অর্থনীতি

বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে নতুন কোম্পানি

 

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের প্রতিষ্ঠান বিবিএস ক্যাবলস। শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের লেনদেন শুরু হয় গত ৩১ জুলাই। ইতোমধ্যে মাত্র ১৭ কার্যদিবসে প্রতিষ্ঠানটির ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়ে প্রায় দেড়শ টাকা হয়েছে। সেই সঙ্গে টানা দুই সপ্তাহ লেনদেনের শীর্ষ স্থানটি ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

Advertisement

অথচ প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে তৈরি করা প্রসপেক্টাসে কোম্পানিটি মিথ্যা ও বিভ্রান্ত তথ্য দেয়। তবে বিভ্রান্ত তথ্য দিয়ে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে প্রতিষ্ঠানটিকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি এবং লেনদেন শুরুর পর শেয়ারের দামেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

উল্টো বাজারে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিষ্ঠানটির দাম বেড়েছে হুহু করে। ফলে ১৩ কার্যদিবসেই প্রতিষ্ঠানটির ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়ে হয় ১৪৯ টাকা ৭০ পয়সা।

এরপর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিবিএস ক্যাবলস’র অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির উল্লম্ফনে ভাটা পড়ে। কমতে থাকে শেয়ারের দাম। তদন্ত কমিটি গঠন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে এখনও বিবিএস ক্যাবলস’র শেয়ারের দাম ১৩৫ টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে।

Advertisement

শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিনিয়োগকারী কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করেন না। তারা মূলত বাজারে যখন যে গুজব চলে এর ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করেন। ফলে বিভিন্ন চক্র বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটে। বিশেষ করে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা অতীতের থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট লেনদেনে ‘এন’ গ্রুপের বা নতুন তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত লেনদেন মোট লেনদেনের তিন থেকে চার শতাংশের মধ্যে থাকে। তবে গত দুই সপ্তাহ ধরে মোট লেনদেনে ‘এন’ গ্রুপের অবদান রয়েছে সাত থেকে আট শতাংশের ওপরে।

শেষ সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে (২০ থেকে ২৪ আগস্ট) ডিএসইতে যে লেনদেন হয়ছে এর আট দশমিক ২৬ শতাংশই ‘এন’ গ্রুপের কোম্পানির। বর্তমানে ‘এন’ গ্রুপে কোম্পানি আছে পাঁচটি। আর ডিএসইতে মোট লেনদেন হওয়া কোম্পানির সংখ্যা ৩৩৫টি। অর্থাৎ পাঁচটি কোম্পানি বা ১ দশমকি ৪৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে মোট লেনদেনের আট শতাংশের ওপরে।

‘এন’ গ্রুপে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো হলো- ফরচুন সুজ, নূরানী ডাইং, প্যাসিফিক ডেনিমস ও শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে ২৪ আগস্ট লেনদেন শেষে ফরচুন সুজের প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকা ২০ পয়সা। এছাড়া নূরানী ডাইংয়ের প্রতিটি শেয়ারের দাম ২২ টাকা ৬০ পয়সা, প্যাসিফিক ডেনিমস’র ২৩ টাকা ৭০ পয়সা এবং শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ৪০ টাকা ২০ পয়সা।

Advertisement

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, দেখা যাচ্ছে যখন একটি কোম্পানির নতুন লেনদেন শুরু হয় ওই শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি থাকে। গুজবই এর মূল কারণ। আর গুজবের কারণে হুট করে শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। এটা প্রমাণ করে আমাদের বিনিয়োগকারীরা যথেষ্ট পরিপূর্ণতা (দক্ষ) লাভ করেনি। তারা গুজবের ওপর নির্ভর করেই লেনদেন করছে। তবে যারা চালাক তারা দাম কমার আগেই বিক্রি করে দেয়।

তিনি বলেন, লেনদেনের শুরুতেই কোনো কোম্পানির দাম হুট করে বেড়ে যাওয়া বাজারের জন্য ভালো নয়। কিন্তু এটি বন্ধ করার কোনো উপায়ও নেই। কেউ যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাকে ঠেকাবেন কিভাবে? আর এই বাজারের ওপর খুব বেশি হস্তক্ষেপ না করাই ভালো। যদি দাম বেশি হয়, তবে তা কমে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। মানুষের ঠেকে শেখাই উচিত। আমাদের বিনিয়োগকারীরা যখন এমন বোকামি করছেন, তখন তাদেরই দায় নিতে হবে। অন্য কেউ এর দায় নেবে না।

গত বছরের ২০ অক্টোবর লেনদেন শুরু হওয়া ফরচুন সুজের ১০ টাকার শেয়ার প্রথম দিনেই লেনদেন হয় ৬০ টাকায়। এরপর কিছুদিন দাম কমলেও ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিটি শেয়ারের দাম ৬২ টাকা ৯০ পয়সায় পৌঁছে যায়। তবে এ পর্যায়ে এসে অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই কমেছে ফরচুন সুজের শেয়ারের দাম। ২৪ আগস্ট লেনদেন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকা ২০ পয়সা।

চলতি বছরের ১ জুন লেনদেন শুরুর প্রথম দিন নূরানী ডাইংয়ের শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ২০ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর দাম বাড়তে বাড়তে ১২ জুলাই তা ২৭ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পর্যায়ে এসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম কমতে থাকে। ২৪ আগস্ট লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা ৬০ পয়সা।

চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি লেনদেন শুরু হয় প্যাসিফিক ডেনিমস’র। ওইদিন লেনদেন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ২৬ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর ৫ মার্চ দাম বেড়ে হয় ২৮ টাকা ৬০ পয়সা। এরপর ধারাবাহিকভাবে দাম কমে ২১ মে ২১ টাকা ৩০ পয়সায় চলে আসে। তবে এ পর্যায়ে এসে আবার দাম বাড়তে থাকে এবং ২৬ জুলাই দাম বেড়ে হয় ২৬ টাকা ৯০ পয়সা। শেষ কার্যদিবস শেষে প্যাসিফিক ডেনিমের দাম দাঁড়িয়েছে ২৩ টাকা ৭০ পয়সা।

‘এন’ গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের লেনদেন শুরু হয় গত ৮ মার্চ। প্রথম দিনের লেনদেন শেষে প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৫৩ টাকা ১০ পয়সা। পরের কার্যদিবসে তা বেড়ে হয় ৫৫ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২৪ আগস্ট লেনদেন শেষে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকা ২০ পয়সা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এন’ গ্রুপের কোম্পানিগুলোর দাম ও লেনদেনের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, লেনদেন শুরু হওয়ার প্রথম কয়েকদিন দাম হুহু করে বাড়ছে। কিছুদিন দাম বাড়ার পর একপর্যায়ে এসে টানা দাম কমে যাচ্ছে। এমন হুট করে দাম বাড়ার পেছনে যেমন গুজব কাজ করছে, তেমনি রেগুলেটরি (নিয়ন্ত্রণ) দুর্বলতাও রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে না হওয়ায় নতুন কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এবং একপর্যায়ে এসে দাম কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ১০ টাকার একটি শেয়ার যখন ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা হচ্ছে, তখন কোনো তদন্ত কমিটি হচ্ছে না। কিন্তু যখন বিক্রি করে সবগুলো বের হয়ে যাচ্ছে এরপর তদন্ত কমিটি হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে? এদিক থেকে অবশ্যই এমন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাই দায়ী। তারা কেন অস্বাভাবিক দাম বাড়ার প্রথমেই তদন্তে নামে না?

তিনি আরও বলেন, এভাবে দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে বাজারে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী উচ্চ দামে শেয়ার কিনে মূলধন খোয়াবেন। যা সার্বিক বাজারেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিনিয়োগকারীদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, বাজারে এমন কিছু হয়ে যায়নি যে ১০ টাকার একটি শেয়ার হুট করেই দেড়শ টাকা হয়ে যাবে। গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করলে মূলধন হারানোর ঝুঁকিই বেশি থাকবে।

এমএএস/এমএআর/আইআই