মতামত

যেতে যেতে

মেঘলা দিন আজ।গতকাল সারা রাত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েছে। সকালের সূর্য না দেখলে দিনটা বিষণ্নভাবে শুরু হয়।

Advertisement

বিষণ্ণ মন নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আজ সরকারি ছুটির দিন। তবে এ ছুটির দিনে আমাকে কাজে আসতে হয়েছে।

হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে তিন তালাতে উঠে ডান দিকে প্রার্থনা ঘর। পাশেই দর্শনার্থীদের বিশ্রাম নেবার জায়গা। তার পাশে ছোট দরজা। ওখানে ঢুকলেই মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। খুব গুরুতর অসুস্থ রোগীগুলো এখানে। তিন নম্বর কামরাতে আছেন আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত রোগী ‘টম’।

টম আমাকে প্রথম নাম ধরে ডাকতে বলেছিল প্রথম দিনেই। আমার চাইতে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি এ ভদ্রলোককে প্রথমে নামে ডাকতে বেশ কষ্ট হতো। তবে টম ছিল একরোখা। ওর সারা জীবনই এরকম। বড় একরোখা। দীর্ঘদিন ধরে ও যুদ্ধ করছে মরণব্যাধি এক রোগ নিয়ে। দু’সপ্তাহ আগে অফিসে এসেছিল সে। খুব দুর্বল ছিল। আমার হাত ধরে বলল, ‘ডাক্তার, আমাকে খুব শিগগিরই যেতে হবে। আর বেশিদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। আমি শান্তিতে মরতে চাই। আজকাল খুব কষ্ট হয়। আমার ছেলেকে আসতে বলেছি শিগগিরই।’

Advertisement

বেশ অসুস্থ হয়ে গেল সে তার দু’দিন পরই।

হাসপাতাল তার ভীষণ অপছন্দের জায়গা। না চাইলেও আসতে হলো তাকে। দিন দিন তার অবনতি হতে থাকলো। গতকাল আমাকে সে আবারো প্রশ্ন করল, ‘ছেলেকে আসতে বলবো?’ আমি মাথা নুইয়ে বললাম, ‘শিগগিরই।’

ওর ছেলে রিচার্ড ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ড নামের এক শহরে থাকেন। পেশায় একজন বিজ্ঞানী। আমার মতই বয়স। এর আগে একবার দেখা হলেও ফোনে কথা হয়েছে বেশ ক’বার। প্রতিবারই আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে তার বাবাকে নিয়ে। টম ক্লিভল্যান্ডে যেতে চায় না। তার ছেলেকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছে তার নেই।

গত রাতেই টমের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ওর হুঁশ নেই কাল রাত থেকে। ওর শেষ ইচ্ছে হিসেবে ওকে কোনো শ্বাসযন্ত্রে লাগানো হয়নি। ওর জীবন বাঁচানোর জন্য জটিল কোনো চিকিৎসাও তাকে দিতে নিষেধ করে গিয়েছে সে।

Advertisement

রিচার্ড এসে তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। টমের বিছানার পাশে বসে সে তার হাত ধরে আছে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। আমাকে বিষণ্নভাবে বলে উঠলো, ‘অনেক করেছ আমার বাবার জন্য। কতক্ষণ আছে টম আমাদের সাথে?’

আমি হালকাভাবে বললাম, ‘বিধাতা জানেন। তবে তা দীর্ঘ হবে বলে মনে হয় না।’ রিচার্ডের চোখে পানি এসে গেল, আমার ও।

টম জন্মেছিল ওহাইওর টিফিন নামে এক ছোট্ট শহরে। হাই স্কুল শেষ করে টিফিনের এক কাঁচের ফ্যাক্টরিতে কাজ নিল সে। ১৯৭০-এ টিফিন ছেড়ে যেতে হলো। টিফিনের কাঁচের ফ্যাক্টরি চিরতরে বন্ধ হওয়ার পর ভীষণ কষ্টে দিন কেটেছে তার। স্ত্রীও ছেড়ে গেল তাকে। একমাত্র ছেলে রিচার্ডকে নিয়ে সে চলে এলো অরলান্ডোতে।

ডিজনি ওয়ার্ল্ডে কাজ নিয়ে কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন।

টমের শখ ছিল বই পড়ার আর গান শোনার। নীল ডায়মন্ড ছিল তার প্রিয় গায়ক। আমাকে দু’টি চমৎকার বই উপহার দিয়েছিল সে। হাসপাতালের পাঠাগারে বইগুলো আছে এখন। রোগীরা পড়েন।

রিচার্ড বলল, ‘আমার বাবা তোমাদের হাসপাতালের পাঠাগারের জন্য তার সবগুলো বই আর নগদ কিছু টাকা রেখে গেছেন।’

রিচার্ডকে জরুরি কাজে আজই জার্মানি যেতে হবে। বাবাকে সে শেষ দেখা দেখে যাচ্ছে। খুব অস্বাভাবিক স্বাভাবিক ব্যাপার। আজ দেখা হোল এক প্রিয়জনের সাথে। আমি জানি আর জীবিত দেখবো না তাকে এ পরিবার। হয়তো বা দেখা হবেই না।

সারা হাসপাতাল ঘুরে ঘরে ফেরার পথে, টমের রুমে আবার দাঁড়ালাম। রিচার্ড তার বাবার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে। আমাকে ধরা গলায় বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে বাবা তার শেষ শ্বাসটি ছাড়লেন। খুব শান্তির সঙ্গে চলে গেলেন তিনি।’

আমি টমের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ম্লান এক হাসি তার মুখে। টম কখনোই কষ্টের মাঝে থেকে জীবনকে দীর্ঘ করতে চাননি। ও প্রায়ই বলতো, ‘জীবনের শেষ ক’টা দিন কষ্টের মাঝে না কাটিয়ে, শেষ চিকিৎসার খরচগুলো শিশুদের লেখাপড়ার জন্য খরচ করা উচিৎ।’

অনেক খরচ করে কৃত্তিমভাবে জীবনকে দীর্ঘ করার পক্ষপাতিত্ব টম কখনোই করত না।

হাসপাতাল থেকে বেরোতেই দেখলাম রোদ উঠেছে। গাড়িতে উঠে বাসার দিকে যাচ্ছি। সূর্যের আলো আমার মুখে পড়ছে। নীল ডায়মন্ডের গান চলছে রেডিওতে…

“Sunshine on my shoulders makes me happySunshine in my eyes can make me crySunshine on the water looks so lovelySunshine almost always makes me high.”

লেখক : ডা. বিএম আতিকুজ্জামান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।

এনএফ/পিআর