ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম আমার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর নানা কথা, নানা কর্ম, নানা লেখা আমাকে অনুপ্রাণিত করে, উজ্জীবিত করে। অতি দরিদ্র জেলে পরিবার থেকে উঠে আসা এপিজে কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তাঁর কর্মগুণে। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে দুদিন ছুটি নিয়োছিলেন- বাবা ও মায়ের মৃত্যুর দিনে। বাসযোগ্য পৃথিবীর কথা বলতে বলতেই তিনি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। এপিজে কালাম আগেই বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুতে যেন সরকারি ছুটি দেয়া না হয়। কাউকে স্মরণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আরো বেশি করে কাজ করা। এপিজে কালাম আরো বেশি কাজ দিয়েই তাঁকে স্মরণ করার কথা বলে গেছেন।
Advertisement
বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর দিনটি পালিত হয় জাতীয় শোক দিবস হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে যে নিষ্ঠুরতায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তা গোটা বিশ্বেই নির্মমতার উদাহরণ হয়ে আছে। আধুনিক সময়ে এমন ঘটনা নেই। সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে জাতীয় শোক দিবস পালন করে। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। দিনভর নানা আয়োজনের সুবিধার জন্যই সরকারি ছুটি দেয়া হয়। কিন্তু সরকারি ছুটির মানে তো এই নয় যে সব কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার অনেক উপায় আছে। তার মধ্যে একটি হতে পারে, আরো বেশি করে কাজ করা। গত কয়েকবছর ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটাই হয়ে আসছে। সেখানকার ডাক্তাররা জাতীয় শোক দিবসে বিনামূল্যে রোগী দেখেন। এবার যেমন জাতীয় শোক দিবসে প্রায় ৫ হাজার রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের এই উদাহরণ সবার জন্যই অনুসরণীয় হতে পারে। কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে উল্টা ঘটনা। সেখানকার সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া তারেক ১৫ আগস্ট সকালে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ক্যাম্পাসে আসেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এসময় কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, কয়েকদিন পর তাদের পরীক্ষা। তারা কিছু বিষয় বুঝছে না, একটু সময় দিতে। ওই শিক্ষক তখন তাদেরকে ডিপার্টমেন্টে তাঁর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন।
কিছুক্ষণ পর তারেক ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখেন ওখানে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী অপেক্ষা করছেন। তার রুমে, জায়গা হবে না বলে পাশের একটি রুমে যেত বলেন। সেখানেই তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন। একজন শিক্ষক ছুটির দিনেও শিক্ষার্থীদের সময় দিয়েছেন, তাদের সমস্যার সমাধান করেছেন, এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হলে কী করতেন? নিশ্চয়ই তারেককে একটি প্রশংসাপত্র দিতেন। কিন্তু ঘটেছে উল্টো ঘটনা। ছাত্রলীগ নেতারা কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে ক্লাশরুমে গিয়ে তারেককে ‘হাতেনাতে’ ধরে ফেলে। ছাত্রলীগ সেখানে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষে সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ উপাচার্য বরাবর এক আবেদনে বলেন, ‘১৫ আগস্ট কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী পালন করছিল। কিন্তু গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুল হক ভুইয়া তারেক তার বিভাগের ১ম ব্যাচের ক্লাশ নিচ্ছেন। যা জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধার পরিপন্থি। যা জাতির জনকের মত মহান ব্যক্তির মান ক্ষুণ্ন করেছে। যা একটি দেশদ্রোহী কাজ।
Advertisement
ছাত্রলীগ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘দেশদ্রোহী’ শিক্ষক তারেককে বহিস্কারের দাবি জানায়। নইলে ক্লাশ-পরীক্ষা বর্জনসহ কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেয়। আপনি ভিসি হলে এই হুমকির জবাবে কী করতেন? নিশ্চয়ই ছাত্রলীগের দুই নেতাকে সাময়িক হলেও বহিস্কার করতেন। কিন্তু এখানেও ঘটেছে উল্টো ঘটনা। ছাত্রলীগের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ‘অভিযুক্ত’ শিক্ষক তারেককে এক মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন নানা অজুহাতে ছুটি কাটান, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নেন, কনসাল্টেন্সি করেন; তখন ছুটির দিনে ক্লাশ নেয়ার অপরাধে একজন শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়! বিস্মিত হওয়ার সীমায়ও কুলাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তারা কী খুঁজবে? মাহবুবুল হক ভুইয়া তারেক ফেসবুকে দাবি করেছেন, যাদের ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে ব্যাচের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ইতিমধ্যে একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিতও হয়েছে। সুতরাং এখন তাদের কোনও ক্লাস নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি ধরে নিচ্ছি, আনুষ্ঠানিক হোক আর অনানুষ্ঠানিক ক্লাশ তিনি নিয়েছেন। কিন্তু ক্লাশ নেয়াটা একজন শিক্ষকের জন্য অপরাধ হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ফেসবুকে এক মন্তব্যে দাবি করেছেন, শিক্ষক তারেক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ফুল দেননি। বরং ক্লাশ নিয়েছেন। আমি যদি ছাত্রলীগ সভাপতির দাবিকেই সত্য বলে ধরে নেই, তাহলেও এখানে তারেকের অপরাধটা আমার মাথায় ঢুকছে না।
বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। দল-মত নির্বিশেষে সবারই উচিত তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। এখন আর ১৫ আগস্টে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাওয়া হয় না। কিন্তু যখনই ঐ এলাকায় যাই, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকি। বনানী কবরস্থানে সারি বাঁধা কবরের সামনে গেলে শোকে স্তব্ধ হয়ে যাই। কিন্তু ১৫ আগস্টে বাংলাদেশের সবাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ফুল দিতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা কি আছে কোথাও? কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-শিক্ষকের কি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ফুল দিতেই হবে? শিক্ষক তারেক দাবি করেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন, তখনই শিক্ষার্থীরা তার কাছে কিছু বিষয় বুঝতে চেয়েছেন। আর ছাত্রলীগ সভাপতি দাবি করেছেন, তারেক সেখানে যাননি। না গেলেই তার বিরুদ্ধে মিছিল করতে হবে, আলটিমেটাম দিতে হবে?
যতটুকু খবর পেয়েছি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিযাস হোসেন একসময় ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় এই ‘ফার্মের মুরগি’দের এখনই থামাতে না পারলে সামনের এর জন্য আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হবে। কোনটা বঙ্গবন্ধুর জন্য অবমাননাকর, কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়; এই ধারণাটাই নেই এই হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের। কয়েকদিন আগে বরিশালে পঞ্চম শ্রেনির শিশুর আঁকা ছবি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর ‘অপরাধে’ আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সাজুর মামলায় ইউএনও গাজী তারেক সালমনের কারাভোগের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নিস্তার পেয়েছেন তারেক সালমন। বহিস্কার করা হয়েছে সেই আওয়ামী লীগ নেতাকে। আমি বলছি না কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায়ও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কথায় কথায় সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীকে টানা তার প্রতি এক ধরনের অন্যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু সব বিষয় দেখার জন্য আলাদা আলাদা মন্ত্রী আছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক আছেন। তাদের কাছেই আমি দাবি জানাচ্ছি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অবিলম্বে বহিস্কার এবং উপাচার্যকে অপসারণ করার।
Advertisement
সময় এসেছে কোনটা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানো আর কোনটা অবমাননা, তার একটা সীমা নির্ধারণের। গত কয়েকবছর ধরেই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার নামে বাড়াবাড়ি করে তাঁকে আসলে অবমাননাই করা হয়েছে। যেমন এবার চট্টগ্রামে হাজী ইকবাল নামে এক লোক জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে মাতম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে মহররমে স্টাইলে ছুরি নিয়ে ‘হায় মুজিব, হায় মুজিব’ বলে মাতম করে লোক হাসিয়েছেন। টানা দুইদিন ধরে পাড়া-মহল্লায় মাইকে দেশাত্মবোধক গান আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজিয়ে সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করা হয়েছে। সারাদেশ যখন বন্যায় ভাসছে কাঙালি ভোজের নামে শহরে খিচুরি আর বিরানির অপচয় হয়েছে।বরিশালে ইউএনও’র কারাভোগের পর শিশুরা আর ভয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকতে চাইবে না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর কেউ আর জাতীয় শোক দিবসে ভয়ে ঘর থেকে বের হবে না। এভাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে সত্যিকারের অবমাননা করা হচ্ছে।
জাতীয় শোক দিবসের যে ভাবগম্ভীর পরিবেশ ও শোকের আবহ থাকার কথা, গত কয়েকবছরে সেটা অনুপস্থিত। তাই জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানমালার একটা তালিকা থাকা দরকার। নইলে জাতীয় শোক দিবসে ছুটি পেয়ে কিছু লোক ঘরে শুয়ে-বসে থাকবে। আর কিছু লোক বাড়াবাড়ি করে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেই কাজটাই করছেন। কাজ দিয়েই বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশ। জাতীয় শোক দিবসে সরকারি ছুটি থাকুক। কিন্তু ছুটি মানেই সব কাজ ফেলে ঘরে বসে থাকা নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে শক্তিশালী করতে সবাইকে আরো বেশি করে কাজ করতে। কাজ দিয়েই স্মরণ করতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। জাতীয় শোক দিবসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ক্লাশের ব্যবস্থা করে, সেখানে বঙ্গবন্ধু জীবন-দর্শন নিয়ে আলোচনা করলেই বরং তাঁকে সঠিক মর্যাদা দেয়া হবে। ক্লাশ করার অপরাধে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বঙ্গবন্ধুর আত্মা কষ্ট পাবে।
১৯ আগস্ট, ২০১৭probhash2000@gmail.com
এইচআর/পিআর