নওগাঁর প্রত্যেক উপজেলায় সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী প্রথা ব্যাপক প্রভাব রেখে গেছে। উপজেলা মহদেবপুরেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মহাদেবপুরের জমিদার বাড়িগুলো এবং বর্তমান সামন্ত প্রভুরা তার নির্দশন হয়ে রয়েছে। এলাকার শিক্ষিত বয়স্কদের কাছ থেকে জানা যায়, মুঘল আমলে এখানকার জমিদাররা জায়গির লাভ করেন।
Advertisement
নওগাঁ, কাশিমপুর, কালিগ্রামের তখনকার জমিদাররা মুসলমান হলেও মহাদেবপুরের জমিদার ছিলেন রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। বর্গীর হামলার সময় তারা এই অঞ্চলে এসে কালক্রমে জায়গির লাভ করেন।
স্থানীয় বেশিরভাগ মানুষজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তারা নিজেদের মতো করে ঈদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করতে থাকলে, মহাদেবপুরের হিন্দু জমিদারের বিশাল আয়োজনে ঘটা করে পূজা-অর্চনা করা হতো।
মহাদেবপুরের খাজুরা ইউনিয়নের আদ্যাবাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে জমিদারের পক্ষ থেকে একটি মন্দিরও নির্মাণ করে দেয়া হয়। এই বংশের সর্বশেষ জমিদার হিসেবে রায়বাহাদুর নারায়ণ চন্দ্র রায় চৌধুরীর নাম শোনা যায়।
Advertisement
ওই মন্দিরে যেন এলাকার মধ্যে আকর্ষণীয় প্রতিমা তৈরি ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়, সেজন্য তিনি কড়া নির্দেশ দিতেন। জানা যায়, এলাকার যেখানেই বারুণির মেলা, চৈত্র সংক্রান্তিসহ অন্য কোনো উৎসব হতো, সেখানেই জমিদার বাড়ির কারও না কারও উপস্থিতি আবশ্যক হয়ে পড়ত।
কারণ উৎসব আয়োজনের খরচের বেশিরভাগ টাকাই আসত জমিদার বাড়ির দেয়া অর্থ থেকে। পাশাপাশি সুশৃঙ্খলভাবে উৎসব-আয়োজন শেষ করতে জমিদারের লোকজনরাও সহযোগিতা করতেন। জমিদার বাড়ির সর্বশেষ জমিদার রায়বাহাদুর নারায়ণ চন্দ্র রায় চৌধুরীর শিক্ষার প্রতি ঝোঁকের কথাও শোনা যায়।
শেষ বয়সে এসে ১৯১০ সালের দিকে তার মা সর্বমঙ্গলা দেবীর নামে মহাদেবপুরে একটি স্কুলও নির্মাণ করে দেন তিনি। সেই স্কুলের পাশে আত্রাই নদীর তীরে নতুনভাবে সাদামাটা এক ভবন নির্মাণ করে তিনি বাকি জীবন কাটান। সেখানে বসেই জমির বর্গা চাষিদের কাছ থেকে ফসলের হিসেব নিতেন তিনি।
মহাদেবপুর উপজেলা সদর হলেও, এখানকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধান এখানকার প্রধান ফসল। সাধারণত বেশিরভাগ জমি তিন ফসলি; যেখানে প্রতিবারই হয় ধান চাষ। তবে রায়বাহাদুর নারায়ণ চন্দ্র রায় চৌধুরীর পরের প্রজন্ম হিসেবে কিছু সামন্ত প্রভুর হাতে বেশিরভাগ জমির মালিকানা আর অল্প জমির মালিক হন বাদবাকি সাধারণ মানুষ।
Advertisement
এখানকার সামন্ত প্রভূদেরই একজন হাতেম আলী ওরফে হাতেম ডাক্তার। কোনো রকম চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও কেবল হাতেম নামের কারণে মানুষজন তাকে ছোট বেলায় হেকিম আরও পরে এসে ডাক্তার নামে ডাকত। এলাকায় কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা শুনলেই সেখানে ছুটে যেতেন তিনি। ঐতিহ্যবাহী মাসব্যাপী গুজিশহরের মেলায় লোকজন নিয়ে কয়েকদিনের জন্য তার যাওয়ারও কথা শোনা যায়।
প্রচুর জমির মালিক হাতেম এরই মধ্যে নওগাঁর ‘চিত্রবাণী লিমিটেড’-এ (পরে ‘তাজ সিনেমা’) ‘রূপবান’ দেখেন। চলচ্চিত্র দেখে বাড়ি ফেরার পর নিজের স্ত্রীকে রূপবান নামে ডাকতে থাকেন তিনি। হেয়ালি করে স্ত্রী তাকে একবার বলে বসে, ‘রূপবানের প্রতি যখন এত ভালবাসা, তখন রূপবানকে তো আমার সতীন বানালেই পারেন। আপনার তো আর ধন-সম্পদের অভাব নাই।’
স্ত্রীর কথা শোনার পর হাতেম আলী ভাবতে থাকেন, রূপবানকে তো আর পাওয়া অতো সহজ না। তবে রূপবানের জন্য সাধ্যের মধ্যে কিছু তো করাই যায়। সেই চিন্তা থেকে ১৯৬৮ সালে নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে মহাদেবপুরে দোকানপাটের বদলে নির্মাণ করেন ‘বুলবুল টকিজ’।
সেই প্রেক্ষাগৃহে নতুন চলচ্চিত্র প্রদর্শন না করে ‘রূপবান’ এর প্রদর্শনী করেন তিনি। প্রেক্ষাগৃহের নামটাও রূপবান রাখার ইচ্ছা ছিল হাতেম আলীর। কিন্তু তাতে করে রূপবানের প্রতি নিজের দুর্বলতা জনগণ জেনে যাবে এবং তা নিয়ে হাসাহাসি হওয়ার আশঙ্কায় তিনি তা না করে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের সময় বাবা মারা যাওয়ায়, তার নামেই নামকরণ করেন।
‘রূপবান’ প্রদর্শনের সময় প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নামে। আগে এই অঞ্চলের মানুষজনের চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল বয়সের সকল ধর্মের মানুষ আসতে থাকেন। অল্প কিছু মানুষের নওগাঁ কিংবা রাজশাহীর প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থাকলেও যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা ছিল কমবেশি সকলেরই। সেকারণে তারা মূলত প্রেক্ষাগৃহে যাত্রা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল।
‘বেহুলা’র প্রদর্শনীতেও একই ভিড় লক্ষ করা যায়। অল্পদিনের মধ্যেই এখানকার মানুষজনের কাছে ‘বুলবুল টকিজ’ পরিচিত নাম হয়ে যায়। দর্শক চাহিদার কারণে প্রত্যেক সপ্তাহে চলচ্চিত্র পরিবর্তন না করে দর্ঘিদিন ধরে একই চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী চলে। সেকারণে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত হাতে গোনা কিছু চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রাক্তন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল জলিলের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেন হাতেম আলী। আব্দুল জলিলের সঙ্গে যে ৭৪ জন ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে ৭ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করে, তিনি তাদের সঙ্গে শেষাবধি ছিলেন।
নওগাঁ সদরে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণের পর স্বল্প সময়ের জন্য পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি ফিরেন তিনি। এসময় নিজের ব্যবহৃত বন্দুকটি তার সঙ্গেই ছিল। দীর্ঘদিন পর বাড়িতে ফেরায় পরিবারের লোকজন তার আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে হাতেম আলীর শিশুপুত্র ওই বন্দুক নিয়ে নাড়াচাড়ার একপর্যায়ে স্ট্রিগারে পা রেখে তার ওপর ওঠার চেষ্টা করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
মহাদেবপুরে থাকা পাক হানাদার বাহিনী জেনে যায় হাতেম আলীর মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়ার খবর। পরের দিনই তারা হাতেম আলীর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে শেল নিক্ষেপ করে হানাদার বাহিনী। আগুনে বাড়িঘর পুড়ে গেলেও প্রেক্ষাগৃহের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এতে বারান্দার একাংশ ভেঙে পড়ে এবং টিনে আগুন লাগলেও স্থানীয় লোকজন তা নিভিয়ে ফেলে।
দেশ স্বাধীনের পর নিজের সন্তান হারিয়ে কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না হাতেম আলী। ওদিকে এক বারুণীর মেলা, যাত্রাপালা আর চৈত্র সংক্রান্তি ছাড়া এলাকার মানুষের আর তেমন কোনো বিনোদনের মাধ্যমও ছিল না।
ফলে এলাকার গণ্যমান্য অনেকেই হাতেম আলীকে প্রেক্ষাগৃহ আবার চালু করার অনুরোধ করেন। তারা এও বোঝান যে, প্রেক্ষাগৃহ চালু হলে তার সময় কাটানোর একটা জায়গা তৈরি হবে; তাছাড়া প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসাও তো কোনো অংশে কম লাভজনক নয়।
অবশেষে পরিচিতজনদের পীড়াপিড়িতে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রেক্ষাগৃহ সংস্কার করে চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করেন হাতেম আলী। কিছুদিনের মাথায় তার স্ত্রী হঠাৎ করেই মারা যান। এরপর এলাকার মানুষজন প্রেক্ষাগৃহটিকে দুষতে থাকেন, চাউর হতে থাকে নানা কথা। সম্ভ্রান্ত মুসলমান ঘরের ছেলে হয়ে প্রেক্ষাগৃহ করাটা ঠিক হয়নি বলেও অনেকের মন্তব্য।
হাতেম আলীর কানে আসতে থাকে, প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করাটাই একটা অলক্ষণে কাজ। এই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের শুরুতে নিজের বাবা মারা গেছে, এরপর ছেলে আর এখন পুনরায় চালু করার পর স্ত্রীও মারা গেল। দেরিতে হলেও হাতেম আলী নিজেও তেমনটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেন।
সেকারণে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় সত্ত্বেও ১৯৭৬ সালে এসে ইব্রাহীম বিশ্বাসের নিকট প্রেক্ষাগৃহ বিক্রি করে দেন হাতেম আলী।
কেএ/এলএ