মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রতীক মানা হয় তাকে। আপসহীনতার অনন্য উদাহরণেও তাকে আনা হয়। তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি।
Advertisement
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর চালানো নির্যাতন-হত্যার বর্বরতমকাণ্ডে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও নির্লিপ্ত রয়েছেন সু চি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে রোহিঙ্গাদের প্রতি তার রয়েছে বিদ্বেষ ও বিরোধিতা। যা নিয়ে তার ঘনিষ্ঠজনরাও বিস্মিত।
কেন বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর বিরোধিতা করছেন গণতন্ত্রের জন্য প্রায় দুই যুগ সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি সু চি।
কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আগলে রাখাসহ নানান প্রসঙ্গে উঠে আসছে গণমাধ্যমে। তবে সু চির এক রাজনৈতিক সহকর্মী বলেছেন, মূলত নৈতিক দুর্বলতার কারণেই রোহিঙ্গা নিধনের বিপক্ষে কোনো রাঁ করছেন না সু চি।
Advertisement
বৃহস্পতিবার নোবেলজয়ী সু চির শান্তিকামী মনোভাবের আড়ালে বাস্তবতা তুলে ধরে ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে এসব প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে।
ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর হাতে গৃহবন্দি থাকাকালে তার মুক্তির দাবিতে জেল খেটেছেন অনেকেই। সু চির সেই ঘনিষ্ঠরাই চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার অবস্থান নিয়ে অবাক।
সু চির এই চরম বিস্ময়কর মনোভাবের পেছনের কারণ খোঁজারও চেষ্টা করেছেন অনেকে।
কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু সু চির বাবা জেনারেল অং সান মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক; ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টার কারণেই রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান তার।
Advertisement
কারও ধারণা, দীর্ঘদিন গৃহবন্দি সু চি বহু কষ্টে পাওয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আছেন। এই ভয়ই তাকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধা দিচ্ছে।
তবে এই দলের লোকদের যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছেন তাম্পাডিপা ইনস্টিটিউটের প্রধান খিন সাও উইন। সেনা শাসনের বিরোধিতা করে তিনিও ১১ বছর জেল খেটেছেন।
খিন সাও মনে করেন, সু চি এখন আর সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির অবস্থানের মূল কারণ, তার নৈতিক সাহসের অভাব।
তবে সু চির এই বিষ্ময়কর পরিবর্তনের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে ‘বার্মা থা দিন নেটওয়ার্ক’ নামে দেশটির এক ব্যাঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন। পত্রিকাটির দাবি, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলদের ভাড়া করা রুশ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা অং সান সু চির শরীর থেকে গণতন্ত্রের জিন সরিয়ে একটা ক্লোন তৈরি করে দিয়েছে। সত্যিকারের সু চি এখনও সেনা কারাগারে বন্দি।
অন্যদিকে, সু চির রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থানে বিস্মিত তার সমর্থকরাসহ অনেকেই। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সু চির লড়াইয়ের সময় তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন এক মেডিকেল ছাত্রী। এজন্য ওই ছাত্রীকে ৬ বছর কারাবাসও করতে হয়েছে।
এখন, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের সময়ে সেই ছাত্রীর মা সুচির কর্মকাণ্ডে অবাক। এছাড়া গত নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা সু চির বিরুদ্ধে এরইমধ্যে জমা হয়েছে নানান অভিযোগ। তার কিছু হলো- দেশটির নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং মুসলিমদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা উপেক্ষা করা, সাংবাদিক এবং অ্যাকটিভিস্টদের কারাগারে পাঠানো ও যথেষ্ট ক্ষমতাধর সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি নতজানু হওয়া।
আরও কারও কারও অভিযোগ, সু চি সবসময় গণতন্ত্রের কথা বললেও, তার ভেতরে সবসময়ই স্বৈরাচারী মনোভাব বিরাজমান ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্তি সেই মনোভাবকেই উসকে দিয়েছে।
শত শত বছর ধরে আরাকান অঞ্চলে বসবাস করে আসছে মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। কিন্তু একসময় মিয়ানমার রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে দমননীতি গ্রহণ করে। এতে চরমভাবে উসকানি দিয়ে আসছে দেশটির বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাবশালী বড় অংশ।
গত ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি নামের একটি সংগঠন ৩০টি পুলিশ চেকপোস্টে হামলার পর থেকে রাখাইন রাজ্যে দেখা দেয় সহিংসতা। এরপর থেকে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে চলেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা।
কিন্তু রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সু চির কোনো বক্তব্য স্থানীয়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসেনি। বারবার বিষয়টি অগ্রাহ্য করেছেন তিনি।
উল্টো রাখাইনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ স্বাধীন তদন্ত কমিশন পাঠাতে চাইলেও তাতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সু চির সরকার। ‘মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং জাতিগত নির্মূল অভিযান চলছে' জাতিসংঘের এ অভিযোগও অস্বীকার করেছে সু চির সরকার।
এসআর/জেআইএম