জাতীয়

গরু ছাগল মানুষে অকৃত্রিম মেলবন্ধন

‘বাড়িতে দেড় লাখ টাকা খরচ করে গোয়ালঘর দিছি। সুন্দর করে চাড়ি (গরুর খাবারের জন্য ব্যবস্থা) বানাইছি। ফ্যান লাগাইয়া দিছি, মশারির ব্যবস্থা করছি। তারপরও রাতে কয়েল লাগায়া দেই, যেন মশা না কামড়ায়। কিন্তু নিজের থাকার জন্য কোনো ঘর নাই। ডেরায় (কুঁড়ে ঘর) থাকি।’

Advertisement

কথাগুলো বলছিলেন সেতাব সরদার। ঈদ উপলক্ষে কুষ্টিয়া থেকে ১৩টি গরু নিয়ে এসেছেন রাজধানীর মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের অস্থায়ী পশুহাটে। গত দু’দিন থেকে গরুর সঙ্গেই ২৪ ঘণ্টা থাকছেন তিনি। সকালের নাস্তা করার আগেই গরুকে ভূষি ও পানি খাওয়ান। রাতে ঘুমানও হাটে বেঁধে রাখা গরুর পাশেই।

সোমবার দিনগত মধ্যরাতে সেতাব সরদারের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ষাটোর্ধ্ব এই খামারি প্রতিবছর গরু নিয়ে ঢাকায় আসেন। এবারও এসেছেন।

তিনি বলেন, ‘নিজে না খেয়ে থাকতে পারি, কিন্তু গরুকে না খাইয়ে রাখি না। নিজের শরীরের যত্ন না নিলেও গরুর যত্নের কোনো ঘাটতি নেই। এই গরু বেরাহা (অনেক) আদরের। দরকার হলে বাড়ির গিন্নিকে (স্ত্রী) খবর দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসব। তবুও যেন গরুর কোনো সমস্যা না হয়।’

Advertisement

মিরপুরের এ পশুরহাটে রাজশাহীর আমির হোসেনও গরু নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ছোট ও শুকনা দেখে গরু কিনে আদর-যত্ন করে বড় করি। সেবার কোনো ঘাটতি রাখি না। এখানে এসেছি দু’দিন হলো। গরুর পাশেই রান্না করি, গরুর পাশে বসেই খাই। রাতে ঘুমও এসব পশুর পাশেই।’

রাত ১টা পর্যন্ত পশুর হাট সরজমিনে দেখা যায়, হাটজুড়ে অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছেন। কিন্তু গরু বা ছাগলকে রেখেছেন ছাউনির নিচে। কেউবা ছাউনির পাশেই খড়ের উপর ঘুমাচ্ছেন। মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখে নিচ্ছেন বিক্রির জন্য আনা গরুর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না।

আদরের এসব পশুর সঙ্গে মানুষের এ মেলবন্ধন আসলেই দারুণ। কোনো কৃত্রিমতা নেই। সামান্য মুনাফার আশায় যেভাবে সেবা তা কখনো ক্রয় করা সম্ভব না। এক একটা গরু খামারিদের কাছে পরিবারের সদস্যের চেয়েও যেন বেশি।

গরুর পাশে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন উজ্জ্বল হোসেন। তিনি জানান, এবার ১৯টি গরু নিয়ে এসেছেন। এখন পর্যন্ত একটিও বিক্রি হয়নি। আশা করছি, কাল (মঙ্গলবার) অথবা বুধবার থেকে বিক্রি শুরু হবে। কয়েকজন মিলে পর্যায়ক্রমে এসব গরুর যত্ন নিচ্ছি। এই সময়ে যত্নটা আরও বেশি নিতে হয়, এটাই নিয়ম।

Advertisement

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে হাটে ছাগল নিয়ে এসেছেন আহম্মদ আলী। বাজারে এখন পর্যন্ত তার ছাগলই সবচেয়ে বড়। জানতে চাইলে তিনি জানান, বড় ছাগলটি তার চাচার কাছ থেকে এনেছেন। দুই থেকে আড়াই বছর লালন-পালন করেছি। দাম চাচ্ছি ২৩ হাজার টাকা। তবে ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি ওঠলে ছেড়ে দেব।

তিনি আরও বলেন, বৃষ্টি বা অন্য কোনো সমস্যায় ছাগলের যেন কোনো সমস্যা না হয় এ জন্য সার্বক্ষণিক তদারকি করতে হয়। রাতে ছাগলের সঙ্গেই ঘুমাই। এতে একদিকে ছাগলের যত্ন নেয়াও হয়, নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়।

নিজের পালিত ৮টি মাঝারি সাইজের গরু নিয়ে এসেছেন আনসার আলী। প্রায় ১০০ কেজি মাংস হবে এমন একটি গরুর দাম চাচ্ছেন ৬৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘গরুর খাবার গ্রাম থেকে ট্রাকে করে নিয়ে এসেছি। এখানে গরুর খাবারের দাম একটু বেশি। রাতে গরুর সঙ্গেই থাকছি। গরু বিক্রির টাকায় দুই ছেলেকে কলেজে পড়াচ্ছি। গরু ছেড়ে কই যাব। এখানেই পড়ে থাকি।

এদিকে, এখনো গরু বিক্রি শুরু না হলেও অনেকেই পশুহাটে আসছে ধারণা নিতে। তেমনি একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দেয়ার তাগিদ রয়েছে। কোরবানির পশু যে একজন মানুষের পরিবার বা নিজের চেয়েও বেশি আদরের হতে পারে, এখানে না আসলে সেটা বুঝতাম না।

পশুর হাটে খামারিদের জন্য আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এমএ/বিএ/আরএস/জেআইএম