দেশজুড়ে

গভীর রাতে শতবর্ষী মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন পুত্রবধূ

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে ছেলে ও পুত্রবধূর নির্যাতনে শতবর্ষী মাকে রক্তাক্ত করার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে এবার শতবর্ষী শাশুড়িকে নির্যাতনের পর গভীর রাতে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন পুত্রবধূ।

Advertisement

দীর্ঘদিন ধরে এ ঘটনা ঘটলেও শতবর্ষী এই মা কোনো সুরাহা না পেয়ে সারাদিন বাড়ির পাশে এক দর্জির দোকানে বসে থেকে সময় কাটান। এরপর গভীর রাতে ছেলের বাড়ির বারান্দায় গিয়ে রাত কাটাচ্ছেন।

বিষয়টি স্থানীয়ভাবে কয়েক দফায় মীমাংসা হলেও ছেলে ও পুত্রবধূর কোনো বোধোদয় হয়নি। ঘটনাটি ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের ঘোষপাড়া এলাকার। শতবর্ষী ওই মায়ের নাম রামপরি।

গতকাল রোববার রাতে শতবর্ষী ওই বৃদ্ধা বাড়ির বারান্দায় ঘুমাতে গেলে ছোট ছেলের স্ত্রী তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এসময় প্রতিবেশী সন্তোস আগারওয়ালা তাকে উদ্ধার করে একটি দোকানে নিয়ে যান। ঘটনাটি এই সংবাদকর্মী জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে ছুটে গিয়ে দেখেন একটি টেইলার্সের দোকানে বসে শতবর্ষী ওই মা কান্না করছেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলের স্ত্রী বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

Advertisement

জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের ঘোষপাড়া এলাকার মৃত রাম বিলাসের স্ত্রী শতবর্ষী রামপরি। স্বামী মৃত্যুর আগে চার ছেলের নামে চার শতক জমি লিখে দিয়ে যায়। এক শতক জমি স্ত্রী রামপরির নামে উইল করে দিয়ে যায়। উইলে উল্লেখ করে দেয়া হয় রাম বিলাসের মৃত্যুর পর, যে ছেলে তার মায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে তার নামে থাকা এক শতক জমি ওই ছেলে পাবে এবং মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সেই ছেলেকে পালন করতে হবে।

মায়ের নামে সেই জমি পাওয়ার লোভে ছোট ছেলে শংকর ঠাকুর বৃদ্ধা মাকে নিজ পরিবারের সঙ্গে রাখেন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সম্প্রতি ছোট ছেলে শংকরের স্ত্রী সমতি রাণী শাশুড়ি বৃদ্ধা মাকে ভুল বুঝিয়ে এক শতক জমি লেখে নেয়। পরে ছোট ছেলে শংকর বাবার দেয়া ১ শতক ও মায়ের নামে থাকা ১ শতক জমি নিয়ে বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এরপর বাড়ি নির্মাণ কাজের জন্য বৃদ্ধা মাকে বোনের বাসা পঞ্চগড়ে রেখে আসেন।

দীর্ঘদিন বৃদ্ধা মা মেয়ের বাড়িতে থাকার পর ছেলের নির্মাণাধীন বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে চলে আসেন। এরপর থেকে ছোট ছেলে শংকরের স্ত্রী সমতি রাণী বৃদ্ধা শাশুড়ির উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। প্রায় সময় বৃদ্ধা মা রামপরি খেতে চাইলে পুত্রবধূ সমতি রাণী বাড়ি থেকে বের করে দিতেন বলে এলাকার অনেকেই জানিয়েছেন। আবার এলাকাবাসী প্রতিবাদ করে বৃদ্ধা মাকে ছোট ছেলে শংকরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতেন।

বৃদ্ধা মাকে মানসিক নির্যাতন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্বে অবহেলার কারণে স্থানীয়ভাবে কয়েকবার বিচার শালিসও করা হয়। এ নিয়ে বৃদ্ধা মায়ের বড় ছেলে নন্দ লাল ভরণ-পোষণের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ছোট ভাই শংকরের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। আদালতে সেই মামলার রায়ে শংকরকে জরিমানা ও পুনরায় বৃদ্ধা মায়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অর্পণ করেন তার ছোট ছেলের কাছে।

Advertisement

কিন্তু ছোট ছেলের স্ত্রী বৃদ্ধা মাকে ভরণ-পোষণ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। শাশুড়ি খেতে চাইলে খাবার না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতেন। বৃদ্ধা মা তার ছোট ছেলেকে এ বিষয়ে একাধিকবার অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি বলেও জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী গোবিন্দ ঘোষ জানান, এই বৃদ্ধা মা দীর্ঘদিন ধরে পুত্রবধূর নির্যাতনের স্বীকার। প্রায় শুনি বৃদ্ধা মাকে বাড়ি থেকে ছেলে বের করে দিয়েছে। আবার এলাকার লোকজন মিলে বাসায় রেখে আসে তাকে। একজন মাকে বাড়ি থেকে এভাবে নির্যাতন করে বের করে দেয়া সমাজের অবক্ষয় ছাড়া কিছু নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঘোষপাড়া এলাকার হূমায়ূন জানান, বৃদ্ধা মাকে নির্যাতন এর আগেও অনেকবার করা হয়েছিল। ছেলের বউ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল কয়েকবার। আমরা কয়েকজন মিলে আবার বাড়িতে রেখে এসেছিলাম।

প্রতিবেশী সন্তোস আগরওয়ালা বলেন, বৃদ্ধা মাকে রাস্তায় দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছি। তাই উদ্ধার করে তাকে এখানে নিয়ে এসেছি। কোনো সন্তান তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিক আমরা এই সমাজের কেউ তা চাই না।

বৃদ্ধা মায়ের ছোট ছেলে শংকর ঠাকুরের কাছে মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সারাদিন জীবিকার তাগিদে বাইরে থাকি। প্রতিদিন রাতে বাড়িতে আসি। কি কারণে মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বিষয়টি দেখব বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল আওয়াল বলেন, বৃদ্ধা মাকে পুত্রবধূ বা সন্তান বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার এমন খবর কখনই কাম্য নয়। দিন দিন আমাদের সমাজের মানুষগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। বয়সের ভারে গর্ভধারিণী মাকে পরিবারের বোঝা মনে করতে শুরু করেছেন অনেকেই। পুত্রবধূ কর্তৃক বৃদ্ধা শাশুড়িকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

উল্লেখ্য, বৃদ্ধা রামপরি চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জননী। দুই ছেলে ঠাকুরগাঁও শহরের ঘোষপাড়ায় থাকেন। ইতোমধ্যে দুই ছেলে পরলোক গমন করেছেন। মেয়েদের মধ্যে তিনজন ভারতে আর দুজনের মধ্যে একজন পঞ্চগড় ও একজনের ঠাকুরগাঁও শহরে বিয়ে হয়েছে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

রিপন/এমএএস/আরআইপি