জাতীয়

থ্যাংকস বাংলাদেশ বলে চিৎকার করলো নেপালিরা

সম্প্রতি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপালে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্ট (ডিসিএইচটি)। গত ৩০ এপ্রিল থেকে সেখানে এ কার্যক্রম অব্যহত রেখেছে তারা। ইতিমধ্যে নেপাল থেকে ঢাকায় ফিরেছেন চিকিৎসক প্রতিনিধিদের দলনেতা প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক অর্থপেডিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এএসএম মনিরুল আলম। এক সপ্তাহ ধরে বিধ্বস্ত নেপালের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি।নেপালের চিকিৎসা প্রদানের অভিজ্ঞতা এবং সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মানিক মোহাম্মদ।জাগো নিউজ : কাদের আমন্ত্রণে নেপাল গিয়েছিলেন?ডা. মনিরুল আলম : আমন্ত্রণ বা কোনো কিছুর অপেক্ষায় থাকিনি আমরা। নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে নেপাল গেছি। যখনই কোনো ডিজাস্টার হয় সাধারণত সেখানে আমরা যাই। ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্ট গত ২৫ বছর ধরে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সেটা দেশে হোক আর বিদেশে হোক। দেশে যেমন সিডর, আইলা হওয়ার পর আমাদের নিজেদের উদ্যোগে আমাদের ত্রাণ টিম নিয়ে চলে গেছি। এর আগে ২০০৯ সালে পাকিস্তানে যখন বিশাল ভূমিকম্প হয়। সেখানে আমাদের ডিসিএইচটি টিম এক থেকে দেড় মাস কাজ করেছে। ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্পের পর নেপালে আমরা নিজেদের উদ্যোগে সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানে কোনো ফ্লাইট না থাকার কারণে যেতে পারেনি। একটা বিমান সেখানে গিয়ে ঘুরে চলে আসে। ল্যান্ড করতে পারেনি। দু`দিন দেরি করে পরে আমরা ৩০ তারিখে যাই।জাগো নিউজ : সেখানে কী ধরনের চিকিৎসা সামগ্রী নিয়েছিলেন?ডা. মনিরুল আলম : চিকিৎসা সামগ্রী বলতে, মিনিমাম সার্জারি করার মতো, আহত রোগীর সার্জারি করার মতো প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টার, তাবু, খুব বড় ধরনের অপারেশন না হলেও মাঝারি ধরনের অপারেশন করার মতো জিনিস এবং প্রচুর পরিমাণে এন্টিবায়েটিক, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং অন্যান্য ওষুধ।জাগো নিউজ : নেপালে গিয়ে কী ধরনের সমস্যা মুখোমুখি হতে হয়েছে?ডা. মনিরুল আলম : না আমরা সেই অর্থে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। তবে একটু দেরি হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য। প্রথম দিন আমতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সারাদিন মিনিস্ট্রিরিতে তারপর ওখানে ডব্লিউএইচওটা সমন্বয় করছিল বিদেশি ত্রাণ নিয়ে যারা আসছিল। আমাদের সারাদিন ধরে ২/৩টা মিটিং করতে হয়েছে একদিনে। তাতে আমাদের গোছানো হয়ে যায়। থার্ড ডে থেকে আমরা কাজ শুরু করছি। নেপালের হেলথ মিনিস্ট্রি আমাদের কাজের জায়গা ফিক্সড করে দিয়েছে। সেই অনুযায়ী নেপাল থেকে ৬০ মাইল দূরে একটা জেলা। অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা। সেখানে আমরা যাই। সেখানকার হাসপাতালে যোগাযোগ করি। ওরা তখন আমাদের বলে আপনাদের গ্রামে যেতে হবে। আমার স্থানীয় লোকদের সহায়তায় জিপ ভাড়া করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাই। ক্যাম্প স্থাপন করি। পরের দিন বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে আমরা চিকিৎসা দেই।জাগো নিউজ : রোগীদের অবস্থা সেখানে কেমন দেখলেন?ডা. মনিরুল আলম : একদিক দিয়ে বড়সড় আহত আমরা পাইনি। কারণ হলো ওখানে কিছু মানুষ মারা যায়। আর প্রথম দু`দিনেই কিছু মানুষ হাসপাতালে শিফট হয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার মতো না আবার অব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে এ ধরনের পেশেন্ট আমরা বেশি পেয়েছি। এছাড়া সাধারণ সমস্যার রোগীর কোনো অভাব ছিলো না। যেহেতু আমরা লং টাইম থাকবো প্রস্তুতি নিয়ে গেছি। প্লাস্টার, ড্রেসিং করতে হয়েছে। সেগুলো আমরা বেশি করেছি।জাগো নিউজ : কোন ধরনের রোগী বেশি পেয়েছেন?ডা. মনিরুল আলম : ব্যাথার রোগী আমরা বেশি পেয়েছি। তখন ডায়রিয়া শুরু হয়নি। আপনি জানেন, ডিজাস্টার হলে ডায়রিয়া রোগীর পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু সেখানে ডায়রিয়া হওয়ার অবস্থা আছে। আমরা প্রত্যেক মানুষকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েছি আর বলেছি তারা যেন ঝর্ণার পাশে মলমূত্র ত্যাগ না করে। এবং পানি খাওয়ার আগে যেন ফুটিয়ে পান করে। সব জয়াগায় জ্বালানি কাঠ নেই। তারা যেন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করে।জাগো নিউজ : তাদেরকে কতোটুকু সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন?ডা. মনিরুল আলম : তারা খুবই সন্তুষ্ট। কারণ আমাদের সঙ্গে যে ব্যাচগুলো ছিলো তাতে বাংলাদেশ লেখা ছিল। এবং আমরা যখনই বাংলাদেশ টিম নিয়ে যেখানে যেতাম আশেপাশের মানুষ থ্যাংকস বাংলাদেশ, থ্যাংকস বাংলাদেশ বলে চিৎকার করতেন। আমি মনে করি নেপালে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।জাগো নিউজ : চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারী ও শিশুরা কোনো বৈষম্যের শিকার হয়েছে কি-না?ডা. মনিরুল আলম : আমরা নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে এনজিওর একজন নেপালি নার্স ছিলেন। তাকে আমরা নিয়ে যেতাম। ভলেন্টিয়ারি। তিনি আমাদের অনেক হেল্প করেছেন।জাগো নিউজ : নেপাল সরকার আপনাদের কীভাবে গ্রহণ করেছেন?ডা. মনিরুল আলম : নেপাল সরকার আমাদেরকে খুবই হার্টলি ওয়েলকাম জানিয়ে। উনারা আমাদের প্রত্যেকে আইডেন্টি কার্ড করে দিয়েছে। এই আইডেন্টি কার্ড থাকাতে সুবিধা হয়েছে। আমরা যখন ওখানে যাই লোকাল পুলিশ স্টেশন থেকে পুলিশ গেছে। তখন আমরা সেখানকার মিনিস্ট্রির কার্ড চিঠি দেখাই। আমাদের কার্ড দেখাই। নেপালি মিনিস্ট্রি থেকে নেপালি ভাষায় চিঠি লিখে দিয়েছে। আমাদের সব ধরনের সহেযাগিতা করেছে। ফোন নম্বর দিয়ে দরকারের সঙ্গে সঙ্গে ফোন করতে বলেছে। মূল ভূমিকম্পেরপরও এক সপ্তাহ ধরে সেখানে ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়েছে। সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারাই আমাদের আগে থেকে খবর দিতেন আজ এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারবেন।জাগো নিউজ : বাংলাদেশের সাহায্যে তাদের অনুভূতি কেমন দেখলেন?ডা. মনিরুল আলম : তারা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তারা বারবার আমাদের বলেছেন আপনারা নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পার্শবর্তী একটি দেশের কথাও বলছে, তারা অনেক মানুষ এদেশে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। তারাও এভাবে আমাদের জন্য হেল্প করেনি। নিজেদের টাকা খরচ করে আসছেন। আমরা ভেরি মাচ হ্যাপি। নেপাল সরকারের সব সেক্টর, আর্মির লোকজন যারা উদ্ধার কাজে আসছে তারাও বাংলাদেশকে থ্যাংকস জানিয়েছে।জাগাে নিউজ : এ মুহূর্তে কোন ধরনের জটিলতায় তারা ভুগছে?ডা. মনিরুল আলম : এ মুহূর্তে সমস্যা হচ্ছে এক হলো তাদের আশ্রয়ের প্রোবলেম। গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। গ্রামের বাড়িগুলো যেহেতু মাটির তৈরি, তাই ৯৯ ভাগ বাড়িই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাদের কোনো আশ্রয়ের জায়গা নেই। ইমিডিয়েট ব্যবস্থার জন্য কোনো রিসোর্স নেই। বিভিন্ন এনজিও এবং বিদেশ থেকে ৭/১০ দিনের খাবার দেয়া হয়েছে। এক-দুই মাসের মধ্যে বা বর্ষাকালের আগে যদি পলিথিন বা তাবু দিয়ে যদি ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। বর্ষকালের আগে দেয়া না গেলে মহামারী ছড়িয়ে পড়বে। ইদানিং আমরা যে রিপোর্ট পাচ্ছি তাতে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।জাগো নিউজ : এখন তাদের কোন ধরনের চিকিৎসা দরকার?ডা. মনিরুল আলম : আঘাতজনিত চিকিৎসা মোটামুটি কাভার হয়ে গেছে। এখন তাদের জেনারেল ট্রিটমেন্ট, মহামারির চিকিৎসা দেয়া দরকার। উম্মুক্তস্থানে মানুষ বাস করছে। তাদের ডায়রিয়া, আমাশয় এগুলোর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। কারণ তারা সুপেয় পানি পাচ্ছে না। অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছে না।জাগো নিউজ : ভবিষ্যতে এমন দুর্যোগ মোকাবিলায় কেমন প্রস্তুতি থাকা উচিত?ডা. মনিরুল আলম : নেপালে দেখলাম তাদের ইকোনোমির অবস্থা খুবই খারাপ, বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি গরীব মানুষ সেখানে। কিন্তু সেখানকার মানুষ হ্যাপি এবং অনেস্ট। আমি এমন ঘটনাও দেখেছি পাহাড়ের নিচে বিকেলে কেউ ত্রাণ দিতে গেছে। তখন তারা বলছে আমরা ত্রাণ পেয়েছি। সকালে একগ্রুপ দিয়েছে, আপনারা ওপরে যান। তারা পায়নি। এটা আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। আমাদের দেশে তো এ ধরনের জিনিস দেখি না। নিজে দরকার হলে তিনবার ত্রাণ নেবো। কেউ পাইলো না পাইলো সে বিষয়টি ভেবে দেখি না। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিপদে পড়ার পরও আরেক জনের প্রতি একটা ফিলিংস। এটা আসলে আমাদের শেখার অনেক ব্যাপার আছে।জাগো নিউজ : বাংলাদেশও ভুমিকম্প ঝুকিতে...সেক্ষেত্রে এমন দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবার পূর্বপ্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?ডা. মনিরুল আলম : বাংলাদেশ অনেক বেশি ঘনবসতিপূর্ণ। বাংলাদেশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও খুব বড় ধরনের ডিজাস্টার হবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের বিল্ডিংগুলো কিন্তু মোটামুটি ওয়েল স্ট্রাকচারড। নেপালে অধিকাংশ বাড়ি মাটির তৈরি। ওই ধরনের মাটির তৈরি আমাদের কোনো বিল্ডিং নেই। হয়তো আমাদের পুরান ঢাকার পুরনো হিন্দুবাড়ি যেগুলো আছে। সেই ধরনের বাড়িগুলো ধসে পড়তে পারে। নতুন যতো বিল্ডিং আছে কলাম ওয়ালা বিল্ডিং আছে হয়তো সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধসে পড়বে না। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে অতবড় বিপর্যের আশঙ্কা নেই বলে টকশোতে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনেছি। এ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। একটা ভূমিকম্প ৪০ সেকেন্ডের বেশি হয়তো স্থায়ী হয় না। ৪০ সেকেন্ডে আপনি দশতলা থেকে লাফ দিয়ে নামতে পারবেন না। কলাম থাকলে তার নিচে থাকুন। বিল্ডিংয়ের অন্যান্য কিছু ভাঙলেও কলাম ভাঙবে না। কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে যাবেন। পরে হয়তো রেসকিউ হবেন। এ ম্যাসেজগুলো দেয়া দরকার। রানাপ্লাজা প্রমাণ করে ওই ধরনের ভূমিকম্প হলে আমাদের করার কিছু নেই সবাইকে মারা যেতে হবে। আমি মনে করি প্রাথমিক থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে অন্তত দু`পৃষ্ঠা হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রস্তুতি সম্পর্কে থাকা উচিত। কিছু কিছু জিনিস আছে। বাচ্চাদের ছোট বেলায় শিখিয়ে দিলে পারফেক্টলি মান্য করে। মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হলে। হ্যাবিট হয়ে যাবে। সহজ পদ্ধতি।জাগো নিউজ : নেপালিদের ঘুরে দাঁড়াতে কেমন সময় লাগবে?ডা. মনিরুল আলম : ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে মনে হয় না। তাদের যদি কিছুদিনের জন্য তাবুতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয় তাহলে তারা অল্প দিনের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো খুলেছে।জাগো নিউজ : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।ডা. মনিরুল আলম : আপনাকেও ধন্যবাদ।এমএম/বিএ/আরআর

Advertisement