বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মানুষের জন্য রয়েছে নামি দামি থ্রি ও ফাইভ স্টার শ্রেণির নানা নমুনার আবাসিক হোটেল। বর্তমানে একইভাবে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই গড়ে উঠেছে পোষা কুকুর বা বিড়ালের জন্য হোটেল বা রেস্টুরেন্ট।
Advertisement
কিন্তু এখনো বিশ্বের কোনো দেশে গড়ে উঠেনি গরু মহিষের জন্য আবাসিক হোটেল বা রেস্টুরেন্ট। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী এলাকায় গরু-মহিষের জন্য আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে।
এ আবাসিক হোটেলে রয়েছে গরু, মহিষ ও ছাগলের জন্য নির্ধারিত স্থান এবং থাকা খাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে নির্মিত জেলার সর্ববৃহৎ গরুর হাট গোবিন্দাসীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ ধরনের আড়াই শতাধিক আবাসিক হোটেল।
হোটেলগুলো গড়ে উঠার ফলে হাটে যেমন সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান, তেমনি ব্যবসায়ীদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে নিরাপদ পরিবেশে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া বেচাকেনার সুযোগ। এ কারণে অল্প সময়ে গোবিন্দাসী হাট পরিচিতি পাওয়ার পাশপাশি দেশের বৃহত্তম পশুর হাটে পরিণত হয়েছে ।
Advertisement
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ৬০ এর দশক থেকে যমুনা নদীর তীরবর্তী গোবিন্দাসী গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় হাট। সে সময় হাটে সপ্তাহের একদিন কেনাবেচা হতো গৃহস্থালির জিনিসপত্র ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।
ধীরে ধীরে পরিচিতি পায় হাটটি। ৭০ এর দশকে স্থানীয়রা হাটটিতে খুব অল্প পরিসরে শুরু করে গরু-ছাগল বেচাকেনা। স্থানীয়দের এ উদ্যোগ সফল হয়। ফলে আশির দশকের শেষ ভাগে যমুনার নৌ-পথ দিয়ে হাটে আসতে শুরু করে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গরু-ছাগল।
দেশি ও ভারতীয় গরু আসায় খুব অল্প দিনেই পাইকারদের নজর কাড়ে এই গোবিন্দাসী গরুর হাট। নব্বইয়ের দশকে এসে জমজমাট গরুর হাটে পরিণত হয় এটি। সপ্তাহের রোববার ও বৃহস্পতিবার বসতে থাকে হাট। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জমজমাট বেচাকেনা হলেও এই হাটে এখনও নির্মাণ হয়নি সরকারি কোনো অবকাঠামো।
তবে গোবিন্দাসী হাটটি এখন বৃদ্ধি পেয়ে ছড়িয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণকৃত জমিসহ উত্তর পাশের চরের খোলা জায়গা পর্যন্ত।
Advertisement
শুরুর দিকে পাইকাররা গরু এনে হাটের আশপাশের মানুষের বাড়ির সামনে জড়ো করে রাখতেন। ঝড়-বৃষ্টির সময় এসব বাড়ির গোয়াল ঘরেই জায়গা পেত পাইকারদের গরু। আশ্রয় পেতেন পাইকাররাও। বিনিময়ে তারা বাড়ির মালিককে দিতেন অর্থ।
টাকা রোজগারের এমন সহজ সুযোগ আর পাইকারদের চাহিদার কারণে পশুর জন্য হাটের আশপাশের বাড়ির মালিকরা তাদের খোলা জায়গায় গড়ে তোলেন টিনের ঘর।
ভাড়ার বিনিময়ে শুরু হয় সেখানে গরু রাখা। ফলে ওই ঘরগুলো পরিচিতি লাভ করে গরুর আবাসিক হোটেল হিসেবে। লাভজনক হওয়ায় দিনদিন বাড়তে থাকে এই হোটেলের সংখ্যা।
হোটেলের গণ্ডি ছড়িয়ে পড়েছে গোবিন্দাসীর আশপাশের খানুরবাড়ি, ভালকুটিয়া, কুকাদাইর, রাউৎবাড়ি, জিগাতলা, বাগবাড়ি, স্থলকাশি, মাটিকাটা, চিতুলিয়াপাড়াসহ ১০/১২টি গ্রামে।
এর প্রতিটি হোটেলে গরু-মহিষ রাখার ধারণ ক্ষমতা ২০ থেকে ৩০টি। মজুদ থাকে খড়সহ পর্যাপ্ত পশুখাদ্য। বেশিরভাগ হোটেলের পাশেই রয়েছে গোসলের পুকুর।
এ প্রসঙ্গে গরুর পাইকার হায়দার আলী জানান, প্রতি হাটের দুই একদিন শ খানেক গরু এনে এই হোটেলে রাখেন। হাটের দিন গরু বিক্রি শেষে চলে যান। অবিক্রিত গরু থাকলে সেগুলো আবার হোটেলে রেখে বাড়ি চলে যান তারা। এমন হোটেল থাকার কারণে তাদের গরু ফিরিয়ে নেয়ার ঝামেলা থাকে না। হাটের আগ পর্যন্ত হোটেল মালিকরাই গরুগুলো দেখাশোনা করেন।
ফলে পরের হাটে আবার অন্য গরুর সঙ্গে অবশিষ্ট গরুগুলো বিক্রি করতে পারেন পাইকাররা। এই আবাসিক হোটেলে গরু রেখে পাইকাররাও মাত্র ৭০/৮০ টাকায় সেরে নিতে পারেন তাদের খাওয়া দাওয়া। গরু রাখা ও পাইকারদের থাকা খাওয়ার এমন সুন্দর ব্যবস্থা দেশের অন্য কোনো হাটে নেই বলেও জানান গরুর পাইকার হায়দার আলী।
গোবিন্দাসী হাটের আবাসিক হোটেল মালিক শাহিন মিয়া জানান, তার হোটেলের প্রায় প্রতি হাটেই থাকে ১ থেকে দেড়শ গরু। হোটেলে গরু প্রতি রাতে রাখার জন্য ১০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হয়। এছাড়া গরুর খাওয়া বাবদ যে খচর হয় তা দেন পাইকাররা। গরুর ভাড়া ছাড়াও গরুর গোবর থেকে বাড়তি আয় হয় হোটেল মালিকদের।
হোটেল থেকে প্রতি হাটে তিনি এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করছেন। এছাড়া গোবর থেকে জৈব সার ও ঘুটে তৈরি করে আরও কিছু বাড়তি আয় করেন বলেও জানান তিনি।
প্রশাসন, হাট কমিটি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তৎপরতার কারণে হাটে চুরি, ছিনতাই আর ডাকাতি নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে সরকার এই হাট থেকে বছরে ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করছে বলে জানান হাট সংশ্লিষ্টরা। এই রাজস্ব আয় বাড়াতে ও দেশের বৃহত্তম এই হাটের খ্যাতি ধরে রাখতে সরকারিভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা অতি জরুরি বলেও জানান গরু ব্যবসায়ীরা।
আরিফ উর রহমান টগর/এএম/আইআই