আজ পবিত্র হজ। লাখ লাখ হজ পালনকারী আল্লাহর মেহমানদের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাই, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ মিনা থেকে দলে দলে আরাফাতের ময়দানে যাচ্ছেন হাজিরা।
Advertisement
গতকাল বুধবার পবিত্র হজ পালনের জন্য পবিত্র নগরী মক্কাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাবু শহর মিনায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছে হজযাত্রীরা। তালবিয়ার ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছে মক্কা থেকে মিনার অলিগলি, পথঘাট ও মাঠ-প্রান্তর।
আজই (৩১ আগস্ট) হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। কেননা আরবি জিলহজ মাসের ৯ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় মূল হজ। আর সৌদি আরবে আজ ৯ জিলহজ হওয়ায় যথাযোগ্য মর্যাদা ও নিরাপত্তায় আরাফাতের ময়দানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মূল হজ।
এবার পবিত্র হজ পালনে সমগ্র বিশ্ব থেকে প্রায় ২০ লক্ষাধিক নারী-পুরুষ হজে অংশগ্রহণ করেছেন। যথাযোগ্য মর্যাদা ও নিরাপত্তায় হজ পালন করতে সবারই গন্তব্য ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দান।
Advertisement
হাদিসের বিধান অনুযায়ী, বুধবার জোহরের পূর্বেই মিনায় এসে অবস্থান করা সুন্নাত এবং তথায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় মুস্তাহাব, যা পালনে অধিকাংশ হাজি বুধবার জোহরের আগেই মিনায় এসে পৌঁছেছেন। আবার অনেকে ভিড় এড়াতে মঙ্গলবারই মিনায় চলে এসেছে।
তাঁরাই আজ (৩১ আগস্ট) হজ পালনের জন্য ফজরের নামাজ আদায় করেই কেউ আরাফাতের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন, আবার কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউ কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হবেন। কারণ, আজ তাদের হজ আদায়ের মূল কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।
এ কারণেই বিশ্ব মুসলিম মুখে আজ উচ্চারিত হচ্ছে-‘লাব্বাইক, আল্লা-হুম্মা লাব্বাইক; লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক; ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক; লা-শারিকা লাক;‘আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির; আপনার কোনো অংশীদার নেই; নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্যও আপনার; আপনার কোনো অংশীদার নেই।’
সৌদি আরবের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, এবার ৪১ থেকে ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে দেড় শতাধিক দেশে থেকে আগত প্রায় ২০ লক্ষাধিক মুসলমান হজের বিশ্ব মুসলিম সম্মিলনে উপস্থিত হচ্ছেন। এ যেন বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও আল্লাহর আনুগত্যের মহা সম্মিলন।
Advertisement
মিনায় তাঁরা নামাজ আদায়, ইবাদত-বন্দেগি ও জিকির-আজকারে বুধবার রাত অতিবাহিত করেছেন। অনেকে মঙ্গলবার রাতও সেখানে কাটিয়েছেন। অপেক্ষার প্রহর গুণছেন আল্লাহ তাআলার সঙ্গে প্রেমের সেতুবন্ধনের।
তাই ফজর নামাজ শেষ হতেই কেউ হেঁটে, আবার কেউ বিভিন্ন যানবাহনে একই গন্তব্য জাবালে রহমতের পাদদেশ ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে হাজির হতে আত্মহারা পাগলপারা। লাখো হজযাত্রীর মিছিলে বাংলাদেশ থেকেও হজ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেছেন ১ লাখ ২৭ হাজার ২২৯ জন। আর হজে যেতে পারেননি ৩৬৭ জন। গত বছর (২০১৬) হজ করেছিল ১ লাখ ১ হাজার ৮২৯ জন।
হজের ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ক্ষমাঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন স্মরণ করিয়ে দেয় আদি-পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও আদি-মাতা হজরত হাওয়া আলাইহিস সালামের পুনঃর্মিলনের ঘটনাকে।
এ ময়দান সংলগ্ন জাবালে রহমতে নির্মিত হয়েছে তাঁদের পুনঃর্মিলনের ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ। যেখানে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ চুম্বন করেন; দোয়া করেন; ক্ষমা প্রার্থনা করেন; চোখের পানিতে বুক ভেজান।
এ পাহাড় ‘রহমতের পাহাড়’; যে রহমতের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানকারী বান্দাদের আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন।
ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি আরাফাতের ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণও এ ময়দানেই প্রদান করেছিলেন। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণতার ঐশী ঘোষণা ঘোষিত হয়েছিল তাঁর কণ্ঠে- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।’
আজ হজে আগত লাখ লাখ মুসলমান দুই টুকরো সাদা কাপড়ে সজ্জিত হয়ে ক্ষণে ক্ষনে প্রকম্পিত করে তুলবে আরাফাতের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর।
গোনাহ মাফে হজ পালনকারীদের কান্নার শব্দ ভেসে বেড়াবে বাতাসে। চোখের পানিতে সিক্ত হবে সফেদ দাঁড়ি ও কাঁপা কণ্ঠ।
আল্লাহ তাআলা এ ময়দানেই তাঁদের ক্ষমা করবেন। এটাই হজ পালনকারীদের একান্ত আশা ও বিশ্বাস। এখানেই সকল হাজির সাথে আল্লাহ তাআলার সেতুবন্ধ তৈরি হবে। মুসলিম উম্মাহ হবে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো নিষ্পাপ ‘মা’ছুম’। যার বিনিময় শুধুই জান্নাত।
হজের তিনটি ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল কাজ। এ জন্যই হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা বলা হয় ‘আল-হাজ্জু আরাফাহ’ অর্থাহ আরাফাই হজ।
তাইতো হাজার হাজার হজ পালনকারী নারী-পুরুষ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিচ্ছেন আজ। যেখানে নেই কোনো বর্ণ বিদ্বেষ, উঁচু-নিচু, ধনী নির্ধণ। সবাই আজ আরাফাতের খোলা আকাশের নিচে এক কাতারে মিলিত হয়ে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে ফরিয়াদ জানাবেন সকাতর কণ্ঠে।
৩৫ বছর ধরে আরাফাতের ময়দানে খোতবা প্রদানকারী সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি দৃষ্টিহীন ইমাম শায়খ আবদুল আজিজ বার্ধক্যজনিত কারণে অবসর নিয়েছেন। গতবছর সে দায়িত্ব পালন করেছেন দুই পবিত্র মসজিদে খতিব শায়খ ড. আব্দুর রহমান আস-সুদাইসি।
আর এবার আরাফাতের ময়দানে হজের খোতবা প্রদান করবেন নতুন খতিব সৌদি আরবের ওলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য বিশিষ্ট ইসলামিক ব্যক্তিত্ব বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের রাজকীয় উপদেষ্টা শায়খ ড. সাআ’দ আশ-শাসরি।
আজ তিনি ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে হজ পালনকারীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ খোতবা প্রদান করবেন। যাতে থাকবে আগামীদিনের সঠিক পথে চলার পথেয়। অতঃপর তিনি বিশ্ব মুসলিমের এ মহাসম্মিলনে দোয়া মোনাজাত করবেন এবং মসজিদে নামিরায় নামাজের ইমামতি করবেন।
তিনি আজ বাদ জোহর আরাফার ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরায় হতে খুতবা পাঠ করবেন। খুতবায় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহকে একাত্মতা প্রকাশ করার আহ্বান জানাবেন। মোনাজাতের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশ ও অবস্থা বিরাজের দোয়া করবেন।
মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও ঐক্য এবং সারা দুনিয়ার মানুষের আশান্তির পরিবর্তে সুখ, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করবেন। জানা-অজানা সব গোনাহ মাফে আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারী হজ পালনকারীরা আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলবেন পুরো আরাফাতের ময়দান।
অতঃপর ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানেই এক আজানে পৃথক পৃথক ইক্বামাতে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করবেন তারা। সন্ধ্যায় মাগরিব না পড়েই রওনা হবেন মুজদালিফার উদ্দেশে।
উল্লেখ্য যে, সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ এবার হজ উপলক্ষে পবিত্র নগরী মক্কা এবং মদিনায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য আলাদা আলাদা ফোর্স গঠন করেছেন। ১ লাখ নিরাপত্তা কর্মী এবারের হজযাত্রীদের সহায়তায় নিয়োজিত থাকবে।স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে ২৫টি হসপিটাল, ১৫৫টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ২৯ হাজার চিকিৎসক দল, ১৩ শ’ জনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার অধীনে ১০০টি অ্যাম্বুলেন্স মজুদ রাখা হয়েছে।
পরিশেষে…আল্লাহ তাআলা বিশ্ব মুসলিমের ঐতিহাসিক মহাসম্মিলন আরাফার কার্যক্রমকে কবুল করুন। হজে অংশগ্রহণকারী সকল হাজির হজকে কবুল করুন।
সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত নিরাপত্তারক্ষীসহ সব ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ধৈর্যের সঙ্গে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হজ কার্যক্রমে সেবাদানের তাওফিক দান করুন।
মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর হজে বাইতুল্লাহ ও জিয়ারতে মদিনা নসিব করুন।
সমগ্র বিশ্বে শান্তি স্থাপনে ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানের মহাসম্মিলন হোক মানুষের মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণের একমাত্র উপায়। এই প্রত্যাশায়....
এমএমএস/আরআইপি