আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে রংপুরের বিভিন্ন হাটগুলোতে গরু-ছাগলের আমদানি বাড়লেও ক্রেতাদের উপস্থিতি না থাকায় কমে এসেছে বিক্রি। এ অবস্থায় হাতগুটিয়ে বসে আছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দালাল, ফড়িয়া, ছোট-বড় ব্যবসায়ী, শ্রমিক এবং ইজারাদাররা।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত বছরগুলোতে জিলহজ্ব মাসের চাঁদ ওঠার আগে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার গরুর হাটে ২৫ লাখেরও বেশি গরু বিক্রি হতো। এই গরুর ৮০ ভাগ ক্রেতা ছিলেন উত্তরাঞ্চলের বাইরে থেকে আসা বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল এলাকার গরু ব্যবসায়ী। ট্রাকে করে এগুলো নিয়ে যাওয়া হতো বাইরে। এরপর জিলহজ্ব মাসের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হতো স্থানীয় পর্যায়ে গরু বিক্রি।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি হাটে গরু বিক্রি করতে আসা রংপুর মহানগরীর ডাঙ্গির পাড় এলাকার তরুন উদ্যোক্তা মশিয়ার রহমান বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের পর ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৪টি দেশি গরু কিনি। এরপর বছরব্যাপী ধানের গুড়া, ভুষি, নালিসহ বিভিন্ন উপাদান ক্রয় এবং শ্রমিক দিয়ে গরুর পরিচর্যা করতে গিয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। সব মিলে ৪টি গরু হাটে আনা পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তিনি জানান, তিন হাট ঘুরে বেতগাড়িতে এসে এখন পর্যন্ত চারটি গরুর দাম উঠেছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। যেখানে একবছর পর ৪টি গরুতে ৫০ হাজার লাভ হওয়ার কথা সেখানে খরচই উঠছে না। বড় কথা গ্রাহকই পাওয়া যাচ্ছে না।
গঙ্গাচড়ার বিনবিনার চর থেকে ওই হাটে দেশি গরু বিক্রি করতে এসেছেন শরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, মাস খানেক আগে বাড়িতে তার গরুটির দাম উঠেছিল ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু হাটে এনে ৬০ হাজার টাকার বেশি বলছে না। এ পর্যন্ত বুড়িরহাট, লালবাগ, তারাগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি হাটে গরুটি উঠিয়েছিলেন তিনি। আশা ছিল লাখ টাকায় বিক্রি করে জমি কিনবেন। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না।
Advertisement
হাটের পার্শ্ববর্তী আলমবিদিতর ইউনিয়নের মন্ডলেরহাট বাংলাপাড়া থেকে দুটি গরু বিক্রি করতে আনেন পল্লী চিকিৎসক নজরুল ইসলাম। তিনিও জানালেন আক্ষেপের কথা। বাড়িতে দুটি গরু ৬৪ হাজার টাকা দাম বলেছিল। কিন্তু পরে আর তারা আসেনি। এখন হাটে নিয়ে এসে বিকেল পর্যন্ত গরু দুটির দাম ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বলেছেন ক্রেতারা।
হাটে গরু কিনতে আসা চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সাহাবুদ্দিন জানান, গত সপ্তাহে ৩০টি গরু ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে যান। চট্টগ্রামে প্রতিটি গরু ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা করে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে।
নোয়াখালির ব্যবসায়ী আক্কাস ও জাকির বলেন, গত বছর প্রতি হাটে ৫ থেকে ৭ ট্রাক করে গরু ক্রয় করে নিয়ে গেছি। কিন্তু এবছর ৫/৭টি কেনারও সাহস পাচ্ছি না। কারণ এখান থেকে গরু কিনে নিয়ে গিয়ে ওইখানে গ্রাহক পাই না।
বুড়িরহাট এলাকার গরু ব্যবসায়ী লোকমান জানান, এবছর চাঁদ ওঠার আগে ৬৭ হাজার টাকা লগ্নি করে দুটি এড়ে গরু কিনে তিনহাট ঘুরে ১১ হাজার টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রি করেছেন। গত বছর জিলহজ্ব মাসের চাঁদ ওঠার আগেই ৬০ হাজার টাকা আয় করেছিলেন তিনি।
Advertisement
বেতগাড়ির হাটে ২০ বছর ধরে হাত দালালি করেন তারাগঞ্জ উপজেলার হাজিপুর বালাপাড়া গ্রামের আশেক আলী (৫০)। মূলত স্থানীয়ভাবে যারা গরুর লালন পালন করেন, তাদের কাছে আগে দরদাম করে পরে সেই গরু হাটে এনে বিক্রি করে লাভ করেন তারা। গতবছর এভাবে ২৬ হাজার টাকা কোরবানির সময় আয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু একছর এখন পর্যন্ত কোনো টাকা তার পকেটে ঢোকেনি।
তিনি জানান, দাম কম হওয়া এবং ক্রেতা না থাকার কারণে বাড়িতে দরদাম না করে গৃহস্থসহ (লালনপালনকারী) গরু হাটে নিয়ে এসেছি। কিন্তু ৩ হাটেও একটি গরু বিক্রি করতে পারিনি। অবস্থা এমন যে এই ব্যবসা বাদ দিতে হয়।
বেতগাড়ি হাটের ইজারাদার নুর শাহাদৎ বাবুল জানান, কোরবানির ঈদের দেড় মাসই থাকে আমাদের প্রধান টার্গেট। গত বছর কোরবানির আগে ১৬ হাটে গড়ে প্রায় দেড় হাজার করে গরু বেচাকেনা হয়েছে। কিন্তু এবছর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় পানি ওঠার কারণে ১৪ হাটে গরু বেচাকেনা হয়েছে গড়ে ৬০০ করে। ফলে এবছর ৮৭ লাখ টাকা দিয়ে হাট ইজারা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। তিনি জানান, গতবছর ২৫০ টাকা রশিদ হলেও এবছর তা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মতে, কোরবানির পশু বিক্রির উদ্দেশে এই বিভাগের আট জেলায় ১ লাখ ১০ হাজার ৫২০টি বাণিজ্যিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি ৩৩ হাজার ১৫৫টি এবং নীলফামারী জেলায় ১৭ হাজার ৫৮৬টি। রংপুর বিভাগের আট জেলায় এবারে ঈদে কোরবানির চাহিদা ৪ লাখ ২৮ হাজার ৫৭০টি।
স্থানীয় সরকারি পশু চিকিৎকদের সহযোগিতায় এবছর রংপুর বিভাগের আট জেলায় কোরবানিযোগ্য প্রায় ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯৬টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এরমধ্যে ছাগল ও ভেড়া ১ লাখ ৭৬ হাজার ১২৫টি এবং গরু, মহিষ, বলদ, ষাঁড় ও গাভী ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩৭১টি।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের রংপুর বিভাগীয় উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মাহবুবুল রহমান জানান, বন্যার কারণে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গরুর হাটে বিগত দিনের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে এবার। বেচাকেনা নেমে এসেছে অর্ধেকে। গরুর দামও কমে গেছে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। যার প্রভাব পড়েছে গরু পালনকারী ব্যক্তি উদ্যোক্তা, খামারি, রাখাল, ব্যবসায়ী, দালাল, ইজারাদার, খড় বিক্রেতা, ভ্যাকসিনসহ পথ্য সামগ্রী বিক্রেতা, ট্রাক, মালিক ও শ্রমিকদের উপর।
জিতু কবীর/এফএ/পিআর