সাহিত্য

একটি গায়েবি দিন রাত

এই যে গল্পটা, এটি রাতের গল্প। তাই শুরু হলো রাত তিনটায়। তিনটা বাজার জন্য অদ্বিতী বসে ছিলো কিনা, সেটি নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। তবে রাত একটা থেকেই তার চেষ্টা ছিলো গোসল সেরে ফেলার। সেই চেষ্টার সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরো ছিলো কিছু পরিকল্পনার তালিকা। চুল শুকাতে হবে, তবে ড্রায়ার ব্যবহার করা চলবে না, আলগোছে টেইবল ফ্যানে তীব্রতা কমিয়ে শুকাতে হবে চুল। ব্যাগে প্রয়জনীয় জামা-কাপড়, কবিতার বই ঢোকানো আছে। আর যাবে সেখানে টুথব্রাশ, পেস্ট, চিরুনি, ক্রিম জাতীয় টুকিটাকি। হোটেলে যদিও তার নামে একটি রুম রিজার্ভড আছে, তবে এসব জিনিস সে সাথেই নিয়ে যায়।

Advertisement

অদ্বিতীর মন থেকে থেকেই অস্থিরতায় ভুগছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কিছু যেন ফেলে যাচ্ছে, কিছু একটার অভাব। তবে সেটি কী তা বুঝতে পারছে না। মনের মধ্যে এরকম খচখচে শব্দ নিয়েই সে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। মৃদু ওম ওঠা গরম পানি মাথার তালু স্পর্শ করতেই তার মনে হতে থাকে, গরম পানির কারণে সব চুল পড়ে গেলো! মেরুদন্ডের কশেরুকা ভেদ করে তার তীব্র ব্যথা হয়। গরম পানি সেখানে যেন মায়ের হাত বোলানোর মত আরাম দেয়। চুল হারানোর চিন্তায় অদ্বিতীর ভাটা পড়ে। গরম পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে অদ্বিতী।

বেশ কয়েক বছর আগে স্কুলের এক সহপাঠী ওকে বলেছিলো, গার্লস স্কুলের হোস্টেলের স্নানঘর গুলোর ভেতরটা নাকি স্কুল বিল্ডিং এর জানালা থেকে দেখতে পাওয়া যেতো। হুজুর সাহেব সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন উছিলায়! ডান হাত দেয়ালে ছোঁয়ায় অদ্বিতী। চোখ খোলে। উঁহু, সে স্মৃতিতে সবুজ মাঠ পায়, দেয়ালের রঙ ঘিয়ে। তার জীবনে কোনো হুজুরের ছায়া মনে করতে পারে না। বাম হাতে তোয়ালে টেনে নেয় এবং ভেজা শরীর মুছে বের হয় সে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন গুলোয় প্রায়ই ডিস্ট্রিক্ট লাইনের রিপেয়্যারিং কাজ চলে। ভোরে উঠেই অদ্বিতীকে ট্রেইন ধরতে হবে লিভারপুল স্ট্রিটের। কিন্তু তার আগে বাসার সামনে থেকে বাসে তো ওঠা চাই! হাতে রাখতে হবে এক ঘন্টার মত বেশি সময়। ট্রেইন লাইন রিপেয়্যারিং এর কাজ চলছে মানেই অল্টারনেইটিভ প্ল্যান আছে মানুষের, তার মানেই হচ্ছে ভিড় ভাট্টা। রাত তিনটায় অদ্বিতী ফোনে অ্যালার্ম না দিয়েই শুয়ে থাকে চোখ বুজে। আড়াই ঘন্টা হয়তো কিছুটা ঘুমিয়েও নেয় এবং ছয়টায় বিছানা থেকে নামে। ঘরে পরা স্যান্ডেল ব্যাগে তোলে। একটা ব্রেইডে বাটার ঘষতে ঘষতে জামা জুতো পরে। ঘরের চাবি নেয়, ট্র্যাভেল কার্ড নেয়। খুব দ্রুততায় মুখ ধুয়ে বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে।

Advertisement

লিফট থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে দুই পা হেঁটেই প্রধান দরজা। হিম ও একরোখা বাতাস গালে, চোখে এসে দিনের আলোর জানান দেয়। ওর প্রতিবেশী বিল্ডিং গুলো তখনো ঘুমিয়ে। ল্যাম্পপোস্টে দুইটা পাখি দুইদিকে মুখ করে বসে আছে। বড় রাস্তার অপর পাশে সবজি বাগান। তাতে এককোণে বেশ কিছু সূর্যমুখি, জিরাফের মত গলা উঁচু করে হাসছে মনে হলো। সূর্যের ম্রিয়মান আলো বলেই হয়তো সেই হাসি অদ্বিতীর বিরক্তিকর ঠেকল কিঞ্চিৎ। ফোনে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবু কেন এত ঠান্ডা লাগছে তার, বুঝতে পারল না। অদ্বিতী যাত্রী ছাউনিতে দাঁড়িয়ে ডানে বামে দেখতে লাগল। একজন, দু’জন মানুষ এলো, সঙ্গে এলো বাস। আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে সিটুসিতে চেপে লিভারপুল স্ট্রিট হয়ে কিংস ক্রস স্টেইশনে ঝামেলাহীন পৌঁছাতে পারলো সে। তারপর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চাপল ভার্জিনে। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই সে নামতে পারল লিডসে। স্টেশনে ওকে তুলতে আসে কালো এক ক্যাব। অদ্বিতী ক্যাবে উঠে বসে। রাত দুইটা। অদ্বিতী চোখ খুলে হতচকিত, সময় বুঝতে চায়। কোথায় আছে সে জানেনা। ফোনের লক স্ক্রিনে জিপিআরএস সাইন। সে চেষ্টা করে ফোনে মৃদুলকে কানেক্ট করতে। ব্যর্থ হয়। গলায় পাকিয়ে ওঠা শংকা, সেটিকে অগ্রাহ্য করার প্রাণান্ত চেষ্টা নিয়েই ড্রাইভারের কাছে জানতে চায়, ‘ভাই, আমরা কোথায় আছি?’ ড্রাইভার পেছনে ঘাড় ঘোরাতেই অদ্বিতী চিৎকার করে ওঠে, ‘সামনে দেখেন!’ প্রচন্ড জোরে হর্ন চেপে ড্রাইভার পাশ কাটায় মেয়েটার! ওরকম মধ্যরাতে মেয়েটা সুনসান রাস্তায় কোত্থেকে এসে দাঁড়াল, অদ্বিতী যোগসূত্র পায়না কোনো!

গাড়ি বেশ খানিকটা সামনে চলে গেছে। অদ্বিতী ঘোর অন্ধকারে পেছনে কেউ থেকে গেলো কিনা, বুঝতে পারেনা। এবার ড্রাইভার বলে, ‘আপু, ভয় পেয়েন না। আমি আলম। আপনাকে লিডস স্টেশনের সামনে থেকে তোলার পর সাথে সাথে আছি। আপনি ঘুমালেন। তাই জাগাইনাই। ঘুরতেছিলাম এখানে সেখানে।’ অদ্বিতী কি বলবে বুঝতে পারেনা। তার আশ্চর্য হবার ক্ষমতাও সেই মুহূর্তে কাজ করেনা। সে হ্যান্ডব্যাগ হাতড়ে দেখে, কিংবা হয়তো খোঁজে কিছু। কোনো অবলম্বন, যা বিপদে কাজে লাগতে পারে। অদ্বিতী মনে করতে শুরু করে, লিডসে সে এসেছে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। দুপুর বারোটায় ভেন্যুতে থাকার কথা তার। কিন্তু কি এমন হলো যে পুরো দিন পেরিয়ে এরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে নিতান্ত অপরিচিত একজন লোকের পেছনে বসে কোথায় কোথায় যেন চলে যাচ্ছে সে! তার সকালের সেই হিম বাতাস গালে লাগা অনুভূতি ফিরে আসে। কিছুই মনে পরে না আর! আবারো রাজ্যের ঘুম, যেন চোখ খুলে রাখাই দায় করে দিচ্ছে ওর জন্য!

একটা নদী। নদীর পানি ঘোলাটে বর্ণ। বড় বড় কচুরিপানা প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। গেলো রাতে একটা গ্রাম নাকি নদীগর্ভে তলিয়েছে! অদ্বিতী দাঁড়িয়ে উঁচু ঢিবির উপর। হঠাৎ গ্রামীণ চেকওয়ালা সাদা-নীল রঙের লুঙ্গি আর সাদা হাফ হাতা শার্ট পরে একটি ৩৪/ ৩৫ বছর বয়সী ছেলে নদী থেকে একটি অজগর নিয়ে এসে অদ্বিতীর হাতের তালুর অপর পিঠে সেটির মুখ চেপে ধরল। অদ্বিতী বলল, ‘কামড়ে দেবে তো!’ ছেলেটি বলল, ‘ভয় নাই, দিবে না।’ তৎক্ষণাৎ সাপটি খুবলে খেলো ওর হাত! ‘আপু, আপুউ, আপুউউউ’- ক্রমশ উচ্চস্বরে আবারো চোখ মেলল অদ্বিতী। চোখের সামনে আলম সাহেব। - ‘আপু, আপনার কবিতা পড়া বেশ ভাল ছিলো। আপনাদের থাকার ব্যবস্থা এই হোটেলেই হইসে। আমি যাই।’

অদ্বিতী হাল্কা করে ধন্যবাদ জানালো তাকে। যদিও তখনো কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না সারাদিন কোথায় ছিলো সে! রিসেপশান থেকে তাকে জানালো রুম নাম্বার দুইয়ে ও থাকবে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে রুমে ঢুকল অদ্বিতী। চারপাশ দেখে নিয়ে কাপড় ছাড়লো সে এবং ডুভেটের নীচে ঢুকে গেলো। পাশের রুম থেকে গান শুনতে পাচ্ছিল ও। আলো নিভিয়ে অন্ধকারে এরকম অপরিচিত শহরের আকাশ ছুঁয়ে, জানালার পাশে দাঁড়ানো ঘন গাছের সারি, সেগুলোর পাতার নড়ে ওঠার ভঙ্গিমায় অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে অদ্বিতীর মনে হলো, যেই দিন গেছে, সে না হয় এভাবেই গেছে। আর তা নিয়ে ভেবে কালক্ষেপণ করবে না। ডুভেট দিয়ে দুই পা ভাল করে মুড়িয়ে ঘুমালো সে রাত।

Advertisement

সকালে ১০ টা বাজলে দরজায় টোকা। -কে? ওপাশ থেকে শব্দ আসে লাবণী দি’র। ‘অদ্বিতী, তোমার জন্য ক্রোয়েসেন্ট, কলা আনলাম। সকালের নাস্তা। হোটেলের নাস্তা বাজে। নাও, আসো।’ দরজার কিছু অংশ খুলে অদ্বিতী দাঁড়ায়। ‘লাবণী দি, গুড মর্নিং, থ্যাংক ইউ! এর দরকার ছিলো না। আমি আচ্ছা, দাও, কলাটা রাখি। কিন্তু আর লাগবে না কিছু। ওরেও খেয়েছি।’ লাবণী দি হেসে চলে যায়। অদ্বিতী ভাবে, আবারো ডেকে কালকের শো নিয়ে জানতে চাইবে। যদি সে কিছু বলতে পারে ওর পারফরমেন্স নিয়ে, তবেও সে নিশ্চিত হয় একটা গায়েবী দিনের ব্যাপারে। অনেক কষ্টে নিজেকে দমায় অদ্বিতী। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চোখের নিচে কাজলের কালি, ঠোঁটে লেপ্টে আছে কিছুটা লিপস্টিক তখনো। চুল সব এলোমেলো। -‘তুমি কাকে দেখলে কাল অদ্বিতী? মনে করতে পারো? ওরকম নিশুতি রাতে, কেন সে মেয়ে ওইখানে? উফ!’ অদ্বিতী তাকেই প্রশ্ন করে আনমনে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে সেদিন! রাতের আঁধারে দেখা সেই একই রুপ গাছ, তবে অদ্বিতীর পা এখন মাটিতে, খোলা। দরজায় আবার টোকা। -’অদ্বিতী, রেডি তুমি? আমরা বেরুব। চলো যাই!’ -‘আসছি দিদি।’ লাবণী দি’কে উত্তর দেয় ও। এর মাঝেই রুম ক্লিনিং এর দুইজন স্টাফ এসে গেছে। ওরা ঘরের বিনটাকে দেখে হাসে। বেশ কিছু চুল সেখানে জমেছে। চুল যতক্ষণ মাথায় আছে, বড় যত্নের। কত না গন্ধে, রঙে, ক্লিপ, ব্যান্ডের কারুকার্যে সজ্জিত! চুল নিয়ে কত গান, কত কবিতা। চুল মাথা থেকে পড়েছে মেঝেতে তো অস্পৃশ্য, নোংরা। হাত ধুয়ে তবে কিছু খাও, ভাবে অদ্বিতী। চোখাচোখি হয় ক্লিনারদের সাথে। ওরা ওদের মাতৃভাষায় কথা বলছিল, হাসছিল খুব। ওদের পরণে ছিল লম্বা স্কার্ট, মলিন টি শার্ট। দাঁত ও চুল নোংরা লাগছিল দেখে। অদ্বিতী ওদের সম্ভাষণ জানিয়ে সিঁড়ি ধরে নামে হোটেলের লাউঞ্জে।

হোটেলে রাত কাটানো সবাই একজন একজন করে সেই লাউঞ্জে নেমে এলেন। এই সেই আলাপের মাঝে সবার মাঝে একটা বিষয় দেখে খুব গোলমেলে ঠেকছিল অদ্বিতীর। কেমন চাপা অস্বস্তিতে সবাই! কে কেমন করে আজ বাড়ি ফিরবে, সেই নিয়ে কথা চলছে। ঠিক তখনই অদ্বিতীর মনে হলো, একবার কালকের শো নিয়ে জিজ্ঞেস করেই নিবে সাহস করে। পরমুহূর্তেই ঢোলক নিতাই দা জানতে চাইলেন, ‘এই যে সবাই, কাল শো কেমন গেলো?’ এবার সবার চাপা অস্বস্তি যেন প্রকট। কারো রাখঢাক থাকল না যে! লাবণী দিই গলা ছেড়ে কাশলেন, ‘গেলো রাতে ব্র্যাডফোর্ডে মাঝরাস্তায় ভূত দেখেছি গো!’ সবার তো চোখ কপালে তখন! সবাই চিৎকার করে উঠল, ‘কি যে বলো সব!’ অদ্বিতী এবার এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘লাবণী দি, বলো তো পুরো ঘটনা!’

লাবণী দি বললেন, ‘রাত তখন আড়াইটার মত। আমার খুব গলায় খুসখুসে কাশি লাগছিল। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছি। হঠাৎ মাঝরাস্তায় যেন লিফট চাইছে এরকম করে হাত বাড়িয়ে একটা তরুণ ছেলে একেবারে গাড়ির সামনে এসে গেছে প্রায়। কষে হর্ন দিয়ে আমি ছুটে এলাম যেন। কিন্তু আমার পেছনের গাড়িটিও চলে এলো। মিররে কেউ নাই ততক্ষণে পেছনে।’

লাবণী দি থামলেন, যেন কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘কিন্তু তার আগে সারাদিন যে কি হয়েছিল, কেমন করে গেল, কেউ জানতে চেওনা! কিছু মনে নাই!’

সব শিল্পীরা বাড়ি ফিরে এলো। লিডসের স্থানীয় পেপারগুলোয় ফলাও করে ওদের উৎসব নিয়ে খবর ছেপেছে, তাতে চমৎকার উপস্থাপনার বর্ণনা! সেখানেই শিল্পীদের ছবির পাশে আবছা আঁধারে ছাপানো একটি ছেলে ও মেয়ের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যও দেখল সবাই। তবে শিল্পীরা ছাড়া তা আর কেউ দেখতে পায়নাই।

এইচআর/এমএস