বিশেষ প্রতিবেদন

তারেক সাঈদ বলেন, ওকে গো অ্যাহেড

বীভৎস শীতলক্ষ্যায় ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল একে একে ভেসে ওঠে র‌্যাব কর্তৃক অপহৃত সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ ছয়জনের লাশ। পরদিন ১ মে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

Advertisement

নারায়ণগঞ্জের গত কয়েক বছরের ইতিহাসে সাত খুনের ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। সাতজনকে একসঙ্গে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ গুম করার জন্য ফেলে দেয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।

৩০ এপ্রিল বিকেল থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার হতে থাকলে নিশ্চিত হওয়া যায় লাশগুলো অপহৃত সাত হতভাগার। কান্নায় ভেঙে পড়েন তাদের পরিবার। সেই বীভৎস দিনের কথা স্মরণ করে এখনও আঁতকে ওঠেন স্থানীয়রা।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। পরদিন ২৮ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান করে মামলায় আসামি করা হয় ছয়জনকে।

Advertisement

৩০ এপ্রিল প্যানেল মেয়র নজরুলের ভাই আব্দুস সালাম ও স্ত্রী সেলিনা ইসলাম নজরুলের লাশ শনাক্ত করেন। এছাড়া নজরুলের সঙ্গেই অপহৃত মনিরুজ্জামান স্বপনের লাশ তার ছোট ভাই রিপন এবং তাজুল ইসলামের লাশ তার বোন শিরীন আক্তার শনাক্ত করেন। আরেকটি লাশ অপহৃত আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের বলে শানাক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ হাসপাতালের মর্গে অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের লাশ শনাক্ত করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাশ ছয়টি শীতলক্ষ্যার এক কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যায়। প্রতিটি লাশের পায়ে ২৪টি করে ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ বাঁধা ছিল। হাত ছিল পেছনে বাঁধা। মুখ ডাবল পলিথিন দিয়ে গলার কাছে বাঁধা ছিল। পেট ধারাল অস্ত্র দিয়ে সোজাসুজি ফাড়া ছিল।

লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে সাইনবোর্ড থেকে কাচঁপুর ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ। সর্বত্র জ্বলে উঠে ক্ষোভের আগুন।

নূর হোসেনের জবানবন্দি

Advertisement

জবানবন্দিতে নূর হোসেন স্বীকার করেন, সাত খুনের ঘটনা তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে। তবে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে র‌্যাব-১১ এর সাবেক সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ জানতেন বলেও তিনি আদালতকে জানান। পুরনো ঢাকায় তারেক সাঈদের জমি নিয়ে সমস্যা ছিল। সেখানে আইনজীবী দিয়ে সহায়তা করার কথা জানিয়েছিলেন নূর হোসেন।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নোংরা। এখানে সবসময় ‘বস’দের খুশি রাখতে হয়। এটা না করলে টিকে থাকা যায় না। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ‘বস’ই আমাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন।

নূর হোসেন বলেন, ‘ঘটনার দিন মেজর আরিফ আমার সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় আসে। তখন আমি তাকে বলি, আমার লোক নজরুলকে ফলো করছে। সে কোর্টে হাজির হতে আসলেই আমি জানব। তখন আমি আপনাকে ইনফর্ম করব। আপনারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেন।’

‘আমাদের টার্গেট ছিল নজরুল। চন্দন সরকারসহ বাকিরা টার্গেটে ছিল না। যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী কেউ বেঁচে থাকলে ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবে, তাই তাদেরকে হত্যা করা হয়।’

হত্যাকাণ্ড ঘটাতে বড় অংকের টাকা লেনদেন হয় বলে স্বীকার করেন নূর হোসেন। তবে টাকার অংক বলেননি তিনি। নূর জানান, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে একটি চুক্তিও করা হয়েছিল। কিছু টাকা পরিশোধও করা হয়। অপারেশন সফল হলে বকি টাকা শোধ করার কথা ছিল।

নূর হোসেন জানান, নজরুল ১২ থেকে ১৩টি খুনের মামলার আসামি ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি বেশ দাপুটে ছিলেন। তার বিশাল কর্মীবাহিনী ছিল। নজরুলই ছিলেন তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।

নূর হোসেন বলেন, ‘আমি কেবল আওয়ামী লীগ নয়, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের টাকা দিয়েছি। আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবই আছে। সব দলের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল।’

‘প্রতিনিয়ত র‌্যাব, পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে এসেছি। চাঁদা দেয়া ছাড়া আমার টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। পড়াশোনা জানি না। টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে রাখতাম। বালু ও ট্রাকের ব্যবসা ছিল। পরিবহনের চাঁদাবাজি থেকে অনেক টাকা আসতো।’

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে নূর হোসেন স্বীকার করেন, সাত খুনের ঘটনার আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনের সময় তার বাহিনী বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখল করে। এ সময় তার লোকজনের হাতেই বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন নিহত হন। ওই হামলায় পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান দেওয়ানের স্ত্রীও নিহত হন। এছাড়া একই ইউনিয়নের জোটন প্রধান নামের এক যুবকও নিহত হন। ওই সহিংসতায় আহত হয়েছিল কয়েক শ’ লোকজন। ঘটনার পরিকল্পনা তারই ছিল বলে নূর হোসেন স্বীকার করেন।

এদিকে কলকাতায় থাকার সময় নূর হোসেনের সঙ্গে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মিরপুরের কিলার সাহাদাত ও জামিল, মগবাজারের মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন দেখা করেছেন বলে জানান তিনি। ভারতে থাকাকালে টাকার কোনো সমস্যা হয়নি বলেও স্বীকার করেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে তাকে নিয়মিত টাকা পাঠানো হতো।

তারেক সাঈদের জবানবন্দি

জবানবন্দিতে তারেক সাঈদ বলেন, সাতজনকে অপহরণের বিষয়টি তিনি জানলেও সকলকে হত্যার বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি। অপহরণের পর তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে তেমনটাই তাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলায় সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি জানানো হয়। আর এ কাজটি করেন মেজর আরিফ ও নূর হোসেনসহ র‌্যাবের কিছু সদস্য। কিন্তু সাতজনকে মারার পর আমি অনেকটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। তবে সাতজনকে হত্যার পর বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার কথা বলি আরিফকে।

মাসুদ রানার জবানবন্দি

জবানবন্দিতে চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা বলেন, ২০১৪ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ নিজেই মেজর আরিফকে নজরুলের একটি প্রোফাইল দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে এবং আমাকে আরিফকে সহায়তার নির্দেশ দেন। নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আনুমানিক ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে আমি কোম্পানি কমান্ডারের গাড়িতে মেজর আরিফের কাছে পৌঁছাই এবং গাড়ি ছেড়ে দেই। এরপর মেজর আরিফের নীল কালারের মাইক্রোবাসে উঠে দেখি মেজর আরিফ, নূর হোসেন, নিজস্ব সোর্স, নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে নজরুলের বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন।

ওই সময় মেজর আরিফ আমাকে বলেন, স্যার, নজরুল একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার সঙ্গে সব সময় ৪/৫টি আর্মস থাকে। আমরা সিভিল ড্রেসে তাকে গ্রেফতার করতে গেলে সে আমাদেরকে নূর হোসেনের লোক ভেবে গুলি করে বসতে পারে।

মেজর আরিফ আরও বলেন, স্যার, আপনার ইউনিফর্মধারী পেট্রোল টিমকে দিয়ে ফাঁকা জায়গায় নজরুলকে আটকাতে হবে। যেহেতু মেজর আরিফ অপারেশন কমান্ডার সেহেতু আমি তার কথা মতো আমার ইউনিফর্মধারী পেট্রোল টিমকে নজরুলকে আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেই। আনুমানিক ১টার দিকে মেজর আরিফের কাছে ফোন আসে যে, নজরুল দুটি গাড়ি নিয়ে কোর্ট থেকে বের হচ্ছে। নজরুলের গাড়ি দুটি বের হওয়ার পর আমরা আমাদের মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে ওই গাড়ি দুটিকে ফলো করি এবং পেট্রোল টিমকে গাড়ি দুটির বর্ণনা দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পর সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা জায়গায় থামাতে বলি।

নজরুলের গাড়ি দুটির একটি সাদা কালারের, অন্যটি কালচে রংয়ের ছিল। আনুমানিক ১টা ২০ মিনিটের দিকে পেট্রোল টিম নজরুলের গাড়ি দুটিকে সিটি করপোরেশনের গেটের মুখে থামায়। তখন আমাদের দুটি মাইক্রোবাসে থাকা সিভিল টিম নজরুলের গাড়ি দুটিতে থাকা সবাইকে গ্রেফতার করে আমাদের মাইক্রোবাস দুটিতে তোলে। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে ঘটনাস্থলে পেট্রোল টিমের সঙ্গে থেকে যাই এবং মেজর আরিফ ধৃত লোকদেরসহ মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে চিটাগাং রোডের দিকে চলে যায়।

আমি সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আদমজীনগরে ব্যাটালিয়ন সদরে ফিরে অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করি এবং তাকে জানাই যে, নজরুলসহ ৫/৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নজরুলের দুটি গাড়ির একটিকে সরানো হয়েছে অন্যটি ঘটনাস্থলে পড়ে আছে। তখন সিও স্যার বলেন যে,ওই গাড়িটিও সরানোর ব্যবস্থা করো। সিও-এর নির্দেশনা অনুযায়ী আমি ড্রাইভার কনস্টেবল মিজানকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পরিত্যক্ত কালচে রংয়ের গাড়িটি নিয়ে আনুমানিক ৩টা ৪৫ মিনিটে গুলশান নিকেতনে রেখে আসি।

গাড়িটি রেখে আসার সময় ভেতরে অ্যাডভোকেটের ভিজিটিং কার্ড দেখতে পাই। তখন বুঝতে পারি যে, এই গাড়ির লোকটি একজন অ্যাডভোকেট। সিওকে জানাই যে, নজরুলসহ ধৃতদের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট রয়েছেন। আনুমানিক ৫টা ১০ মিনিটের দিকে মেজর আরিফ আমাকে ফোন করলে জিজ্ঞাস করি, মোট কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তখন সে বলে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আমি বলি যে, ওই সাতজনের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট আছে। তুমি অপারেশন কমান্ডার তাই তার সম্পর্কে বুঝে শুনে সিও স্যারকে সাজেশন দিও।

আনুমানিক ৫টা ২৫ মিনিটের সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে যে, আপনার ক্যাম্পে থাকা ট্রলারটি রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর আমি ট্রলারটি পাঠানোর বিষয়ে সিও স্যারের অনুমতি নিয়ে লিডিং সিম্যান সামাদকে, মেজর আরিফের মোবাইল নম্বর ০১৭৮২-৪৬০০৬৪ দিয়ে তার সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রলার নিয়ে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে থাকতে বলি। রাত আনুমানিক ১০টা ৪০ মিনিটের সময় আমি বাসায় চলে যাই।

অনুমান রাত ১টার দিকে মেজর আরিফের অধীনে থাকা মাইক্রোবাসসহ সিভিল টিমটি ক্যাম্পে পৌঁছানোর বিষয়ে রিপোর্ট করে। রাত ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে এডিজি (ওপস) কর্নেল জিয়া আমাকে ফোন করে বলেন, আরিফ ...। আমি বলি স্যার, আমি আরিফ না, রানা, আরিফের নম্বর শেষে ডবল ফাইভ। এরপর স্যার ফোন রেখে দেন।

পরের দিন ২৮ এপ্রিল আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার সময় মেজর আরিফ বলে, স্যার কর্নেল জিয়া গতকাল রাত তিনটায় আমাকে ডেকেছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন যে, নজরুলদের কেন মারছো? কীভাবে মারছো?

ওই সময় মেজর আরিফ আরও বলেন, আমি রাত সাড়ে ১২টার সময় এক্সিকিউশন করেছি, ইনজেকশন পুশ করে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শ্বাসরোধ করে গাড়ির ভেতরে। আর কর্নেল জিয়া স্যার আমাকে ফোন করেছেন রাত দুটায়। উনি আমাকে সাড়ে ১১টা কিংবা ১২টায় কল দিলেতো আর এই জিনিসটা হতো না।

আরিফ হোসেনের জবানবন্দি

চাকরিচ্যুত মেজর আরিফ হোসেন জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালের মার্চে আদমজীনগরে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে আমাদের কনফারেন্স ছিল। ওই কনফারেন্সে সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ কাউন্সিলর নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আমাকে বলেন। একাজে আমাকে সাহায্য করতে লে. কমান্ডার রানাকে নির্দেশ দেন। আমরা নজরুলকে ধরার জন্য তার প্রতিপক্ষ অপর কাউন্সিলর নূর হোসেনকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করি।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে নূর হোসেন আমাকে ফোন করে বলেন, নজরুল আজকে (২৭ এপ্রিল ) নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে এসেছে। আমি ওই সংবাদটি সিও তারেক সাঈদকে জানাই। তিনি তখনই নজরুলকে ধরার জন্য আমাকে ও রানাকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। আমি অভিযানের বিষয়ে কমান্ডার রানার সঙ্গে কথা বলি। এরপর আমার নীল রংয়ের মাইক্রোবাসে টিমসহ কোর্টের উদ্দেশে বের হই। আমার টিমের সদস্যরা- হাবিলদার এমদাদ, এসআই পুর্নেন্দু বালা, নায়েক দেলোয়ার (ড্রাইভার),বেলাল, হীরা, নাজিম, সিপাহী তৈয়ব, সৈনিক আলীম, আলামিন, মহিউদ্দিন,কনস্টেবল শিহাব একত্রে আনুমানিক বেলা ১১টায় কোর্টের বাইরের গেটে উপস্থিত হই।

নজরুলের গতিবিধি নজরদারি করতে আমি হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সিপাহী তৈয়বকে কোর্টের ভেতরে পাঠাই। আমরা কোর্টের বাইরে রাস্তার পশ্চিম পাশে অপেক্ষা করছিলাম। বেলা সোয়া ১১টার দিকে একটি সিলভার কালারের মাইক্রোবাসে করে রানার টিমের ৭/৮ জন সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। ওই সময় তিনি মাইক্রোবাসে ছিলেন না। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রানা নিজের গাড়িতে করে এসে গাড়ি ছেড়ে দেন এবং আমার মাইক্রোতে এসে বসেন।

আমি তাকে (রানা) জানাই, নজরুলের সঙ্গে তার ১৫/১৬ জন সহযোগী আছে। রানা সিনিয়র হওয়ার কারণে তখন তিনি অপারেশন কমান্ডার হয়ে যান এবং তিনি যেভাবে প্ল্যান করেন সেভাবেই কাজ হয়। ওই সময় কমান্ডার রানা প্ল্যান করেন, রুটিন পেট্রোল টিমের সদস্যদের দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়াম এলাকায় সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা এলাকায় নজরুলের গাড়িটি থামানো হবে।

জবানবন্দিতে আরিফ আরও জানান, আনুমানিক দুপুর ১টার দিকে নজরুল একটি সাদা প্রাইভেটকারে করে কোর্ট থেকে বের হয়ে সাইনবোর্ডের দিকে যায়। তখন আমি ও রানা আমাদের মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে নজরুলের গাড়ির পিছু পিছু যাই। রানা ওই সময় নজরুলের গাড়ির বর্ণনা দিয়ে পেট্রোল টিমকে ওই গাড়িটি থামাতে বলে। আনুমানিক দেড়টার দিকে পেট্রোল টিম চেকপোস্ট বসিয়ে সিটি কর্পোরেশনের গেটের কাছে নজরুলের গাড়িটি থামায়। তখন আমরা নজরুলের গাড়ি থেকে নজরুলসহ পাঁচজনকে বের করে আমার মাইক্রোবাসে তুলি।

এ সময় আমাদের পেছনে একটি অ্যাশ কালারের প্রাইভেটকার থেকে একজন নেমে চিৎকার করতে থাকেন। তখন রানা ওই লোক ও তার ড্রাইভারকে তার মাইক্রোবাসে তোলেন। আমি ওই পাঁচজনকে মাইক্রোবাসে তুলে কাঁচপুরের দিকে রওনা দেই এবং রানাকে বলি আমার গাড়িটিকে ফলো করার জন্য। আনুমানিক ১টা ৫০ মিনিটের দিকে আমি তারাবো নামক এলাকায় পৌঁছাই। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই রানার গাড়িটিও সেখানে পৌঁছায়। পরে আমি সিওকে রিপোর্ট করি, নজরুলসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে।

জবাবে সিও বলেন, কোনও প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাতজনকেই গুম করে ফেলো। তার আদেশে আমি আমার ক্যাম্পের বেলালকে সাত সেট ইটের বস্তা তৈরি করার জন্য বলে মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে নরসিংদীর দিকে চলে যাই। আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমি নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছাই। ওই সময় নরসিংদী ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজকে ফোন করে তার সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে দেখা করি। আনুমানিক বিকাল চারটার দিকে আমি শিবপুর উপজেলার দিকে একটি নির্জন জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকি।

আনুমানিক রাত ৮টার দিকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার জন্য সিওকে জানাই। রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি থাকার কারণে সিও আমাদের জন্য ট্রাক পাঠাবেন বলে জানান। সিও বলেন, তোমরা ওই ট্রাকে করে আসামিদের নিয়ে এসো।

আমি সিওকে বলি, ট্রাক আসতে অনেক দেরি হবে, আমরা মাইক্রোবাস নিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসছি। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আমরা নরসিংদীর বেলানগর পৌঁছাই। সেখানে সৈনিক মহিউদ্দিনকে সাতটি সাকসা (চেতনানাশক ইনজেকশন) এবং একটি সিরিঞ্জ কিনে আনতে বলি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাঁচপুরে পৌঁছে একটি পরিত্যক্ত পেট্রোল পাম্পে অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর সিওকে ফোন করে জানাই, রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি চলছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকা ডিফিকাল্ট। তাই রানা যেন ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর রানা ফোন করে আমাকে জানান, কাঁচপুর ব্রিজের নিচেই ট্রলার থাকবে।

আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আরিফ আরও বলেন, আমি তখন নূর হোসেনকে ফোন করে জানাই, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে যেন কোনও মানুষের জটলা না থাকে। রাত ১১টার দিকে আমি মাইক্রোবাস দুটিসহ কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাটে পৌঁছাই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলালকে ফোন করে ইটের প্যাকেটগুলো কাঁচপুর ব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে বলি।

রাত আনুমানিক ১২টার দিকে একটি সাদা মিতসুবিশি মাইক্রোবাসে করে হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সৈনিক আরিফ, সৈনিক তাজুল ইটের প্যাকেটগুলো নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাটে আসেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রানার ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে আসে। আমি সিওকে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে বলি, সাত জনকে গুম করার বিষয়ে আমি প্রস্তুত। ওই সময় সিও আমাকে বলেন, ওকে গো অ্যাহেড।

আরিফ বলেন, তার (সিও) আদেশ পেয়ে আমি নায়েক হিরা, সিপাহী তৈয়ব মাইক্রোবাসে থাকা সাতজনকে সাকসা ইনজেকশন পুশ করতে বলি। ইনজেকশন পুশ করার পর নায়েক বেলাল, হীরা, সিপাহী তৈয়ব, এসআই পুর্নেন্দু বালা, সৈনিক আলামিন, তাজুল, কনস্টেবল শিহাব ও সৈনিক আলীম এই আটজন মিলে আটককৃত সাতজনের মুখে পলিথিন প্যাঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর আমি সবার মৃতদেহ ট্রলারে লোড করতে বলি। আমার টিমসহ ট্রলারে উঠি এবং রানার টিম ও গাড়িগুলো ফেরত পাঠাই।

আমরা রাত আড়াইটার দিকে ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছাই। সেখানে পৌঁছানোর পর আমার টিমের সদস্যরা প্রতিটি মৃতদেহের সঙ্গে এক সেট ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। পরে সেখান থেকে ফেরত আসার সময় তৎকালীন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি অপস) কর্নেল জিয়াউল আহসান আমাকে ফোন করেন। তার ফোন না ধরে সিওকে ফোন করে বলি, এডিজি জিয়াউল কেন আমাকে ফোন করছেন? তখন সিও আমাকে বলেন, আমি তার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পর সিও আমাকে ফোন করে জানান, এডিসি আমাকে ও আমার টিমের সদস্যদেরকে তার অফিসে যেতে বলেছেন। রাত অনুমান সাড়ে তিনটার দিকে আমি ট্রলারে করে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে এসে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে সিও সাঈদের সঙ্গে কথা বলে আমি র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশে রওনা দেই।

রাত চারটার দিকে আমি এডিজির অফিসে পৌঁছাই। এডিজি জিয়াউল আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, নজরুল কোথায়? তার প্রশ্ন শুনে আমি একটু অবাক হই। তারপর বলি, নজরুল কোথায় আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? তিনি আবারও আমাকে একই প্রশ্ন করেন। আমি তাকে বলি, আমি যা করি সিও’র আদেশে করি। এ বিষয়ে যা জিজ্ঞাসা করার আপনি তাকে করেন। তারপর এডিজি সিওকে ফোন দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলান।

তখন সিও আমাকে বলেন, এডিজি কেন এমন করছে তা বুঝতে পারছি না। তুমি তাকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আসো। পরে আমি সমস্ত ঘটনা এডিজিকে জানাই।

২৯ এপ্রিল আমি ও সিও দুপুর দেড়টার দিকে র‌্যাবের হেডকোর্য়াটারে পৌঁছানোর পর এডিজি জিয়াউল আমার কাছে জানতে চান, লাশগুলো কী করেছি।

উত্তরে আমি বলি, লাশগুলো মেঘনাতে ফেলে দিয়েছি।

এমএআর/এমএস