মতামত

অবসর

“আমি অবসরের জন্য দক্ষিণ ফ্লোরিডাতে চলে যাচ্ছি”, রবসন সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন।

Advertisement

আমার বিরানব্বই বছরের চিরতরুণ রোগী রবসন সাহেব অরলান্ডো ছেড়ে চলে যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। গত তিন বছরে তার স্বাস্থ্যসেবার সুবাদে তিনি আসতেন আমার কাছে। আমাদের দু’জনেরই দু’জনের কাছে অনেক কিছু জানবার ছিল। সময় পার হয়েছে, আর আমাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছে বড়ই মধুর।

রবসন সাহেবের জন্ম নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ট্রয় নামের ছোট এক শহরে। তার দাদা ছিলেন ডাচ বংশোদ্ভূত। দাদী ইংলিশ। বাবা ছিলেন একজন রেস্তোরার মালিক। ওতে তার মন ছিল না কখনই। হাডসন নামের চমৎকার এক নদী বয়ে গিয়েছে এ শহরের পাশ দিয়ে। পাহাড়ি সে নদী, আর অবারিত সবুজ দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন তিনি।

হাডসনে মাছ ধরা ছিল তার নেশা। এরপর তা হয়ে গেল তার পেশা। বোস্টনের পাশে এক ছোট্ট জেলেদের শহরে যৌবনটা কেটেছে তার। এর মাঝেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাম লেখালেন তিনি। চলে গেলেন যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে বোস্টনে ফিরে এলেন আবার। ভীষণ দীনতার মাঝে পরিচয় হলো ফ্লোরিডার এক তরুণ, বিলের সাথে।

Advertisement

ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পালাটকা নামের ছোট এক শহরে চলে এলেন তিনি। ফিরে পেল তার পুরনো সখ -মাছ ধরা। বিয়ে কখনই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তার। কিন্তু মাছ ধরার নেশা কখনই পিছু ছাড়েনি।

এ শহরে সবচে পুরনো মাছের দোকানটি ছিল তার। কিউবার এক উচ্ছল তরুণী মারিয়া তাকে ভালোবাসার মায়াতে বেধেছিল যখন তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। দু’জনে মিলে এ দোকানটি খুলেছিল। গভীর সমুদ্র থেকে শুরু করে, দীঘি আর নদীতে রবসন সাহেবের ছিল অগাধ চলাচল। কোনো সন্তান হয়নি তাদের। মারিয়ার ছিল জন্মগত হৃদরোগ। তাকে চলে যেতে হলো হঠাৎ করেই। এরপর সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল রবসন সাহেবের।

মাছের ছিপ হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন দীঘিতে। কদাচিৎ মাছ ধরে ঘরে আনেন তিনি। এ বয়সে মাছ পরিষ্কার করতে ইচ্ছে করে না তার। নৌকোর উপর বসে ছিপ ফেলেন তিনি। তাতে কোনো বড়শি থাকে না। তিনি বসে বসে বই পড়েন। স্মৃতির মাঝে ডুব দেন। বিয়ারে চুমুক দেন মাঝে মধ্যে।

রবসন সাহেব বললেন, আমার সমবয়সী কেউ নেই আশে পাশে। বড় নিঃসঙ্গ তার জীবন। দক্ষিণ ফ্লোরিডাতে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের একটি থাকার ক্যাম্পের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। ক্যাম্পের পাশেই বড় একটি দীঘি। থাকা খাওয়ার চিন্তা নেই কোনো। সবচে বড় কথা, সারাদিন মাছ ধরতে পারবেন তিনি। ছিপে বড়শি থাকবে না। কেউ জানবে না তা। শীতের কুয়াশার সকালে নৌকোতে বসে সূর্যের অপেক্ষা করতে করতে বিয়ারে চুমুক দিয়ে কেবল অতীতের রূপসাগরে ডুব দেবেন তিনি।

Advertisement

রবসন সাহেব কি কখনো জীবনানন্দ পড়েছেন?

“একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুজে আর, জানিহৃদয়ের পথ চলা শেষ হলো সেইদিন -গিয়েছে সে সান্ত্বনার ঘরে।”

লেখক : ডা. বিএম আতিকুজ্জামান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।

আরএস/আরআইপি