কল্পকাহিনী এবং ফ্যান্টাসিধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা বেশি থাকলেও ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসা বেশ ভালই চলছিল। তবে ১৯৯০ সালে এসে বিনোদন কর শতভাগ করা হলে একটু বেকায়দায় পড়েন প্রেক্ষাগৃহের মানুষজন।
Advertisement
প্রদর্শকরা টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দিলে প্রথম কয়েক সপ্তাহ দর্শক তুলনামূলক কম আসতে থাকে। তবে কিছুদিনের মধ্যে দর্শক আসা শুরু করলেও বিষম্বর ঠাকুর আগে হলের লোকদের যে বাড়তি টাকা দিতেন, তা বন্ধ করে দেন।
তারপরেও প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্ট মানুষজন এর মায়া ছাড়তে পারেননি। ৯০ এর দশকে স্যাটেলাইট চ্যানেলে ঘরে বসে চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ তৈরি হয় নওগাঁর মানুষের। তারপরেও প্রেক্ষাগৃহের দর্শকের কোনো কমতি হয়নি। তবে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে সিডি কিংবা ডিভিডি’র কারণে।
প্রেক্ষাগৃহে কোনো চলচ্চিত্রের প্রদর্শনের সময় তারই ডিভিডি বাজারে পাওয়া গেলে দর্শক আর প্রেক্ষাগৃহে আসে না। শক্তিচরণ সাহার অভিযোগ, ‘আমাদের দেশে যে সিনেমাই কয়েকদিন ব্যবসা করছে; অমনি সেটার পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভাবছে সিনেমাটা তো দেখলামই। আবার হলে যাওয়ার দরকার কী। এতে করে সিনেমাহল মার খেয়ে যাচ্ছে।’
Advertisement
চলচ্চিত্রের প্রচার নিয়েও অভিযোগ আছে শক্তিচরণ সাহার। তার মতে, ‘ভারতের যে সিনেমাগুলো ব্যবসা করছে, সেগুলো নির্মাণের কথা চিন্তা করা থেকে পত্রিকায় খবর হচ্ছে। আর আমাদের দেশে এখন কোন সিনেমা হলে চলছে দর্শক সেটা জানেই না। ‘আয়নাবাজি’র প্রচার ভাল ছিল, সিনেমাটাও ব্যবসা করেছে। আমাদের হলেই পাঁচ সপ্তাহ চালাইছি। অন্যগুলোর প্রচার হলে না হয় দর্শকের আগ্রহ জন্মাবে সিনেমাটা দেখার জন্য। দর্শক যদি সিনেমার নামটাই না জানে, সেই ব্যাকুলতা তৈরি হবে কোথা থেকে?’
তাছাড়া ‘আয়নাবাজি’ আরও কিছুদিন তারা চালাতে পারতেন বলে দাবি নারায়ণ সাহার। দর্শক ইন্টারনেটে সেটা দেখে ফেলায় তারা আর প্রেক্ষাগৃহে আসেনি।
নারায়ণ সাহা জানান, ‘২০০০ সালের আগ পর্যন্তও সিনেমা ভাল ছিল। এখন সব নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো সব অখাদ্য, কুখাদ্য। গত দশ বছর ধরে খুবই খারাপ অবস্থা। কাটপিস সংযুক্ত সিনেমা সব শেষ করে দিয়েছে। আগে সবার সিনেমা চলত, এখন কেবল শাকিবেরটা চলে। কিন্তু এক শাকিব দিয়ে তো আর সারা বছর চলবে না।’
আগে যে সিনেমাই হলে চলেছে দর্শক হুমড়ি খেয়ে দেখেছে। কিন্তু ‘আয়নাবাজি’র পর দর্শক আর ঘুরেও হলের দিকে আসে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
Advertisement
তাছাড়া ভাল চলচ্চিত্র হলেও সব দর্শক পাবেন না বলে ধারণা নারায়ণ সাহার। কারণ আগের সপ্তাহে কাটপিস সংযুক্ত চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর পর ওই প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখতে অনেকেরই রুচিতে বাধবে।
সবমিলিয়ে প্রেক্ষাগৃহের আর সেই ব্যবসা নেই। এদিকে নওগাঁ শহরের জমির দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। যে পরিমাণ জায়গাজুড়ে ‘তাজ সিনেমা’ রয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম জায়গায় দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দিলেও বেশি আয় হবে।
এসব বিবেচনায় ২০০৬ সালে ‘রুবী সিনেমা’ ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে উত্তরা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্মাইলি ডেন্টাল পয়েন্ট, আল-কাওছার চিকিৎসালয়, ন্যাশনাল ক্লিনিক ও নূহা প্লাজা নামে ভবন নির্মাণ করে বিভিন্ন কার্যক্রম চলে। আর ২০০৮ সাল থেকে ‘মুক্তি সিনেমা’র প্রদর্শনও বন্ধ আছে।
করনেশন হল বর্তমানে ‘মুক্তি কমিউনিটি সেন্টার’ নাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বিষম্বর ঠাকুর ২০১৩ সালে এসে পরিতোষ কুমার সাহার নিকট প্রেক্ষাগৃহ বিক্রি করে দেন। মদের ব্যবসায়ি পরিতোষ অঢেল সম্পদের মালিক।
নারায়ণ সাহার দাবি, ‘পার্টি ভাল আছে। সেকারণে হলটা এখনও চলছে। তাছাড়া এই লস প্রজেক্ট দিয়ে তো আর চলবে না।’ অনেকটা আক্ষেপের সুরেই জানান, ‘আয়নাবাজি’র মতো সিনেমা যদি দু-চারটা চলত তবুও প্রেক্ষাগৃহ টিকে থাকত।’
যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতেও তেমন একটা দর্শক হয় না। গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন দর্শক প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত হয়। আবার দুপুরের শো দেখতে দর্শক বেশি হলেও রাতের শো দেখার তেমন দর্শক থাকে না। ১২ টার শো দেখতে গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন দর্শক উপস্থিত হয়। তাদের অর্ধেকই নারী দর্শক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এই নারীরা তাদের প্রেমিক/বন্ধুর সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহে আসেন বলে জানা যায়।
এরপর ৩টা থেকে ৬টার শো-এর জন্য টিকিট বিক্রি আরও কম হয়। দিনে গড়ে ৬০ জন দর্শক ‘তাজ সিনেমা’য় আসার কথা জানান কর্মচারীরা। এমন অনেক শো রয়েছে, যেগুলো পর্যাপ্ত দর্শক না থাকায় বন্ধ রাখতে হয়েছে।
প্রেক্ষাগৃহ হিসেবে ‘তাজ সিনেমা’ যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া সত্ত্বেও কেন দর্শক টানতে পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে শক্তিচরণ সাহা জানান, ‘এটা একটা জেলা সদর। বেশিরভাগ মানুষ বাইরে থেকে এসে চাকরি করে, ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। অনেকেই স্টুডেন্ট, অনেকে চালকলে কাজ করে। তার মধ্যে বেশিরভাগই মোবাইলে বলেন, কম্পিউটারে বলেন, চাইনিজ, হিন্দি, ইংরেজি সব ধরনের সিনেমা দেখে। এখন হাই লেভেলের সিনেমা দেখা কোনো দর্শকের কি আর এগুলো নাটক-ফাটক ভাল লাগে। দর্শক আগ্রহ নিয়ে সিনেমা দেখবে কী, ঢোকার পরপরই পুরো কাহিনী গড়গড় করে বলতে পারবে। কোনো সিনেমা না দেখেই আমিই কাহিনি বলে দিতো পারব।’
নারায়ণ সাহা যোগ করেন, ‘কেউ মারা যাচ্ছে এমন সময় দর্শক হাসে। মারপিটের সময় বিরক্ত হয়। এসব সিনেমা দেখাতে আমাদেরই লজ্জা লাগে। পঞ্চাশ বছরে দর্শক তো আর একরকম নাই। কিন্তু সিনেমা তো বদলায়নি।’
তাহলে যৌথ প্রযোজনার বা সাফটা চুক্তিতে আসা ছবিগুলোতেও কেন একই অবস্থা, এমন প্রশ্নের জবাবে শক্তিচরণ সাহা জানান, ‘যৌথ প্রযোজনার যে সিনেমাটা আমরা চালাচ্ছি। সেই সিনেমাটা বহুত আগেই দর্শক ইন্টারনেটে দেখে ফেলেছে। তারা ভাবছে এটা তো দেখা সিনেমা, সেজন্য আর টাকা খরচ করে এখানে আসতে চাচ্ছে না।’
২০১৬ সালের কোরবানির ঈদে ‘কেলোর কীর্তি’র প্রদর্শনীতেও দর্শকের উপস্থিতি একেবারেই কম ছিল বলে জানান তিনি। ২০১৭ সালের রোজার ঈদে কিছুটা ব্যবসা করতে পারলেও তার পর থেকে খরা চলছে।
গত ১১ আগস্ট থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ‘তাজ সিনেমা’য় ‘প্রেমী ও প্রেমী’র প্রদর্শনী চলে। তবে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনীতে একেবারেই লোক হয়নি। দোতলায় প্রত্যেক শোতে গড়ে ১০ থেকে ১২ জন দর্শক হয়েছে। অবশ্য তার কারণও রয়েছে, নওগাঁ শহর পুরোটাই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানি ঢুকে গেছে প্রেক্ষাগৃহের ভিতরেও। সেকারণে সৌখিনে বসে চলচ্চিত্র দেখা কোনো দর্শকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
নারায়ণ সাহা জানান, ‘মানুষ সিনেমা দেখবে কোথা থেকে, তাদের তো এখন থাকার ব্যবস্থা করা নিয়েই চিন্তা। সারাদেশ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। তারপরেও ব্যালকনিতে বসে কয়েকজন করে সিনেমা দেখছে। শুক্রবার (১৮ আগস্ট) থেকে ‘আপন মানুষ’-এর প্রদর্শনী শুরু হবে। দেখা যাক কী ঘটে।’
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে গণমাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক চর্চা হয়ে আসছে। নওগাঁর বহুমানুষ পত্রিকা পড়ে, সিনেমার খোঁজ-খবর রাখে। পত্রিকা পড়ে তারাও সিনেমাটা খারাপভাবে নিচ্ছে। বাংলা সিনেমার উন্নয়নে সর্বপ্রথম গণমাধ্যমে এর উপস্থাপন বদলাতে হবে।
তাছাড়া আগে প্রেক্ষাগৃহে যে চলচ্চিত্রের প্রদর্শন হতো কিংবা নির্মাণাধীন কোনো চলচ্চিত্র নিয়ে রেডিওতে যে ধরনের ইতিবাচক অনুষ্ঠান হত; এখন সেরকম অনুষ্ঠান আর হয় না। টেলিভিশনের মাধ্যমেও চলচ্চিত্রের যতটা উপকার করা সম্ভব হত, তার কিছুই হচ্ছে না।
এতে করে ভারতের কোনো চলচ্চিত্র ব্যবসাসফল হওয়ার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের প্রচারণার যতোটা অবদান রয়েছে, আমাদের দেশে সেরকম কোনো উদ্যোগই নাই। পাশিপাশি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও প্রেক্ষাগৃহে দর্শক শূন্যতার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন নারায়ন সাহা।
তার ভাষায়, ‘দেশের যা অবস্থা, তাতে মানুষজন বাড়ির বাইরে বের হতেই ভয় পায়। এখন তো আর বিনোদন বলে কিছু নাই, মানুষের জীবন বাঁচানোটাই বড় হয়ে গেছে।’
কিন্তু গণমাধ্যমে কোনো চলচ্চিত্র সম্পর্কে ইতিবাচক কথা উঠে আসলেই কি দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ফিরবে? তারা যদি ফিরেও আসে, তাহলে এই চলচ্চিত্র দিয়ে সেই দর্শককে কি আটকানো যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে নারায়ণ সাহা জানান, ‘তা হয়তো যাবে না। তবে ভাল মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। দর্শক যদি ফিরে আসে, তাহলে অনেকেই ইনভেস্ট করবে, ভাল মানের সিনেমা বানানো হবে।’
তার কাছেই আবার জানতে চাওয়া হয়, চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কেউ সেই অর্থ লগ্নি করে না কেন? তিনি বলেন, ‘করে তো। কতজন ইনভেস্ট করে লস খেয়ে ভেগে গেছে তার ঠিক আছে। অনেকে টাকা লগ্নি করে কিচ্ছু ফেরত পায়নি, খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।’
প্রেক্ষাগৃহের সামনের চায়ের দোকানি বিজন দাস মহন্ত নিজের থেকেই বলে ওঠেন, ‘এই শওরে (শহরে) যে তিনড্যা হল আচিলো, একসুমায় (একসময়) ব্যাপক চলিচে। তিন জাগারই (স্থানের) নাম হোচে হলের নাম। একন (এখন) খালি নাম আচে, হল নাই। এড্যাই খালি টিকে আচে কুনোমতে।’
প্রেক্ষাগৃহ আপাতত বন্ধ রাখা বা ভেঙে ফেলার কোনো ইচ্ছা এর মালিক পরিতোষ সাহার নেই। তিনি জানান, ‘জেলা শহরে আর তো কোনো হল থাকল না। সরকারও চায় প্রত্যেক জেলা শহরে একটা করে বিনোদনের জায়গা থাকুক। আমিও তাই চায়। ভগবান তো আর আমাকে কম দেননি। দেখি কতদিন টিকাইয়া রাখতে পারি।’
শক্তিচরণ সাহা, নারায়ন সাহা, সুধাংশু মৈত্র সবারই বয়স হয়েছে। একসময় এই প্রেক্ষাগৃহ যেমন তাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছিল, রুটি-রুজির জোগান দিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের সঙ্কটের মুহূর্তে দীর্ঘদিনের মায়া ছিন্ন করে এই বয়সে অন্য কোথাও যেতেও পারছেন না তারা। তবে পরিচিতজন তো বটেই পরিবারের লোকজনও আর চায় না তারা প্রেক্ষাগৃহে কাজ করুক।
শক্তিচরণ সাহার ভাষায়, ‘এখন আর কেউ হয়তো চিন্তা করে না হলে কাজ করব। আমার মেয়েরা বারবার নিষেধ করে হলে আসতে। সিনেমার সাথে সাথে হলে কাজ করার সেই সম্মানের জায়গাও এখন নষ্ট হয়ে গেছে।’
পরিশেষে আক্ষেপের সুরেই শক্তিচরণ সাহা বলে ওঠেন, ‘নায়ক মান্নার মৃত্যুতে আমরা শেষ হয়ে গেছি। মান্না সাহেবের সিনেমা দেখার জন্য যে পরিমাণ লোকের ভিড় হত। তা আর কল্পনা করা যায় না। তার মৃত্যুতে পুরো ইন্ডাস্ট্রিটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে মনে করি আমি। তার সিনেমা যে আহামরি কিছু ছিলো তা কিন্তু নয়। তবে দর্শক আসতো। একটা শ্রেণির দর্শককে তিনি নিয়মিত হলে এনেছেন। কেউ কেউ ছিলেন মান্নার ছবি দেখতে সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই হলে এসেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া রিয়াজের ছবিও লোকে খুব দেখতো। শাবনূর ও পূর্ণিমার সঙ্গে তার ছবিগুলো হলে আসলেই দর্শকের মিলনমেলা বয়ে যেতো। বিশেষ করে নারী দর্শকরা আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে। সেইসব দৃশ্য এখন আর নেই। নানা কারণে তার মতো অভিনেতাও সিনেমায় নেই। শাবনূর, পূর্ণিমারাও নেই। দর্শকের আস্থার জায়গাটাও নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে দুই একটা চটকদারি নায়ক দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচে না। সব ধরণের দর্শক হলে টানার মতো আর কেউ নেই আমাদের। তাই এখন সেই লেভেলের নায়ক-নায়িকা তৈরি করতে হবে যারা সিনেমার দর্শক হলে টানবেন নামের জোরে।’
কেএ/এলএ