র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, জঙ্গি আস্তানায় ইনোসেন্ট (নিরপরাধ) দুই শিশুসহ নারীরা ছিল। তাদের আমরা জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। তবে জঙ্গিদের খুনি যে মানসিকতা সেটাই আবার দেখতে পেলাম। তাদের খুনি মানসিকতার কারণে পরিবার ও শিশুসন্তানও রক্ষা পেল না। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
Advertisement
বুধবার বেলা সোয়া ৩টায় রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের বাঁধন সড়কের বর্ধনবাড়ি এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ‘জঙ্গি আস্তানা’ পরিদর্শন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
বেনজীর আহমেদ বলেন, ওই বাসায় ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ নিজেই বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে সে’সহ তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই সহযোগী মারা যায়। যেহেতু ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ ইউপিএস, আইপিএস, কবুতরসহ নানা ধরনের ব্যবসা করত। ব্যবসার কারণে তার কর্মচারীও ছিল। নিহত ওই দুই সহযোগী তার কর্মচারী হতে পারে। তবে তাদের পরিচয় আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টায় অ্যাসিড, পেট্রল, বোমা তৈরির বিস্ফোরকসহ কেমিক্যালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। পরপর তিনটি বিস্ফোরণ হয়। এরপর আরও বিস্ফোরণের শব্দ আমরা পাই। প্রধান বিস্ফোরণটির কারণে ভবনটির পঞ্চমতলায় আগুন লেগে যায়।
Advertisement
জঙ্গিদের আস্তানাটির মেঝেতে দুই ফুট বাই দুই ফুট গর্ত তৈরি হয়। গর্ত তৈরির কারণে চতুর্থতলায়ও বিস্ফোরক ও কেমিক্যাল বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়।
বিস্ফোরণের ভয়াবহতা ছিল পাঁচশ’ মিটার দূরত্বব্যাপী। এতে আশপাশের থাইগ্লাসগুলো ভেঙে পড়ে। কাচের টুকরা একেকটা স্প্লিন্টারে পরিণত হয়।
জঙ্গি আব্দুল্লাহর কাছে বিস্ফোরক ও আইইডি ছিল। দুই ব্যারেল পেট্রল এখনও মজুদ আছে। বিস্ফোরণে বেশক’টি কবুতর মারা গেছে। তবে বাকি কবুতরগুলো বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।
র্যাব ডিজি বলেন, ভবনটি ক্লিয়ার করার জন্য র্যাব কাজ শুরু করেছে। বড় সমস্যা হচ্ছে, এখনও ভবনটিতে তাপমাত্রা ৫০-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চতুর্থতলায় পানি দিয়ে তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা চলছে। পঞ্চমতলায়ও তাপমাত্রা বেশি। সেখানে আলামত নষ্ট হবে ভেবে পানিও দেয়া যাচ্ছে না। তবে জানালা ও দরজা ভেঙে তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা চলছে।
Advertisement
বেনজীর আহমেদ বলেন, পঞ্চমতলা থেকে ইতোমধ্যে আমরা সাতটি মাথার খুলি পেয়েছি। মানুষের শরীর বলতে যা তা পুড়ে মূলত ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। দু-একটি হাড় দেখা গেছে। আমরা মৃত দেহগুলো শনাক্ত করছি। র্যাব, সিআইডি ও পুলিশের ফরেনসিক টিম কাজ করছে। তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা হবে। সময় লাগবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালও কাজ করা লাগতে পারে।
তিনি বলেন, ভবনটি দেখে মনে হয় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনটি বসবাসের উপযোগী থাকবে কি না সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা ইঞ্জিনিয়ারদের মতামত নিতে হবে।
ওই ভবনের অন্য কোনো ফ্ল্যাটে কেউ ছিল না। তাদের সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। স্কুলে থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরবর্তীতে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয়। শুধু জঙ্গি আব্দুল্লাহ, তার পরিবারের সদস্য ও সহযোগীরা মারা গেছে।
বেনজীর আহমেদ বলেন, আমাদের চেষ্টা ছিল ইনোসেন্ট দুই শিশু ও নারীদের রক্ষা করা। সেজন্য আমরা আত্মসমর্পণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। তাদের জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। জঙ্গিরা যে বরাবর খুনি মানসিকতার, সেটাই আবার দেখতে পেলাম।
তিনি বলেন, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে জেএমবিতে জড়িত। নব্য জেএমবি প্রতিষ্ঠার পর সে এ সংগঠনে যোগ দেয়। সারওয়ার জাহান যখন জেএমবি ভেঙে আলাদা দল (নিউ জেএমবি) গঠন করে সেই সময় এক শূরা সদস্য গ্রেফতার হয়। সে তথ্য দেয় যে, আব্দুল্লাহ আল-আনসার হিসাব কাজ করছে।
বেনজীর আহমেদ বলেন, জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, থাকা-খাওয়া ও অর্থ দিয়ে আব্দুল্লাহ সহযোগিতা করত। আমরা আগে তার নাম শুনলেও পরিচয় ও অবস্থান নিশ্চিত ছিলাম না।
‘কমলপ্রভা’ ভবনের পঞ্চমতলার বাসায় সে জঙ্গিদের আশ্রয় ও ট্রেনিং দিত। ওই নতুন শূরা সদস্যের দেয়া তথ্যের পর আমরা আব্দুল্লাহকে খুঁজছিলাম। অবশেষে তাকে পাওয়া গেল।
‘বলতে পারি, একটি বিরাট বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি’- যোগ করেন র্যাব ডিজি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৯-২০১০ সালের দিকে জেএমবি যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, একপর্যায়ে ভেঙে যায় তখন আমরা জানতে পারি কোনো এক আব্দুল্লাহ রয়েছে। সে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের।
সমূলে জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন বেনজীর আহমেদ।
তিনি বলেন, এ অভিযানের কোনো নাম দেয়া হয়নি। অভিযান শেষ করার আগে আশপাশের বাসা ও ভাড়াটিয়াদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে।
প্রসঙ্গত, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে সোমবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে ঘিরে ফেলা হয় রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডে বাঁধন সড়কের বর্ধনবাড়ি এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ছয়তলা বিশিষ্ট ওই বাড়িটি। বাড়িটিতে দুই স্ত্রী, সন্তান ও সহযোগীসহ দুর্ধর্ষ জঙ্গি আব্দুল্লাহ অবস্থান করছিল। সেখানে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও মজুদ করে রাখা হয়েছিল।
পরবর্তীতে তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা থাকলেও মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা আত্মঘাতী হন।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহর বাবার নাম মৃত মীর ইউসূফ আলী, বাড়ি মেহেরপুরে। তার দুই স্ত্রী- নাসরিন ও ফাতেমা, দুই সন্তান- ওসমান (৯-১১) ও ওমর (৩)। ওই বাসায় আব্দুল্লাহর বোন মেরিনাও অবস্থান করছিলেন। তিনি সোমবার গভীর রাতে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তীতে মেরিনার মাধ্যমে র্যাবের সঙ্গে আব্দুল্লাহর যোগাযোগ স্থাপন হয়।
আব্দুল্লাহর আরেক ভাই (৪৫), তবে তার নাম জানা যায়নি। তিনি কোরআনে হাফেজ বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে মুফতি মাহমুদ খান সংবাদকর্মীদের জানান, জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ না করে রাত পৌনে ১০টার দিকে পরপর বড় চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে র্যাবের চার সদস্য স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন। বিস্ফোরণের কারণে ওই ভবনের আগুন লেগে যায়।
বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল পৌনে ৯টার দিকে ওই বাড়ির ধ্বংসস্তূপে তল্লাশি অভিযান শুরু করে র্যাব সদস্যরা।
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মুফতি মাহমুদ খান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জঙ্গি’ আব্দুল্লাহ তার সহযোগীদের নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তারা ধ্বংসাত্মক কিছু করতে পারে কি না- সেই বিষয়ে র্যাবের কড়া নজরদারি রয়েছে। র্যাবও সতর্কাবস্থায় আছে।
এর আগে বাড়িটির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এছাড়া টেলিফোন, ডিস ও ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়। মানসিকভাবে চাপে ফেলতে এবং তারা (জঙ্গিরা) যাতে বাধ্য হয় আত্মসমর্পণ করতে- এ কারণে এসব করা হয়েছে বলেও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এরও আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বলেন, আব্দুল্লাহ দুর্ধর্ষ জঙ্গি। তার সঙ্গে আমাদের রাত ৪টা থেকে যোগাযোগ হচ্ছে। তাকে আমরা বিভিন্নভাবে আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানাই। তিনি আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছুটা সময় চেয়েছেন।
বেনজীর বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছি। এরপরও তিনি যদি আত্মসমর্পণ না করেন এবং র্যাবের ওপর হামলার চেষ্টা করেন তাহলে আমরা আইনি পদ্ধতিতে অভিযানে যাব।
বাড়িটিতে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। তবে এরই মধ্যে নারী ও শিশুসহ সব বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ভেতরে কী পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে জানতে চাইলে র্যাব প্রধান বলেন, আমাদের তথ্যমতে ভেতরে ৫০টিরও বেশি দেশীয় তৈরি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি বোমা) রয়েছে। এছাড়া অ্যাসিডসহ বিস্ফোরক তৈরির বিভিন্ন দ্রব্যাদি তার কাছে মজুদ আছে। ছোট একটা পিস্তল আছে বলেও আমরা ধারণা করছি।
টাঙ্গাইলের একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় র্যাব। ওই আস্তানা থেকে জেএমবির দুই জঙ্গিকে আটক করা হয়। পরে তাদের তথ্য অনুযায়ী রাত ১টায় অভিযান চালিয়ে মাজার রোডের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের দক্ষিণে বর্ধনবাড়ি এলাকার ভাঙ্গাওয়াল গলির ২/৩/বি নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় জঙ্গি আস্তানাটি খুঁজে পায় র্যাব।
জেইউ/এমএআর/আরআইপি