দুপুরের পর ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। পূর্ব আকাশে খানিক কালো মেঘ থাকলেও গোটা আকাশ খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের দখলে। শরৎ বিকালের যে রূপ, এদিনেও তার দেখা মিলছে। আকাশের উচ্চতাও বাড়িয়েছে নীল আর সাদায় মিলে।
Advertisement
নবগঙ্গা নদীর কালনী ঘাটটি একেবারেই লোকালয়ের মধ্যে বলা যায়। নামের সঙ্গে ঘাট আর নদীর রূপের অসম্ভব মিলও রয়েছে। নদীতে স্রোতের টান কম। পানি প্রায় দু’কূল উপচে পড়ছে। উত্তরের বানের পানি নবগঙ্গায় মিশে একাকার। আর এতেই পূর্ণ যৌবনে ফিরেছে নদীবক্ষ।
ঘাট পারাপারের জন্য জনাকয়েক অপেক্ষা করছেন এপারে। গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়া হয়ে ওসি অফিসের সামনে থেকে উল্টো দিকে কালনী ঘাটের সড়ক। অটোরিকশায় আসতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার পথ। মধুমতি নদী পার হতেই নড়াইল জেলার সীমানা। এরপর নবগঙ্গা। জনপ্রতি তিন টাকা নিয়ে স্যালোর নৌকায় ঘাট পার করে দেয় মাঝিরা।
এপারে এসেই যেন কবিয়াল বিজয় সরকারের সুর-ছন্দের আবহে প্রকৃতি রূপের দেখা মেলে। তখন সূর্য রক্তিম হয়েছে সবে। গ্রাম চিড়ে বয়ে চলা নবগঙ্গার দূরপ্রান্ত সূর্য ডোবার সকল আয়োজন চলছে। শেষ বেলার সূর্য কিরণ এসে ঢেউয়ে মিলে খেলা করছে। তাতে পানিতে রুপা ফলছে, আবার ঢেউয়েরা কখনও কখনও রঙিন হয়ে উঠছে।
Advertisement
দিবসের এমন অন্তিমকালে সাধক বিজয়ের লেখা- “কবে আমার তীরে ভিড়াবে নাও ধীরে ধীরে বাইয়ারে, ওরে আমার জীবন নদীর নাইয়ারে”
গানটির সুর যেন দূর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে। নদীতে মাছ ধরার ছোট ছোট ডিঙায় ভর করে জেলেরা জাল ফেলছে। রাতে জেলেদেরই দখলে থাকবে নবগঙ্গা।
নয়ন ভেজা জলসায় বিজয় প্রেমের কীর্তন
নবগঙ্গা নদী পার হয়ে গোবরা গ্রামে আসতে ভ্যান-ই প্রধান বাহন। তবে অটোরিকশাও হয়েছে এখন। আরও দ্রুত আসতে চাইলে মোটরসাইকেল ভাড়া করতে হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল বলে ভরসা হল মোটরসাইকেলে। মিনিট বিশেক চালিয়ে গোবরা বাজারে নামিয়ে দিল চালক।
Advertisement
গ্রামের মধ্যখানে ছোট্ট বাজার। সন্ধ্যাবাতি জ্বলতে শুরু করেছে দোকানে দোকানে। বিকালের বৃষ্টি তখনও ভিজিয়ে রেখেছে পাকা সড়কটি। বাজার থেকে তীর ছোড়া দূরত্বে চিত্রা নদী। চিত্রার অপরূপ চিত্র চোখে না দেখলে বোঝানো দায়। নদীরূপ নড়াইলের এই পল্লীপ্রান্তকে যে কিভাবে সাজিয়েছে, তার প্রমাণ মিলছে চিত্রার দু’কূলে।
বাজারে নেমে বাউল বিজয় সরকারের শিষ্য প্রভাত বালার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘ও ঠাকুর, তোমার কুটুম এসেছে গো’। প্রভাত বালা অপেক্ষা করছেন বিকাল থেকে। প্রভাত বালার ছেলে প্রতাপ বালাই আমাদের পাঠিয়েছেন। প্রতাপ বালার সঙ্গে পরিচয় টুঙ্গিপাড়ার ঘোনাপাড়ায় টমা গ্রুপের ক্যাম্পে। প্রতাপ বালা সেখানে রেলপথ নির্মাণে ভারি যান চালান।
ক্যাম্পে রাতের বেলায় বিজয় সরকারের কথা উঠতেই যেন চমকে উঠলেন প্রতাপ বালা। বললেন, ‘দাদা বিজয় সরকারের বাড়ি যাবেন? আমার বাবা আপনাকে নিয়ে যাবেন। বাবা বিজয় সকারের একজন শিষ্য। বিজয় সরকারের গান নিয়েই বাবা বেঁচে আছেন। আপনি চলুন, বাবাই সব ব্যবস্থা করবেন।’ আমাদের ঘুমে রেখে সকালেই প্রতাপ বালা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন নড়াইলের গোবরা গ্রামে।
প্রভাত বালার আধা কাঁচা চুল। গলায় তুলসী মালা। গেরুয়া রঙের ফতুয়া। ধুতি পরেছেন বেশ পরিপাটি ঢঙে। হাতে কাঠের ডাটের ছাতা। পরিচয় পেয়েই পরম বিনয়ে প্রণাম করতে চাইলেন প্রভাত বালা। বয়সে ছোট বলে তার অমন সৌজন্যবোধে মনে অস্বস্তি ঠেকছিল।
আকাশ মেঘলা দেখে কথা না বাড়িয়ে রওনা দিলেন সঙ্গে নিয়ে। প্রভাত বালার মধ্য বয়স পার হয়েছে আরও কয়েক বছর আগে। তবে শরীরের কাঠামো বেশ সুঠাম। ক্ষেত-খামারেই যে জীবনের ঘানি টানছেন, তা শরীর-ই বলে দিচ্ছে। রোদে পুড়ে চামড়া প্রায় কুচকুচে কালো। হাঁটার গতি ধীর।
খানিক হেঁটেই রাস্তার মোড়ে বটতলায় ডা. খোকন বিশ্বাস নামের এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা। আলাপ তুললেন, জন্মাষ্টমী উপলক্ষে খোকন বিশ্বাসের গ্রামের মন্দিরে কীর্তনের আয়োজন প্রসঙ্গে। পরের দিন ওই অনুষ্ঠানে প্রভাত বালা-ই গাইবেন বলে জানালেন খোকন বিশ্বাস। তবে তাতে আপত্তি জানালেন প্রভাত বালা। বললেন, সাংবাদিকরা (পরিচয় করিয়ে দিয়ে) ঢাকা থেকে এসেছেন। তাদের নিয়ে ডুমদি গুরুর (বিজয় সরকারের বাড়ি) বাড়ি যাব?
বিজয় সরকারের নাম মুখে আনতেই খোকন বিশ্বাসের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। গলাও ধরে আসল। প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে হাতের জামা তুলে দেখালেন খোকন বিশ্বাস। গায়ের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেছে। চোখ ছলছল। কথাও সরছে না। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘বিজয়! ও নাম শুনলে বোধ থাকে না গো। দেহ-মন মূর্ছা যায়। হরি নামের কীর্তন এ ধরায় আর ওভাবে কে গাইতে পারে?’
হিন্দুপাড়ায় বেশ শিক্ষিতজন নামে পরিচিত খোকন বিশ্বাস। বয়স হলেও শব্দ ও ভাষা প্রয়োগে বেশ দখল রয়েছে তার। বিজয় প্রেমে আসক্ত এই শুদ্ধ পুরুষ বলছিলেন, ‘শৈশব থেকেই বিজয়বাণী শ্রবণের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। স্বয়ং ঈশ্বরের কৃপা না থাকলে কেউ অমন বাণী রচনা করতে পারেন না। আহা! কী সুর! সুরে কী মধু! প্রতি বছর গ্রামের কীর্তনে গাইতেন বিজয় সরকার। একালে তার মতো প্রজ্ঞাবান বাউল কবির দেখা পাওয়া ভার। কোনো কোনো বছর একাধিকবার গাইতে আসতেন বিজয় সরকার। দূর গ্রামের কোথাও তার গান হলে আমরা দল বেঁধে যেতাম। কৈশোর, যৌবন এমনকি পরিণত বয়সেও বিজয় সরকারের স্বকণ্ঠে গান শোনার সুযোগ হয়েছে। ভারতে চলে যাওয়ার পরও আমাদের গ্রামে কয়েকবার কবি গান গাইতে আসেন। তাকে ঘিরেই আমাদের যত আয়োজন চলত। বিজয় সরকারের সমীপে ভক্তিকথা বলে কখনও প্রাণ জুড়াবে না আমার।’
বটতলায় দাঁড়িয়ে ১০ মিনিটের আলাপ খোকন বিশ্বাসের সঙ্গে। আর তাতেই যেন বিজয় সরকারের সৃষ্টিকথার সমস্ত ডালা মেলে ধরলেন। জন্মাষ্টমীর ওই অনুষ্ঠানে তার মন্দিরে প্রভাত বালা গাইবেন বলে আশ্বস্ত করে খোকন বিশ্বাসের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
প্রভাত বালার পায়ে তাল মিলিয়ে কয়েক কদম ফেলতেই কাদাপথে পা রাখতে হল। সাবধান করে দিলেন প্রভাত বালা। বললেন, ‘বাড়ি যেতে খুব কষ্ট হবে গো। গ্রামের ওই প্রান্তে বাড়ি। সমস্ত রাস্তাই কাদায় ভরা। এ বাড়ি, ও বাড়ির উঠান-আঙ্গিনা মাড়িয়ে যেতে হবে। আমাদের হিদুপাড়া। আমাদের ভোট নিয়ে রাজনীতি হয়। কিন্তু গ্রামের উন্নয়ন হয় না।’ একটি বাক্যেই হাজারও ক্ষোভের প্রকাশ।
কাদামাটি বটে। তবে গাও-গ্রামের সত্যিকার যে রূপ তার কোনোটিরই ঘাটতি নেই দক্ষিণ গোবরার এ পাড়ায়। মাটির ঘ্রাণে মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কাদা মাড়িয়ে রাস্তা পার হতে পারলেও বাড়িগুলোর উঠান পার হওয়া ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। শেওলা জমে ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল প্রতিটি উঠান।
হিদুপাড়ার রাস্তার বেহাল দশা
পাড়ার একটি পুরনো বাড়ির এমন উঠানের মাঝখানেই শানবাঁধানো তমাল গাছ। গাছের বয়স কত, তা পাড়ার কেউ আর বলতে পারে না। প্রভাত বালার বাপ-দাদারাও নাকি অমন রূপ দেখেছেন গাছটির। শানবাঁধানো গাছের গোড়ায় কয়েকটি ঘটি-বাটি। অন্যদিনের মতো আজও সন্ধ্যাপূজা মিলেছে তমাল তলায়। সবুজ পাতায় পুরো বাড়ি ছেয়ে রেখেছে একটি গাছই। প্রকাণ্ড গাছটির আগা-গোড়াই কালো। পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায় এ গাছেই নাকি শ্রী কৃষ্ণের রূপ দেখতে পান।
প্রতি বছর ফাল্গুনে দোল উৎসব হয় তমাল তলায়। তমালের বাহু ভেদ করে নিমের গাছটি উঠে গেছে মগডাল বরাবর। নিমের আশীর্বাদ জানে সবাই। নিমে-তমালে মিলে যেন রাধা-কৃষ্ণের যুগল মিলন ঘটেছে এ পাড়ায়।
প্রভাত বালার সাবধানে চলার পথ অনুসরণ করে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত বাড়ির দেখা মিলল। আয়োজনের কোনও ঘাটতি ছিল না গৃহকর্ত্রীর। রাতের খাবার সেরে আর সময় নিলেন না প্রভাত বালা। বারান্দাতেই পাটি বিছিয়ে জলসার আয়োজন। ছেলে প্রতাপ বালা ঢোলে ঝড় তুললেন। হারমোনিয়ামে নিপুন হাতে সুর ব্যঞ্জনার বিকাশ ঘটাতে থাকলেন প্রভাব বালা নিজেই। আর তার স্ত্রী টুনি বালা মুন্দিরায় তাল মেলালেন।
‘তুমি জানো নারে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা’ সাধক বিজয় সরকারের সেই বিখ্যাত গান দিয়েই আসর শুরু করলেন। বিজয় সরকারের কাছ থেকে শুনেই প্রথম গানটিই শিখেছিলেন প্রভাত বালা। সমস্ত আবেগ ঢেলে দিয়ে সুর-ছন্দে আসর জমালেন অল্প সময়েই। ততক্ষণে ঢোলের বাড়ি পৌঁছেছে পাড়ার অন্য ভক্তদের কানেও। বিজয়ের ভক্তরাও এসে আসরে অংশ নিলেন।
এরপর শুধুই গান আর গান। বিজয়ের মহাজনী বাণীতে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হল আসর ঘিরে। যিনি গাইছেন তারও চোখ ছলছল, আর যারা শুনছেন তাদেরও চোখ ছলছল। এভাবেই মধ্য রাত গড়িয়ে গেল। সেই ভুবন ভোলানো আসরে প্রভাত বালার কণ্ঠে শুধু বিজয় সরকারের সুর-ই যে ভর করেছিল, তা অন্যরাও জোর দিয়ে বললেন।
শানবাঁধানো তমাল গাছ
বাড়ি নয়, যেন সাধনকুঞ্জ
“এই পৃথিবী যেমন আছে তেমন পড়ে রবেসুন্দর এই পৃথিবী একদিন ছেড়ে যেতে হবে।”
কবিয়াল বিজয় সরকারের অমর বাণী। এমন আধ্যাত্মিক আর ভাববাদী গানেই মানুষ সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। দুনিয়াবি মোহ ছেড়ে পরমাত্মায় মন সপে দিতে ভাবসাগরে তরী ভাসায়। সুফি বা বৈষ্ণববাদের ধারা থেকেই বাউলতত্ত্বের উদ্ভব বলে মনে করা হয়। আর বৈষ্ণববাদী বাউলকূলে কবিয়াল বিজয় সরকার হচ্ছেন প্রাণ পুরুষ।
সাধুজন বলেন, পরমাত্মায় আত্মা মেলাতে সাধন-ভজনে মন বসাতে হয়। আর সাধনার জন্য প্রকৃতির সঙ্গেই নাকি বাসা বাঁধতে হয়। সাধক বিজয় সরকার তেমন-ই এক বাসা বেঁধেছিলেন, যা ছিল তার ‘সাধনকুঞ্জ’।
গোবরা গ্রাম থেকে খানিক দূরেই চিত্রানদী। এরপর উজিরপুর। উজিরপুর হয়ে নড়াইল সদর ছেড়ে কবিয়ালের বাড়ি আসতে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ। দ্রুত আসতে চাইলে মোটরসাইকেল ভাড়া নিতে হয়। এ বাহনে আধা ঘণ্টাতেই ডুমদি গ্রামের সীমানা মেলে। খানিক গিয়ে মোটরসাইকেল রাখতে হয়। এরপর পায়ে হেঁটে কাদা-পানি মাড়িয়ে প্রায় আধা মাইল গেলেই বিজয় সরকারের বাড়ি।
বিলের মাঝখানে ৫২ শতাংশ ভিটার ওপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে বিজয় সরকারের হাতে গড়া সেই পুরনো ভবনটি। ভবনের দুটি কক্ষ। কেউ আর থাকে না তাতে। ভবনের পলেস্তারা খসে ইট বাইরে চলে এসেছে। বারন্দাতেও বেশ কয়েকটি গর্ত। চালের টিন ফুটো হয়েছে আরও আগেই। কাঠের দরজায় বাইরে থেকে কঞ্চি দিয়ে খিল দেয়া। বিজয় সরকার যে কক্ষে শয়ন করতেন, সেখানে একটি খাট প্রায় ভঙুর হয়ে পড়ে আছে। অপর কক্ষে কী সব রাখা আছে, তাতে মানুষের ঢোকার জো নেই। বারান্দা ঘেঁষে একটি ছোট মন্দির। মন্দিরের পাশে কামেনি আর জবা ফুলের গাছ। সামনে কয়েকটি গাঁদা ফুলের গাছও আছে। এখান থেকেই ফুল তুলে পূজা মেলে মন্দিরে।
শেষ কবে পূজা হয়েছিল মন্দিরে, যিনি পূজাপর্ব সারেন তিনিই বলতে পারবেন। পূজার ফুলগুলো শুকিয়ে থালায় মিশে গেছে। বিজয়ের কোনো এক কালের একটি ছবি পড়ে আছে মেঝেতে। তবে বিজয় সরকার ব্যবহৃত এক জোড়া খড়ম (চটি) কাঁচের বাক্সে রাখা আছে। পূজা মেলে বটে, তাতে অবহেলা আর অযত্ন যে আছে, তাও বুঝতে কষ্ট হল না।
যত্ন করবেই বা কে? ভিটার এক কোণে থাকেন বিজয় সরকারের চাচাতো ভাই নটবর অধিকারীর এক মেয়ে ও মেয়ের জামাই। তাদের ঘরে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিও আছেন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের। পূজা-অর্চনার চাইতে পেটপূজাতেই ব্যস্ত থাকেন তারা।
উঁচু-নিচু ভিটাটি আগাছায় ভরা। বনোজ গাছও আছে কয়েকটি। বেশ কয়েকটি গরু ঘাস খাচ্ছে ভিটার নানা প্রান্তে। ঘরের পেছনে একটি খেজুর গাছ, যেটি কবিয়ালের নিজ হাতে লাগানো। বিজয় সরকারের বাড়ির কাছে কয়েক ঘর নমশুদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের। সব মিলে ২০ ঘর হবে হয়ত।
দেশ ভাগের আগে এখানে এক ঘর মুসলমানও ছিল না। বিজয় সরকারের বাড়ির আশেপাশেই পাঁচটি পাড়া ছিল হিন্দুদের। দেশ ভাগ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাঁচটি পাড়াই উধাও হয়েছে। মুসলমানদের কাছে ভিটামাটি বিক্রি করে সবাই ভারতে চলে গেছেন।
স্বাধীনতার পাঁচ কি ছয় বছর পর ভারতে চলে যান বিজয় সরকারও। তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সবাই প্রায় ওপারে। ছেলে কাজল আর বাদল একবার এ দেশে এসে বাবার ভিটা দান করে গেছেন বিজয় সংসদকে। নড়াইল পৌরসভার দেখভাল করার থাকলেও, তাদের কোনো নজর আছে বলে মনে করার কারণ নেই।
ভিটা ঘুরে দেখার একপর্যায়ে সঙ্গ দেন বিজয় সরকারের ভাতিজি জামাই বিমল সিকদার। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া অবস্থা। পরিত্যক্ত ভবনটির বারান্দায় বসেই কথা হয় বিমল সিকদারের সঙ্গে। বলেন, ‘আমার শ্বশুর মশাইরা ভারতে চলে যাওয়ার পর আমি এখানে এসেছি। যে চেয়ারে বসে কথা বলছি, এটিতেই বসতেন বিজয় সরকার। তার গান লেখা ছিল সাধনার মধ্য দিয়ে। হারিয়ে থাকতেন দিনের পর দিন। এই যে বিল দেখছেন, তার মাঝখানে নৌকা বেঁধে গান লিখতেন। সাধন-ভজন কাকে বলে, তা বিজয় সরকারের মাঝে দেখেছি। অমন সাধক পুরুষ আর মিলবে না এ জনমে।’
সাধক বিজয় সরকারকে স্মরণ করতে গিয়ে এই বৃদ্ধ বাউল ধারার সোনালী দিনের নানা গল্প শোনালেন। শোনালেন, বিজয়কে ঘিরে ভক্তদের নানা উপাখ্যানও।
দীর্ঘ আলাপের বিদায় বেলায় বিজয় সরকারের সেই বিচ্ছেদের গানে গুনগুনিয়ে সুর দিলেন বিমল সিকদার। ‘আর কি ফিরে পাবো রে, যারে হারায়েছি জীবনে।’
সাধনেই বিজয়
কবিয়াল বিজয় সরকার ১৯০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের দেয়া নাম ছিল বিজয় কৃষ্ণ অধিকারী। ভক্তকূলের কাছে তিনি পাগল বিজয় নামেই পরিচিত।
বিজয় সরকারের ভাতিজি জামাই বিমল সিকদার
জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত গান সাধনাতেই কাটিয়েছেন তিনি। তার জনপ্রিয় কয়েকটি গানের মধ্যে রয়েছে- ‘এ পৃথিবী যেমন আছে, তেমনই ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে’, ‘পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী, একদিন ভাবি নাই মনে’, ‘তুমি জানো না রে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা’, ‘আষাঢ়ের কোন ভেজা পথে’ এবং ‘আর কি ফিরে পাবোরে’।
সাধক বিজয়ের বাবার নাম নবকৃষ্ণ বৈরাগী, মাতার নাম হিমালয় কুমারী। পিতামহের নাম গোপালচন্দ্র বৈরাগী। বিজয় সরকার স্থানীয় টাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন নেপাল বিশ্বাস নামক এক শিক্ষকের কাছে যাত্রাগানের উপযোগী নাচ, গান ও অভিনয় শেখেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি স্কুল পরিবর্তন করেন। প্রায় সবখানেই তিনি এমন এক বা একাধিক শিক্ষক পান, যাদের কাছে তিনি গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারানোয় পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লেখাপড়া করেন।
বিজয় সরকার স্থানীয় স্কুলেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন, নায়েবের কাজও করেন। পাশাপাশি তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের লোক ও আধুনিক গানচর্চা করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে তিনি গোপালগঞ্জের কবিয়াল মনোহর সরকারের কাছে কবিগান শেখেন। কিছুদিন পর তিনি রাজেন্দ্রনাথ সরকারের সংস্পর্শে আসেন এবং তার কাছেও কবিগানের তালিম নেন।
১৯২৯ সালে বিজয় সরকার নিজের একটি গানের দল করেন এবং কবিয়াল হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি গান লিখে নিজেই সুর করতেন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, আব্বাসউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সাক্ষাৎও পান জীবনের নানা সময়ে।
বিজয় সরকার প্রায় ৪০০ সখি সংবাদ ও ধুয়া গান রচনা করেন। এর মধ্যে কিছু কাজ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং রেডিও-টেলিভিশনেও কবিগান পরিবেশন করেন।
বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি আনুমানিক চার হাজার আসরে কবিগান পারিবেশন করেন। এছাড়া তিনি রামায়ণ গানও পরিবেশন করতেন।
বিজয় সরকারের পারিবারিক উপাধি ছিল বৈরাগী। তিনি নিজে বৈরাগী ত্যাগ করে অধিকারী উপাধি গ্রহণ করেন। কবিয়াল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করায় তিনি সরকার উপাধি পেয়ে পরিচিতি পান।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।
প্রভাত বালা
পাগল বিজয়ের গান বুঝতে হলে সাধক হতে হয় : প্রভাত বালা
প্রভাত বালা। বাড়ি নড়াইল জেলার গোবরা গ্রামে। কবিয়াল বিজয় সরকারের ভক্ত ও শিষ্য। বিজয় সরকারের গান ও সুরের প্রেমে মজেছেন শৈশবে। আজও সেই প্রেম নিয়ে গান করেন। সম্প্রতি বিজয় সরকারের নড়াইলের ডুমদি গ্রামে পরিত্যক্ত ভিটার উদ্দেশে গিয়ে খোঁজ মেলে গান পাগল এই বিজয় অনুরাগীর। গুরুকে স্মরণ করে তুলে ধরেন বিজয় কীর্তন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আপনি বিজয় সরকারের গান করছেন। কীর্তন অনুষ্ঠানেও বিজয়ের বাণীতে আসর মাতান। গানের মাঝে বিজয়কে কতটুকু অনুভব করেন?
প্রভাত বালা : আমি গান করি নিজের জন্য। ভক্তকূল গান শুনে শান্তি পাক বা না পাক এর জন্য আমার কিছু যায় আসে না। মানুষের ভেতরে আরেকটি সত্ত্বার বাস আছে। সেই সত্ত্বাকে শান্তি দিতেই আমার গান করা। বিজয় সরকারের গান করলেই কেবল আমি এবং আমার ভেতরের আমিতে শান্তি মেলে।
বিজয় সরকারের বাণীর মূল্যায়ন করার যোগ্যতা আমার নেই। পাগল বিজয়ের গান বুঝতে হলে সাধক হতে হয়। আমি তো সাধু নই। বিজয় সরকার গান লিখেছেন, মন আর শরীরকে জাগ্রত করতে। এমন ভাববাদী গান ধরায় আর কোনো গীতিকার লিখেছেন বা সুর দিতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। তিনি একেবারেই মাটির মানুষের জন্য গান রচনা করে গেছেন। তার প্রাণবন্ত গানের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হয় না।
জাগো নিউজ : এমন মূল্যায়ন কিসের ভিত্তিতে করছেন?
প্রভাত বালা : আমি অন্য গীতিকার বা কবিরও গান করি। অন্য লেখকদের পদের যে ছন্দ এর সঙ্গে বিজয় সরকারের পদের ছন্দে ঢেড় তফাৎ।
ছোট বেলায় পাশের গ্রাম ছণ্ডীতলায় গান শুনতে যেতাম। সেখানে বিজয় সরকার কীর্তন করতেন। মূলত বিজয় সরকারের গান শোনার জন্যই সেখানে যাওয়া। অমন মধুর সুর আর মেলে না। ওই যে শৈশবে তার কাছ থেকে সুরের দীক্ষা নেয়া, তা পুঁজি করে এখনও গান করি।
জাগো নিউজ : অন্যরা গাইতেন না? প্রভাত বালা : বিজয় সরকারের সঙ্গে অনাধি সরকার ও রসিক লাল সরকারও গাইতেন। অনাধি সরকার ও রসিক লাল সরকার ছিলেন বিজয় সরকারের যোগ্য শিষ্য। জাগো নিউজ : আপনি কখনও গেয়েছেন বিজয় সরকারের সঙ্গে?
প্রভাত বালা : বহুদিন আগের কথা। খুলনায় আমার বড় ভাই জ্ঞান বালা বিজয় সরকারের সৌজন্যে আর্ট কলেজে একটি গানের আয়োজন করেন। তখন বিজয় সরকার ভারতে চলে গেছেন।
ওই অনুষ্ঠানে সরকার মশাইও এসেছিলেন। তার (বিজয়) ডান পাশে বসে দুটি গান করার সৌভাগ্য হয় আমার।
জাগো নিউজ : কোন গান করলেন? প্রভাত বালা : ‘এই পৃথিবী যেমন আছে, তেমন পড়ে রবে/সুন্দর এই পৃথিবী একদিন ছেড়ে যেতে হবে’ গানটি প্রথমে গাইলাম। পরে গাইলাম ‘আমি এলাম কোথা হতে এই দেশে/ইহার পর যাবো কোন দেশে/আমি চলেছি কার গোপন ইশারায়।’
জাগো নিউজ : তার লেখা গান আপনার কণ্ঠে শুনে বিজয় সরকার কী বললেন? প্রভাত বালা : গুরু গান শুনে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘ভালো গাইছো। গাইতে থাকো। আরও ভালো করবে।’
জাগো নিউজ : তখন বিজয় সরকারের শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল? প্রভাত বালা : বয়সের ভারে একেবারেই নুয়ে পড়েছিলেন। শরীর যেন আর চলে না তার। দু’পাশে দু’জন ধরে মঞ্চে এনে বসালেন। জাগো নিউজ : বিজয় সরকার গান করেছিলেন সেদিন?
প্রভাত বালা : হ্যাঁ, গান করেছিলেন দুটি। তারই লেখা গান। তবে দম চলছিল না। ছোট করে গাইলেন। তবুও মধুর মতো লাগছিল।
তার অন্য ভক্তদেরও আমি দাওয়াত করে খুলনায় নিয়ে গিয়েছিলাম। এ অঞ্চলে তখন তার অগণিত ভক্ত। শিষ্যও ছিল প্রচুর। সবাই গিয়েছিল আর্ট কলেজের সেই অনুষ্ঠানে। শিষ্যরা গাইলেন বিজয় সরকারের গান। জাগো নিউজ : বিজয় সরকারের এমন কোনো শিষ্যের দেখা মেলে এখন?
প্রভাত বালা : করোলার পলাশ বাবু বিজয়ের একজন গুণী শিষ্য। উজিরপুরের নিখিল রায়ও বিজয় গুরুর গান ভালো করেন। তারা এখনও আমাদের আয়োজনে কীর্তনে অংশ নেন। গান করেন সারা বাংলাতেই। এরপর খইলশাপুরের বিনয় বাবুও বিজয়গীতি ভালো করেন। জাগো নিউজ : বলা হয়, বিজয় সরকারের যোগ্য উত্তরসূরী সাধক অনাধি সরকার ও রসিক লাল সরকার। তাদের বিষয়ে কিছু বলেন।
প্রভাত বালা : সাধুসঙ্গ নিয়ে অনাধি সরকার ও রসিক লাল সরকারও সাধক বনে যান। বিজয় সরকার মারা যাওয়ার পরও অনাধি সরকার ও রসিক লাল সরকার চণ্ডীতলায় গান করতে আসতেন। তারা বিজয় সরকারের সঙ্গেও গান করতেন। তারাও চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
তবে বিজয় সরকার ও নিশিকান্ত ছিলেন সফল জুটি। নিশিকান্তের বাড়ি ছিল উত্তরে। বিজয়-নিশি যেখানে, ভক্তরা ছিলেন সেখানে। নিশিকান্ত মারা যাওয়ার পর বিজয় ও রসিক লাল জুটি বাঁধেন। রসিক লালের বাড়ি ছিল দক্ষিণে।
রসিক লাল ছিলেন অনাধি সরকারের ভাইয়ের ছেলে। ফরিদপুরের নগরকান্দায় বাড়ি ছিল তাদের।
বিজয় সরকারের প্রথম গুরু ছিলেন মনোহর সরকার। দ্বিতীয় গুরু ছিলেন রাজেন্দ্রী সরকার। মনোহর সরকারই রাজেন্দ্রী সরকারের কাছে তাকে পাঠান। আর অনাধি সরকার ছিলেন রাজেন্দ্রী সরকারের ভাইয়ের ছেলে। রাজেন্দ্রী সরকার, অনাধি সরকার ও রসিক লাল সরকার ছিলেন একই পরিবারের। তারা সবাই ভাববাদী গানের সাধক।
জাগো নিউজ : বিজয় সরকারের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানার সুযোগ হয়েছিল কি? প্রভাত বালা : অল্প বয়সেই বাবা-মাকে হারান বিজয় সরকার। শুনেছি, এরপর পরিবারে চরম অভাব দেখা দেয়। সেই সময় ভাইয়েরা বিজয় সরকারকে বিয়ে দেন। মূলত সংসারে মন বসানোর জন্যই তাকে বিয়ে দেয়া। কিন্তু বিজয় সরকার তো ছিলেন সাধক মানুষ। তাকে তো ঘরে শোভা পায় না। তার সৃষ্টিকথা প্রচার করতেই হবে। ভেতরের আগুন যে কোনোভাবেই প্রকাশ পাবে। সাধুদের ভেতরের সৃষ্টি কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পাবেই। এটি প্রকাশ না করলে সাধকরা মারা যাবেন।
‘যায় না বৃক্ষের ছোঁয়ায় বক্ষের জ্বালা গো, জ্বালা কেমনে জুড়াই/বৃন্দাবন অন্ধকার আজই শ্যাম ব্রজে নাই।’ আহা! বিজয় বাবুর গান এটি। বৃন্দাবনে কৃষ্ণ নেই। রাধা কৃষ্ণকে খুঁজে ফিরে অস্থির। প্রেমজ্বালা মেটাতে রাধা কালো তমাল গাছকে জড়িয়ে ধরছে। কিন্তু তাতে অন্তরের জ্বালা মিটছে না। জ্বালা আরও বাড়ছে।
বিজয়ের শিষ্য রসিক লাল লিখেছেন, ‘ননদী যা ফিরে যা ঘরে, বলিস ডুবেছে রাই কলঙ্কিনী কৃষ্ণ প্রেম সাগরে।’ এই গানে রসিক লাল দেশ মাতালেন। তার আরেকটি গান ‘চিঠি লিখি তোমার কাছে ব্যাথার কাজলে, আশার করি পরাণ বন্ধু আছ কুশলে’।
রসিক লালের গান যেন আলাদা সৃষ্টি, মন ভরায়। আর বিজয়ের গান মন কাঁদায়। তার গান ভেতর থেকে জানান দেয়। অন্তরকে জাগ্রত করাই হচ্ছে বিজয় বাবুর গানের ধর্ম। জাগো নিউজ : গান করছেন সাধকদের বাণী নিয়ে। এখন লেখকদের কেমন দেখছেন? প্রভাত বালা : অমন মধুর বাণী, মধুর সুর আর হবে না। এমন ঢঙে কার লেখার সাধ্য আছে? মানুষের ভাব তো উধাও হয়ে যাচ্ছে। মন মরে যাচ্ছে। এমনকি যারা সাধকদের গান এখন গাইছেন, তারাও সুর, তাল, লয় নষ্ট করছেন। পাগল বিজয়ের বাণী নিয়ে তামাশা করা যায় না। রেডিও-টেলিভিশনে সাধকদের লেখা গান অনেকেই করছেন। শুনে মনে বড় কষ্ট পাই। সাধকরা বেঁচে থাকলে তারাও হয়ত কষ্ট পেতেন। শহরের লোকই তো আর গান শোনেন না। আমরা গ্রামের লোকরা তো শুনি। রবীন্দ্র, নজরুল অনেক ভালো গান লিখেছেন। কিন্তু সেই গানে আমার প্রাণ জুড়াবে না। বৈষ্ণব পদাবলী থেকে বিজয় গান লিখেছেন অত্যন্ত সহজ ভাষায়। বিজয়ের পদ-ই আমাদের মন ছুঁয়ে দেয়।
বিজয়ের গান, ‘পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী, একদিন ভাবিনি মনে’। অনেকেই মনে করেন, বিজয় বাবুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এমন বিচ্ছেদের গান লিখেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, খাঁচায় পোষা পাখি উড়ে যাওয়াকে বুঝিয়েছেন। আসলে এমনটি নয়। মানুষের দেহ খাঁচার মাঝে আত্মাকে ‘পাখি’ বুঝিয়েছেন বিজয়। সেই পাখি একদিন উড়ে গেলে এই দেহ খাঁচার আর কোনো মূল্য নেই। এগুলো বোঝার ব্যাপার।
জাগো নিউজ : বিজয় সরকার কলকাতায় চলে গেলেন কবে? প্রভাত বালা : ১৯৮৪ সালে খুলনার ওই অনুষ্ঠানে আসেন। পরের বছরই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান গুরু। সম্ভবত স্বাধীনতার ৫/৭ বছর পর ভারত চলে যান। পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ওপারে অসীম সরকার বিজয়ের গান প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। ওপারে বিজয়কে আরও বেশি মূল্য দেয়া হয়। বিজয়ের গান ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে কীর্তন করে কোনো শিল্পীর আর প্রাণ জুড়ায় না।
জাগো নিউজ : বিজয় সরকারের সৃষ্টিকর্ম রক্ষার্থে রাষ্ট্র উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি তার বসত ভিটাও সংরক্ষণ করা হয়নি। এ নিয়ে আপনাদের মাঝে ক্ষোভ আছে কিনা?
প্রভাত বালা : বিজয় সরকারের সৃষ্টি ধারণ করার মতো ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। তার গান, সুর অন্তরে (মানুষের) ধারণ করতে হয়। আমরা অধমেরা সেই চেষ্টাই করছি।
কিন্তু বিজয়ের বাণী এখন অনেক বিকৃতি করে শিল্পীরা বেতার-টেলিভিশনে গান করছেন। যার যতটুকু বলতে সুবিধা, ততটুকু বানিয়ে নিচ্ছেন। এদিকে রাষ্ট্র বা সরকার নজর দিতে পারে। এটি সব সাধকের বেলাতেই করা উচিত।
যেমন বিজয় লিখেছেন, ‘কি সাপে কামড়ালো ওরে সাপুড়িয়ারে, জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরলাম বিষে/আমার বিষ গুণে দেহছে অঙ্গ, আমি জুড়াব কিসে’। এ গানের সুরে যে ঢেউ তা অনেকেই দিতে পারবে না। সুরের মাঝে ঢেউ হচ্ছে গানের অলঙ্কার। কানের দুল, নাকের ফুল পরলে যেমন নারীর রূপ বাড়ে, তেমনি সুরের মাঝে ঢেউ দিলে অন্তরে বেঁধে।
বিজয় সরকার যখন সুরে ঢেউ দিতেন তখন সেই ঢেউয়ে মানুষ উঠে এসে গলা ধরে কান্নাকাটি করত। এটিই হচ্ছে বিজয়ের গানের অলঙ্কার। আমরা কাছে থেকে দেখে সেই ঢেউয়ে খেলছি। এ খেলা সবাই খেলতে পারে না।
জাগো নিউজ : গানে এলেন কি করে?
প্রভাত বালা : আমার গানে আসার পেছনে সমস্ত কৃতিত্ব মাইঝে দাদা ( মেঝো ভাই) খোকন বালার। সারাদিন কামলা খেটে এসে দাদা আমাকে ঘাড়ে করে নিয়ে যেতেন গানের আসরে। নৌকায় করে দূর গ্রামে নিয়ে যেতেন বিজয় সরকারের গান শোনাতে। দাদার কোলেই ঘুমিয়ে যেতাম। কষ্ট হতো, কিন্তু তা আজ মধুর স্মৃতি। দাদা এখনও আমার সঙ্গে গানে যান। আমি কোনো অনুষ্ঠানে গাইলে দাদা যাবেন, নইলে না।
মানুষের মাঝে গান আর শ্রদ্ধা-ভক্তি নিয়ে এখনও বেঁচে আছি। এএসএস/এমএআর/আইআই/আরআইপি