যোগাযোগের যে-কটি মাধ্যম আমার চেনা-জানা সেগুলোর দিকে চোখ মেলে তাকালে আশান্বিত হওয়ার মত তেমন খবর সচরাচর খুব একটা চোখে পড়ে না। তাছাড়া, প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমসহ সামাজিক যোগোযোগের মাধ্যম থেকে আশাবাদী হয়ে ওঠার মতো খবরের চেয়ে নেতিবাচক খবরই বেশি দেখি, আশান্বিত হওয়ার বদলে দুঃখ পাই, ব্যথিত হই। সংবাদ মাধ্যমের জন্য আসলে ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’ এটিই হয়তো চূড়ান্ত আপ্তবাক্য। তাই খারাপ বা দুঃসংবাদই আমাদের সংবাদ মাধ্যমসমূহের প্রধানতম উপাদান- বলা যায় বাণিজ্যিক উপাদানও।
Advertisement
অপরদিকে, সংবাদ মাধ্যমের টিকে থাকা এবং সামাজিক সংস্কার-সংশোধনের জন্য বর্ণিত ‘ব্যাড নিউজে’র গুরুত্বও কম নয়। দুঃসংবাদ বা নেতিবাচক সংবাদ সমাজ, সামাজিক সংস্থা এবং সর্বোপরি ব্যক্তি মানুষকে সচেতনও করে তোলে। সুতরাং ঋণাত্মক সংবাদ পরিবেশনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার কারণ নেই। সমস্যাটি হলো- আমাদের মত সামাজিক পরিবেশ-প্রতিবেশে এত বেশি নেতিবাচক সংবাদের প্রকাশ ঘটে যে, সর্বদা ঋণাত্মক ঘটনাবহের মধ্যে জর্জরিত থেকে আমরা নিজেদের হতাশ বোধ করতেও বাধ্য হই।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা আবার নেতিবাচক খবরের পেছনেই যেন বেশি ছুটি! সমাজ-সংস্থা সৃষ্টির পর থেকেই প্রজন্ম পরম্পরায় এমন ব্যবস্থা চলে আসছে বলে আমাদের ধারণা। আবার আবেরকটি দিক যদি ভাবি তবে বুঝতে সক্ষম হবো যে, আমরা আসলে ইতিবাচক খবর পাবোই বা কোথায়? আমাদের চারপাশ-ইতো নেতিবাচক ঘটনাবলি আর খবরা-খবরে হয়ে সয়লাব হয়ে আছে! তাই গণমাধ্যম ও যোগাযোগ কর্মী বা মিডিয়াকে দোষ দিয়েও কোন লাভ আছে বলে মনে হয় না।
এখন আসি ভাল খবর কিংবা ইতিবাচক খবর না-পাওয়া প্রসঙ্গে। আমরা চারপাশে চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পাই ‘নেতি’র জঞ্জালে ছেয়ে আছে সব। আমরা ‘ইতি’র বা ভাল কোন খবর দেখিনা সকালে ঘুম থেকে ওঠে বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার পথে- সেকি পথ! একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় সরু অপরদিকে খানা-খন্দে ভরপুর পথঘাটের অবস্থা এতই করুণ যে, কখন বাচ্চাকে নিয়ে বেরুলে সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছানো সম্ভব হবে তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। অসহনীয় যানজটে স্থবির হওয়া পথের ডান-বামে তাকালেও দেখতে পাবো ‘আইন-শৃঙ্খলা’ বলে অভিধানে শব্দটি থাকলেও বাস্তবের পথে-ঘাটে তার কোন অস্তিত্ব নেই। তাই সড়কের বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির বহরে থমকে যায় সমগ্র নগরী।
Advertisement
আবার, যে সমস্ত এলাকায় প্রধান সড়ক বা হাই-ওয়ের পাশে স্কুল বা কলেজ আছে সেখানকার অবস্থা আরো করুণ, আরো ভয়ংকর! কত লক্ষ কোটি শ্রমঘণ্টা আমরা অপচয় করি কেবল যানজটের মধ্যে বসে বসে তার হিসাব করাটাও কষ্টসাধ্য। ট্রাফিক আইনের ছিঁটেফোটাও কেউ মান্য করে না রাস্তায় বেরুলে। এত ঝক্কি-ঝামেলার পর স্কুলে পৌঁছেও আমাদের বাচ্চারা কতখানি যথার্থ শিক্ষা পাচ্ছে তা নিয়ে কাব্য-মহাকাব্য রচনা সম্ভব তবু তাদের বিদ্যার বহর আবিষ্কার সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে। অতঃপর স্কুল শেষে বাড়ি ফেরাও আরেক মহাকব্যিক ব্যাপার! প্রসঙ্গত, প্রখ্যাত গ্রিক কবি হোমারের ‘ওডেসি’ মহাকাব্যের কথা মনে পড়ছে। দশ বছরব্যাপী ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে ইউলিসিসকে বাড়ি ফিরতে সময় লেগেছিল ২০ বছর! আমাদের বাচ্চা-কাচ্চারা যেন জন্মের পর থেকেই একেক জন একক মহাকাব্যের নায়কে পরিণত! যেন প্রত্যেকেই একেক জন ইউলিসিস!
ভাল কোন খবর সহজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ইতিবাচক খবরের চেয়ে নেতিবাচক সংবাদই বেশি শোনা যায়। শুধু কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? সরকারি-বেসরকারিসহ নানা ধরনের অফিস, সংস্থা, এমনকি আইন-আদালতের দোরগোড়াতেও আমরা দেখি নানা রকমের নেতিবাচক সংবাদের জন্ম নিচ্ছে একের পর এক। চাল-ডাল, আলু, পিঁয়াজ, সবজি, মাছ, মাংস, তেল, মরিচ এবং ফলমূলসহ বাজার থেকে যেসব পণ্য কিনে আনছি- এমনকি জীবন রক্ষাকারী যেসব ওষুধ কিনছি সেসবের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্রাহীন ভেজালের উপস্থিতি।
দেশের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। চাতুরি-চালাকির আশ্রয়ে নিজের কিংবা তার সন্তানদের ফুরফুরা ভবিষ্যতের কথা এবং তাদের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধির লক্ষে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে এদেশের টাকা। এদেশীয় অর্থে তাদের সম্পদের পাহাড় জমে উঠছে স্বপ্নের রঙিন রঙিন দেশে! সুতরাং ঘুম থেকে ওঠার পর সহস্র কাজ কিংবা হাজার হাজার মাইল হেঁটে এসে রাত্রিকালীন বিশ্রামে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে নেতিবাচক খবর, হতাশার খবর, আশাহীনতার খবর, বিমর্ষ হওয়ার খবর, সামাজিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার মত খবরের পর খবর।
এছাড়াও, বন্যার্তদের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছানো, ষোড়শ সংশোধনী বিতর্ক প্রভৃতি নিয়েও তেমন ভাল কোন সংবাদ আমাদের নজরে আসছে না। চারদিকের এত হতাশা, এত ঋণাত্মক, এত দুঃসংবাদের পাশে সম্প্রতি একটি খবরে খানিকটা আশান্বিত হলাম। খবরটি হলো ‘অর্থের অপব্যবহার প্রতিরোধে ২৮ ধাপ এগোল বাংলাদেশ’ [দৈনিক প্রথম আলো, ২২ আগস্ট ২০১৭, পৃ. ১৩]। এদেশের মানুষের শ্রমে-ঘামে সঞ্চিত অর্থ প্রভাবশালী মহলের অনেকেই অবৈধভাবে বিদেশে পাচারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে এক বছরের ব্যবধানে ২৮টি দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ৮২তম অবস্থানে উঠে এসেছে। আবার, খবরের ভেতরে আরো একটি খবর হলো ‘যে দশটি দেশ সূচকের উন্নতি ঘটিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।’ সুতরাং এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক খবর।
Advertisement
সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক ব্যাসেল ইনস্টিটিউট গভর্নেন্স ‘ব্যাসেল এএমএল ইনডেক্স ২০১৭’ নামক প্রতিবেদনে সম্প্রতি এরূপ তথ্য প্রদান করেছে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ঘাটতি, স্বচ্ছতার ঘাটতি, উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ধারণা সূচক, আর্থিক মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা, দুর্বল রাজনৈতিক অধিকার ও আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে এরূপ সূচক প্রস্তুত হয়ে থাকে। সুতরাং এরূপ একটি খবর আমাদের জন্য ইতিবাচক এই জন্যে যে, বিগত প্রায় দুবছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ সুইজ ব্যাংকে অবৈধ সম্পদের পাহাড় জমানোর প্রভাবশালীদের যে অনৈতিক পন্থা তার কিছুটা হলেও প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে। প্রসঙ্গত আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের এই প্রচেষ্টার সক্ষমতা আরো বৃদ্ধিসহ নজরদারি অব্যাহত রাখলে বর্ণিত ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আরো বৃদ্ধি পাবে। রক্ষা পাবে এদেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের শ্রম ও ঘামে সঞ্চিত দেশীয় মুদ্রা। এতে মানুষও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে- সরকারের ওপরও তাদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের অর্থ অপব্যবহার প্রতিরোধে যারা কাজ করছেন ইত্যবসরে আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের কাছে আমাদের এই প্রত্যাশাও নিবেদন করি যে, তারা যেন তাদের অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হন। বৎসরান্তে আমরা আবারো এরকম আরেকটি ইতিবাচক সংবাদের আশায় থাকলাম। আশায় থাকলাম আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার চিত্র চৌকস দেখবার।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস