রাত সাড়ে ১১টা। বাইরের ভ্যাপসা গরম সময়ের ব্যাস্তানুপাতিক হিসেবে কমে এসেছে। তবু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে খুব আরাম, তার চেয়েও স্বস্তিদায়ক আমার বিপন্ন অবস্থায় টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা দুইজন অমায়িক পুলিশ অফিসারের সাথে কথোপকথন। হ্যাঁ পুলিশ অফিসার বা থানাওয়ালা। আমি থানাতেই বসেছিলাম। কার্যকারণ, পার্স হারিয়েছি। পার্সে প্রায় আমার সর্বস্ব। সবগুলি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, ভিসা কার্ড, ইন্স্যুরেন্স কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, অফিসের আইডি কার্ড এবং সবশেষে- জাপানের বেসিক পরিচয়পত্র- রেসিডেন্স কার্ড।
Advertisement
ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে চেইন বোধহয় টানতে ভুলে গিয়েছিলাম। বাস থেকে নামা ওঠার বা হাঁটা পথের কোথাও পরে গেছে। এখন ঠিক ঠিক বাসে হারিয়েছি নিশ্চিত হলে বাস সেন্টারেই ফোন করতাম। কিন্তু বলে যে মাল যায় যার, ঈমান যায় তার। তখন অনেক কিছুই সম্ভাব্য মনে হয়, অনেককেই সন্দেহভাজন মনে হয়। আমার বেলায় এই সন্দেহটা মূলত ছিল স্থান। আর মানুষ ছিলনা বলতেও, কেউ পিকপকেট করেনি সেটা শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু মনে হয়েছে যে কুড়িয়ে পেয়েছে সে যদি জাপানি না হয়ে অন্য কেউ হয়, তো টাকা, ক্রেডিট কার্ড রেখে হয়তো পার্স কোন ডোবা নালায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তাই অফিস থেকে বাসায় ফিরে সব ওলট পালট করে ঝেড়ে ঝুড়ে পার্স নেই নিশ্চিত হয়ে সরাসরি এলাকার থানাতেই ছুটলাম। পরিচয়পত্র বলতে আমার কাছে কেবল আছে আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট আর অফিসের ব্যাংক বই। সাথে বিজনেস কার্ডও নিলাম, কারণ ইত্যাকার জিনিস ফর্মভর্তি করে জাপানি ভাষায় লিখতে হয় অনেকবার। জাপানি লেখা গুলিয়ে গেলে কার্ড দেখে মনে করতে সুবিধা হয়।
থানায় আমার সেদিনই প্রথম না, এর আগেও বাসার, অফিসের চাবি হারিয়ে গেছি, ছেলেদের সাইকেল হারিয়ে গেছি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রতিবার আমার মনে হয়েছে, “ আহ! ২৪ ঘন্টার এমন সেবা এত আন্তরিকতা নিয়ে না শুনলে এই ভাষা সমস্যার বান্ধবহীন দেশে আমার কি যে হত!” থানায় আরেক বুড়িমানুষও এসেছিলেন। সম্ভবত নির্দিষ্ট সীমার ২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য তার লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। বার বার মাঝ বয়সী এবং তরুণ দুই পুলিশ অফিসার বৃদ্ধাকে বলছিল, “ সত্যি খুবই দুঃখিত, কিন্তু আমাদের কিছু করার সাধ্য নাই …” পাশাপাশি আমার কেইসটাও ডিল করছিল। আমার যা যা মনে আছে আছে- কোথায় হারাতে পারে , ব্যাগে কি কি ছিল, কত টাকা ছিল বললাম। তাঁরা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের ২৪ ঘন্টা সেবার নম্বরগুলি বের করে করে ফোন করে আমাকে কথা বলালো।
ড্রাইভিং লাইসেন্স সেন্টারে ফোন করে স্রেফ আমার নাম দিয়ে খোঁজ চালিয়ে ফর্ম পূরণ করে নতুন কার্ড কবে কোথায় গিয়ে আনতে হবে দেখিয়ে দিল। উল্লেখ্য ,আমাদের নাম দিয়ে খোঁজ চালানো কিন্তু সহজ কথা না। আমাদের নামের পদবি থাকে শেষে, এদের শুরুতে। এছাড়াও আমরা প্রথম এসে জাপানি ভাষা না জানায় ইংরেজিতে নাম লেখা কার্ড করি। পরে নবায়ন বা নতুন কার্ড করলে জাপানি লিখতে পারি জানলে জাপানিতে লিখতে বলা হয়। কাজেই আমার কার্ডে আদৌ কোনভাবে আমার নাম ছিল তা তো আর খেয়ালই নেই। আর জাপানি উচ্চারণ ইংরেজি উচ্চারণে সুবিশাল তফাত। ১ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। সব কাজ শেষ। তারা বার বার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চাইছে, আমি ঠিক আছি তো, আর কোন সাহায্য লাগবে কিনা। আমার থানায় বসে থাকার যেমন এতটুকু অস্বস্তি ছিল না, তেমন ছিলনা রাত ১২ টা পেরিয়ে গেছে- একা হেঁটে বাড়ি ফিরবো এই নিয়ে সামান্যতম ভয়।
Advertisement
প্রিয় বন্ধুদের আড্ডা থেকে যেমন ফিরতে ইচ্ছে হয় না, স্রেফ নাগরিক ব্যাস্ততায়- পরদিন কাজের তাড়ায় ফিরতে হয়, অনেকটা সেইমতই উঠে আসলাম। কারণ, এই পুলিশ সত্যিই মানুষের বন্ধু। উঠে আসার আগে মরিয়া হয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলাম, যদি পার্সটা না পাও? বয়স্ক অফিসার গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিনয়ী হাসি হেসে আশ্বস্ত করলেন , “ না পাবার সম্ভবনা শূন্য শতাংশ। সাত থেকে দশ দিন সর্বোচ্চ। তোমার নতুন কার্ড আর ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতেও তেমন সময়ই নেবে। ভোগান্তি এটাই। সত্যিই দুঃখিত । ” দুদিনের মাথায় বাস সেন্টার থেকে ফোন এলো। প্রথম দিনেই ফোন পেতাম। ভুল করেছি যে অতি সম্প্রতি ফোন নম্বর পাল্টেছি, যেটা অফিস ছাড়া কোথাও আপডেট করা হয়নি। বাস সেন্টার আমার অফিসের নম্বর খুঁজে না পেলে বা আমি খোঁজ করে সংগ্রহ না করলে তা সাত দিনের মাথায় থানায় পাঠিয়ে দিত। তখন আমি থানা থেকেই ফোন পেতাম।
এখানে উল্লেখ্য , জাপানিরা কিন্তু মনে মনে প্রবল বর্ণবাদী। এরা জন্মগত জাপানি না হলে কাউকে কোনদিন এদের সমাজে গ্রহণ করেনা। স্রেফ বিনয়, নম্রতা , আন্তরিকতার পুরু মোড়কে আপ্যায়ন যেটা পাই সেটা সবার জন্যই সমান। এদের চিরস্থায়ী বিশ্বাস, এদের এই বিশেষ আদবকায়দা, বিনয়, নিয়মানুবর্তিতা, সুঁচিবায়ুগ্রস্থতা এই সমাজের বাইরের কেউ বা কোন বিদেশি কোন দিনও রপ্ত করতে পারবে না। তারা সমাজে ঢুকে সমাজ নষ্ট করে দেবে। চাকরি বা কোন কিছুতেই বিদেশি নেবার ক্ষেত্রে তাদের দরজা থাকে প্রায় বন্ধ। নিলেও তা খণ্ডকালীন।
আমি একদিনেই এর কারণ বুঝে গেছিলাম। সেদিন ছিল খুব বাজে একটা দিন। সকাল থেকেই রাস্তা হারিয়ে এদিক সেদিন সেভেন ইলেভেনের মত কনভেনিয়েন্ট স্টোরগুলোতে সাহায্য চাচ্ছি, এটাই নিয়ম। কিন্তু সেদিন এমনি কপাল মন্দ ছিল সে সবগুলি স্টোরেই নেপালী, ইউরোপিয়ান, চাইনিজ স্টাফ ছিল যারা দায়সারা ভাবে ঠিকানা দেখে “সরি , চিনিনা” বলে এড়িয়ে গেল। তাদের মুখের জাপানি ভাষা শুনেই বুঝলাম তারা দীর্ঘদিনই জাপানে আছে, কিন্তু স্রেফ ভাষাটাই শিখেছে। একজন জাপানি এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার বন্ধ করে হেঁটে জায়গা দেখিয়ে আসতো । অফিসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হলেও। সেদিনই বুঝলাম কেন তাদের আশংকা ভীনদেশীরা তাদের সংস্কৃতি, ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেবে।
যেদিন খোঁজ পেলাম পার্সের, অফিসের একাউন্টেন্ট মহিলার ফেরার পথের কাছে বলে সে নিয়েই যাবে। এরপরেও অফিস সহকারী বার বার জিজ্ঞেস করলেন আমি ফেরার বাস ধরে ঠিক ঠিক ফিরতে পারবো তো? পাহাড়ি বিরান জায়গা, রাত হয়ে যাবে। আমি খুব রাস্তা কানা, ও জানে। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, না পেলে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবো, যত রাত হোক হাঁটবো, ভয় লাগবে না। গোপন রাখলাম, ভয় পাবোনা কারণ এটা জাপান কিন্তু আমার দেশ হলে কীই না হতে পারতো! বলা সম্ভব না, রাত ১২টায় থানায় একা মহিলা বসে আছেন তার সাথে কি কি হতে পারতো। আমার দেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশ না শুধু- বিশ্বের অনেক দেশেই তাই। ঘানা, নাইজেরিয়ার মত দেশে আমার বরের কাজ করার অভিজ্ঞতা, বা সুদানে এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা শুনি; বাংলাদেশ সেখানে অনেক ভাল। কাজেই উন্নত সুশৃঙ্খল নিরাপদ ছেড়ে যখন কেউ দেশে ফিরে যায়, যাদের এমন দেশে দীর্ঘসময় বাস করার অভিজ্ঞতা নাই তারা স্রেফ বলতে পারেন উন্নত জীবন সেক্রিফাইস করে এসেছে, কিন্তু বিষয়টা ঠিকঠাক উপলব্ধি করতেই পারবেন না। অসম্ভব।
Advertisement
যারা সত্যিই এসব দেশে মোটামুটি খেয়ে পড়ে থাকার অবস্থা ঠেলেও দেশে ফিরে কাজে নেমে যান, তারা সবসময়েই দেশকে বুকে ধারণ করেছিল বলেই যে কোন লেবেলের কষ্ট নিতে প্রস্তুত, স্রেফ সেজন্যই পারেন। একদিনে জাপানও এমন হয়নি। সহস্র বছরের অভ্যাস। আমাদেরটাও তাই। কিন্তু, আজ শুধরাতে শুরু করলে ১০০ বছর পরে হবে। পক্ষ বিপক্ষের যুক্তি থাকে- পুলিশে কম বেতন জেনেও ওরা তো যায়ই ঘুষ খেতে, দুর্নীতি করতে। পক্ষ ধারণকারীরা বলে বেতন কম, ঘুষ না খেলে কি করে চলবে? ঢুকতে যত ঘুষ দিতে হয় সহায় সম্বল বিক্রি করে তা তুলতে হবেনা? হাতে ধরে এই সেক্টরকে নাকি দুর্নীতিগ্রস্থ করা হয়েছে, সেই বৃটিশরাজের সময়ে।
কবে বৃটিশ তাড়ালাম! এখনো যদি তাদের লেজটা টাইয়ের মত গলায় ঝুলিয়ে রাখি- দোষটা তবে কাদের? অমানুসিক কষ্ট কি আমাদের পুলিশ বাহিনীও করেন না? দেশের বাইরে কোনদিন বাস না করার অভিজ্ঞতায় অনেকেই বলেন, “বিশ্বে এমন খারাপ দেশের নজির নাই, অমুক ঘ্টনার নজির নাই।” আপনারা কি জানেন, এই বিনয়ের অবতারদের দেশে আগে ১৫ বছর, এখন ২০ বছর পর খুনের মামলাও তামাদী হয়ে যায়? বিশ্বের জঘন্যতম গণধর্ষণ এবং ৪৪ দিন ধরে পৈশাচিক নির্যাতনের পর খুন এই দেশেই অপ্রাপ্তবয়স্ক কয়েকটি ছেলের হাতেই হয়েছিল, যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে খালাসও পেয়েছিল! চেংগিস খানের আগ্রাসনের সময় থেকে বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা অনেকেই জানেন। ভেতরের মানুষ সব দেশেই একইরকম; বাইরেরটাই সমাজব্যবস্থা আর আইনকানুন নির্ধারণ করে।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।neeta2806@yahoo.com
এইচআর/আইআই