিসাবে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বলা হলেও বাস্তবতায় এটি দুই লাখ পার হয়েছে বলে ধারণা সীমান্ত এলাকার লোকজনদের। প্রতিদিন যেভাবে রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষরা আসছে তাতে এ সংখ্যা তিন লাখ ছাড়াতে বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করছেন সীমান্ত সংশ্লিষ্টরা। উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা বস্তির পরিচালকরাও (মাঝি) এ কথা স্বীকার করেছেন।

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের স্থল সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের জামছড়ি ও ঘুমধুম সীমান্তের জিরো পয়েন্টের তিনটি পাহাড়ে অন্তত ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা গৃহপালিত পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তারা সীমান্তের বড়ছনখোলা ভিতরের ছড়া, ছেড়াখালের আগা, আতিকের রাবার বাগান, সাপমারাঝিরি ও নুরুলআলম কোম্পানির রাবার বাগান, ঘুমধুম সীমান্তের জলপাইতলীসহ আশপাশের এলাকায়ও ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে গত শনিবার থেকে অনিশ্চিত জীবন পার করছেন। মিয়ানমারের কাঁটাতার ভেদ করে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তালিকাও কেবল দীর্ঘ হচ্ছে। দৃশ্যমান যারা রয়েছেন তারা যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে আছেন বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

এদিকে, সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের চিত্র ভাইরাল হবার পর যে যার অবস্থান থেকে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে সীমান্তে চলে যাচ্ছেন। মানবতার দায়ে জোটবদ্ধ হওয়া নানা শ্রেণিপেশার মানুষ রোহিঙ্গাদে মাঝে শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণ করছেন। এরপরও অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের চলছে খাবারের জন্য হাহাকার। খেয়ে না খেয়েই দিন কাটাচ্ছে আশ্রয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এতে একজনের খাবার খাচ্ছেন পাঁচজনে। আজ অল্প কয়েকজন অবস্থান নিলে কাল সেখানে জড়ো হচ্ছে হাজার জন।

Advertisement

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমতার শিকার হয়ে সর্বশান্ত রোহিঙ্গারা এখন দিশেহারা। তারা বিজিবির পাহারা ফাঁকি দিয়ে পাহাড়-পার্বত পেরিয়ে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। ফলে নতুন করে কক্সবাজার সীমান্ত অঞ্চল ও নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি এলাকার প্রত্যন্তাঞ্চল রোহিঙ্গাদের ভারে নুয়ে পড়ছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তে জড়ো হয়েছে। তাদের কারণে এপারের কোনো স্বার্থ যেন হানি না হয় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে। বিজিবির সঙ্গে জনপ্রতিনিধিগণও একাত্ম হয়ে কাজ করছে বলে উল্লেখ করে তিনি।

বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) ও নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার আজিম বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি প্রস্তুত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অপরদিকে, জলসীমান্ত টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপস্থ মাজারপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া ও পশ্চিমপাড়া নাফ নদীর গোলারচর মুখ এলাকা দিয়ে দালালদের মাধ্যমে নৌকা যোগে রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত রয়েছে। মালয়েশিয়া মানব পাচারকারী দালাল সিন্ডিকেড এসব কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৩২ জন দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে। এরপরও স্থল ও জলসীমা পার হয়ে ঢলের মতোই আসছে রোহিঙ্গারা। দেখলে যে কারও মনে হবে সীমান্ত যেন খুলে দেয়া হয়েছে। স্থলের মতো সেন্টমার্টিনদ্বীপেও রাত-দিন বিরামহীনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে।

Advertisement

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের উপকূলে কয়েক শত নৌকা সাগরে ও নদীতে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে এসব নৌকা ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কাজে। টেকনাফের সেন্টমার্টিনদ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ, শাপলাপুর, বড়ডেইল, মাথাভাঙ্গা, মারিশবনিয়া, শীলখালী, মহেশখালীয়া পাড়া, বাহারছড়া, হাদুর ছড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, লম্বরী, মিঠাপানিরছড়া, জাহাজপুরা, উখিয়া উপজেলার ছেপট খালী, মন খালী ঘাটে এখন কোনো নৌকা নেই। সব নৌকা দালালের সঙ্গে আঁতাত করে রোহিঙ্গা আনার জন্য মিয়ানমার যাতায়ত করছে।

এদিকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর, সাবরাং, সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউনিয়নের সীমান্ত পথে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে।

বাহারছড়া ইউনিয়ন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী ইউনিয়ন বিধায় এতদিন সরাসরি সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কিন্ত মঙ্গলবার থেকে উপকূলবর্তী বাহারছড়া ইউনিয়নেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে। তবে দালালরা নাকি জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া নিচ্ছে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে কেড়ে নেয়া হচ্ছে স্বর্ণালংকার। দিনের আলোতেও বাহারছড়া শামলাপুর সৈকতে সরাসরি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল।

হোয়াইক্যং মডেল ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, এ পর্যন্ত কত জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তার সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা সম্ভব নয়। কারণ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে লোকালয়ে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে।

বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আজিজ উদ্দিন বলেন, রাতে ও দিনে কমপক্ষে কয়েক হাজার পরিবার সরাসরি নৌকা যোগে এসে বাহারছড়া ইউনিয়নের সৈকত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। পুলিশ-কোস্টগার্ডসহ এদের প্রতিহত করতে সচেষ্ট রয়েছে। আটক করা হয়েছে ৬ দালালকে। পুরো ইউনিয়নে মাইকিং করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক করা হয়েছে। মাছ শিকাররত নৌকাগুলোকে মিয়ানমার যাতায়ত না করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, দ্বীপের কোনো ফিশিং ট্রলার আমার জানা মতে রোহিঙ্গা আনার জন্য মিয়ানমার যাতায়াত করছেনা। তা সত্বেও মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কোস্টগার্ড সাগর থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই ৩টি ফিশিং ট্রলার আটক করেছে। এ ট্রলারগুলোও সেন্টমার্টিনদ্বীপের নয়।

একইভাবে আসছে উখিয়ার পালংখালী আনজুমানপাড়া সীমান্ত পার হয়ে। এখান দিয়ে স্বল্পদৈর্ঘের খাল পেরিয়ে রাতদিন দলে দলে আসছে রোহিঙ্গারা। এরা পাহাড়ে, সমতলে, নানা স্থাপনার বারান্দায়, পথে-ঘাটে যে যেখানে পারছে জটলা বেধে দিন পার করছে। অনেকে মিয়ানমারের ওপারের দিকে তাকিয়ে নিজেদের এলাকার অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা চালায়। সহায় সম্বলহীন এসব রোহিঙ্গাদের সময় কাটে অর্ধহার অনাহারে। আবার রোহিঙ্গা অনেক পরিবার উখিয়ার কয়েক শত একর সামাজিক বনায়নের পাহাড় দখল করে ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করছে। এতে কেটে ফেলা হচ্ছে কচি গাছও। টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাইন উদ্দিন খাঁন জানান, রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে যারা অপরাধ করছে সে সব দালালদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৪২ দালালকে সাজা ও এক দালালকে অর্থ দণ্ড দেয়া হয়েছে জানিয়ে ওসি আরও জানান, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা ব্যবসা করবে তাদেরকে কিছুতেই ছাড় দেয়া হবেনা। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, দালালের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে বোট মালিক এবং জেলেদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভাও করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, মানবিকতা চিন্তা করে সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি সহনশীল আচরণ করছে। নতুন আসা ও পুরোনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের বালুখালী এলাকায় জড়ো করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জনপ্রতিনিধির ও স্থানীয় জনতার আন্তরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করার পর বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং এ নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর কয়েকজন সরকারি পদে দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেড়ে নেয়া হয় ভোটাধিকার। শুরু হয় ধর্মীয় অত্যাচারও। নামাজ আদায়ে বাধা এবং হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। জোরকরে কেড়ে নেয়া হয় রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি এবং নিয়োজিত করা হয় বাধ্যতামূলক শ্রমে। বঞ্চিত করা হয় শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুযোগ থেকে। বিয়ের অনুমতি নেই, নেই সন্তান নিবন্ধন। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেয়া হয়না এবং রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেজন্য আরোপিত হতে থাকে একের পর এক বিধি নিষেধ। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। এর পর থেকে চলমান নির্যাতন এখনও অব্যাহত রয়েছে। গত অক্টোবরের নিপীড়নে জাতিসংঘের হিসাবে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বলা হলেও সেবারও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান গাড়ে বলে স্থানীয়দের ধারণা। আর চলমান সহিংসতায় এ পর্যন্ত দু’লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও জাতিসংঘের হিসাবে তা ৯০ হাজার।

সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/এমএস