জাতীয়

দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরলেন ১৫০ বাংলাদেশি

দালালদের মন ভুলানো লোভে ও পরিবারের অভাব দূর করার স্বপ্ন নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে বেরিয়ে ছিলেন তারা। অনন্ত সাগরে উত্তাল ঢেউয়ে মৃত্যুর হাতছানি, বন্দী জীবনে অর্ধাহার-অনিদ্রা ও নিগৃহীত জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণার স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরেছে মিয়ানমার উপকূল থেকে ১৫০ জন বাংলাদেশি। গত ২১ মে তাদের উদ্ধার করা হয়। সোমবার সকাল থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু জেলার ঢেকিবনিয়া ১নং সেক্টরে শুরু হওয়া পতাকা বৈঠক শেষে দুপুরে বিজিবি কাছে তাদের হস্তান্তর করে মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন বিভাগ ও বিজিপি।তাদের গ্রহণ করতে কক্সবাজার-১৭ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলমের নেতৃত্বে পুলিশ ও প্রশাসনের ১০ সদস্য বেলা পৌনে এগারটার দিকে ঘুমধুম সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া এক নম্বর সেক্টরে যান। সেখানে ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর সাও নায়িং। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, বিজিপি এক নম্বর সেক্টর ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার পুলিশ লে. কর্নেল কই তুই জাসহ মিয়ানমার ইমিগ্রেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা।দীর্ঘ আলোচনায় পর্যবেক্ষক হিসেবে বিজিবির পক্ষে ছিলেন কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. খালেকুজ্জামান ও বিজিপির পক্ষে মিয়ানমার ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ঘধু চুর ঞধ, পুলিশ কর্নেল মইও সওই, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ইউ সঁয়ে কু কু উপস্থিত ছিলেন।বৈঠক শেষে উদ্ধার অভিবাসীদের বিজিবির হাতে বেলা দেড়টার দিকে হস্তান্তর করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।বেলা পৌনে তিনটার দিকে ছয়টি বাস যোগে সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে অভিবাসীসহ ঘুমধুম হাই স্কুলের সম্মেলন কক্ষে আসেন প্রতিনিধি দল। সেখানে বেলা সাড়ে তিনটায় উপস্থিত সাংবাদিকদের এক সংক্ষিপ্ত প্রেসব্রিফিং করে বিজিবি।

Advertisement

ব্রিফিংকালে বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. খালেকুজ্জামান পিএসসি বলেন, সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে ভাসমান ট্রলারসহ ২৮৪ জনকে গত ২১ মে মিয়ানমার উপকূল থেকে দেশেটির নৌ-বাহিনী উদ্ধার করে। উদ্ধার অভিবাসন প্রত্যাশীদের মাঝে ২০০ জন বাংলাদেশি দাবি করে তাদের গ্রহণ করতে বিজিবির কাছে পত্র পাঠায় মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)।কিন্তু, সে সময় সঠিক তালিকা দিতে না পারায় বিজিবি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার যাবার প্রস্তুতি নেওয়ার পরও তা বাতিল করে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধিরা এসব অভিবাসীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। এদের মাঝে ১৫০ জনের তালিকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৫০ জন বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এটি জানানোর পর বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসব অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা জানান।.সেক্টর কমান্ডার আরো বলেন, সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৫০ বাংলাদেশিকে গ্রহণ করতে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘুনধুম সীমান্তের উপারে ঢেকিবনিয়া বিজিপি ক্যাম্পে বিজিবি-বিজিপির মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আলোচনা শেষে অভিবাসীদের নিয়ে প্রতিনিধি দল দেশে ফিরে আসে।তিনি আরো জানান, ১৫০ বাংলাদেশির মধ্যে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলার ২৯ জন, নরসিংদীর ৫৬ জন, চট্টগ্রামের ৮ জন, বান্দরবানের ১২ জন, ঝিনাইদহের ১২ জন, পাবনার ৫ জন, চুয়াডাঙ্গার ৪ জন, বাগেরহাটের ৪ জন, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ৬ জন, সুনামগঞ্জের ৪ জন, নারায়ণগঞ্জের ২ জন, টাঙ্গাইলের ৩ জন, যশোরের ২ জন ও কুমিল্লার ১ জন এবং নাটোরের ১ জন রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।এসময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন, পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইমিগ্রেশন ও আইএমওর প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মিয়ানমার থেকে ফিরিয়ে আনাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।ফেরত আসাদের মাঝে ঝিনাইদহের ইসমাইল হোসেনের ছেলে মফিউর রহমান, মো. নিজামের ছেলে হারুন উর রশিদ, ওসেল বিশ্বাসের ছেলে মহসিন বিশ্বাস, ইসমত আলীর ছেলে মো. সোবহান, মকবুল মুল­ার ছেলে পলাশ, মোতালেব মন্ডলের ছেলে রফিকুল ইসলাম, রাহাজ উদ্দিন মন্ডলের ছেলে আবুল কালাম, রজব আলীর ছেলে আব্দুর রাজ্জাক, শরীফ বিশ্বাসের ছেলে দুলাল, ইসমাইল সরদারের ছেলে আব্দুল মালেক ও রাসেদ মন্ডলের ছেলে ছাব্বির হোসেন।

সুনামগঞ্জের মোহাম্মদ উল্লাহর ছেলে সাহেদ উদ্দিন, আহমদ আলীর ছেলে রমজান আলী, সোনা আলীর ছেলে শওকত আলী ও মো. ইদ্রিস আলীর ছেলে আলী হোসেন।বি.বাড়িয়ার ছিদ্দিক সরকারের ছেলে আনোয়ার হোসেন ও হোসেন মিয়ার ছেলে এরশাদ।বান্দরবান জেলার ইকবালের ছেলে জাহিদ ইসলাম, নূরুল হকের ছেলে রহিম উল্লাহ, মনির আহমদের ছেলে আব্দুর ছবি ও মো. শফির ছেলে নূরুল হক।কুমিল্লা জেলার সোলতান আহমদের ছেলে রিদুয়ান, চাঁদপুরের ইউসুফ আলীর ছেলে কালাম ও রাজবাড়ীর আব্দুল খালেকের ছেলে সাইফুল ইসলাম।কক্সবাজার জেলার নূরুল ইসলামের ছেলে রমিজ উদ্দিন, মো. সৌরভের ছেলে নূরুল হোসেন, মহসিন আলীর ছেলে সাকের,আসমত আলীর ছেলে সিরাজুল হক, জহির আহমদের ছেলে মিজানুর রহমান, ইমতিয়াছ আহমদের ছেলে আব্দুল খালেক, কাশেম আলীর ছেলে মো. রশিদ মিয়া, সেলিম হোসেনের ছেলে হামিদ হোসেন, রহমত আলীর ছেলে শাহাজান, আব্দুল জব্বারের ছেলে জসিম উদ্দিন, আব্দুর রহমানের ছেলে ইয়াছিন আরফাত, আমির হাওলাদারের ছেলে শহিদুল ইসলাম, দুলু মিয়ার ছেলে ইউসুব খান, মো. হাসেমের ছেলে আবুল হোসেন, ফজল করিমের ছেলে একরাম, আব্দুল করিমের ছেলে ইকরাম, ও সোহেল সরকার, মো. রাশেদের ছেলে ইদ্রিস, হাজী নূরুল হকের ছেলে ইমরান হোসেন, আহমদ আলীর ছেলে জসিম উদ্দিন, নুরুল ইসলামের ছেলে আব্দুস শুক্কুর, জিয়াবুল হকের ছেলে মিজানুর রহমান, মাহমুদুল করিমের ছেলে গিয়াস উদ্দিন, মৃত আবু তাহেরের ছেলে সাদ্দাম হোসেন, হাবিবুর রহমানের ছেলে সালামত উল্ল­াহ, শামশুল আলমের ছেলে মোক্তার হোসেন, মো. হাশিমের ছেলে নুরুল আবছার, সিরাজুল হকের ছেলে মুবিনুল হক, মৃত উল্লা মিয়ার ছেলে রফিক আলম, কালা মিয়ার ছেলে সাইফুল, টাঙ্গাইলের আব্দুল করিমের ছেলে আব্দুল ছৈয়দ, আব্দুল জলিলের ছেলে উজ্জল হোসেন ও জহির উদ্দিনের ছেলে সাহাদত হোসেন।চট্টগ্রাম জেলার সাহাব উদ্দিনের ছেলে মো. হেলাল, উমর আলীর ছেলে হাসেম, সাহেদ আহমদের ছেলে লুকমান কবির, আলী আমজাদের ছেলে চাঁদ মিয়া, শহিদুল্লাহর ছেলে সেলিম উদ্দিন, বদিউল আলমের ছেলে মো. বাদশা, আব্দুল আলিমের ছেলে মো. জলিল ও শাহ আলমের ছেলে মো. আরিফ।চুয়াডাঙ্গার ফিরোজ মন্ডলের ছেলে সাইফুল মন্ডল, সুমিত আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম, আব্দুর রউফ ফরাজির ছেলে শফিকুল ইসলাম ও মফিউর রহমানের ছেলে মফিজুল হোসেন।নারায়ণগঞ্জ জেলার আবু মিয়ার ছেলে রাসেল মিয়া ও নুরুল ইসলামের ছেলে হালিম। নরসিংদীর সোনা মিয়ার ছেলে এবাদুল মিয়া, মুজিবুল মিয়ার ছেলে ফাহাদ মিয়া, আব্দুল হাসিমের ছেলে রুহুল আমিন, জহিরুল হকের ছেলে মেহেদী হাসান, সুজাউদ্দিনের ছেলে পারু মিয়া, তাজু মিয়ার ছেলে সালাম মিয়া, তারা মিয়ার ছেলে নাহাম, ওহাব মিয়ার ছেলে সাগর, আব্দুল আওয়ালের ছেলে জসিম উদ্দিন ও ওবাইদুল হাসানের ছেলে শামীম মিয়ার নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা গেছে।ফেরত আসা অভিবাসীদের কয়েকজন জানান, পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে দালালদের প্রলোভনে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ট্রলারে উঠেছিলাম। অবৈধ সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে প্রতিনিয়িত মৃত্যুর হাতছানি, ভিন দেশের নৌ-বাহিনীর হাতে আটক হবার পর নিগৃহীত জীবন সমস্ত আকাঙ্খা মাটি করে দিয়েছে। সাগরের বুকে ভাসন্ত ও বন্দী জীবনের স্মৃতি মনে করতে চাচ্ছি না। স্বজনদের কাছে জীবন্ত ফিরতে পারছি এটিই এখন সবচেয়ে বড় পাওয়া। বিজিবিসহ সরকারের যেসব সংস্থা বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরতে তাদের সহযোগিতা করেছে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তারা।সায়ীদ আলমগীর/এআরএ/আরআইপি

Advertisement