দেশজুড়ে

নাই বাহে সব গেইছে

‘কিচ্ছু নাই। সোউগ ভাসি গেইছে। আল্লাহ ছোয়া (সন্তান) দুইট্যাক আর মোক বাঁছাইছে। না হইলে তো ঘরের সাথত হামরাও হারে গেইলং হয়। বাড়ি-ঘর গুল্যা নিয়্যা গেইল সবকিছু। ঘরের একমুঠ দানাও বের করবার পাই নাই’। ঘুন্টিঘরের মোড়ে চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রিজুফা বেগম। তার চোখে এখনও ভাসছে ঘর ভাসার স্মৃতি। অনেক কষ্টে গড়া বাড়িটির তিনটি ঘরসহ আসবাবপত্র সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যার পানি। অল্পের জন্য রক্ষা পেছেয়েন স্বামীসহ ও দুই সন্তান।

Advertisement

কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ ভরতেরছড়া ঘুন্টিঘর এলাকার বাসিন্দা রিজুফা বেগম (৪৫)। স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী। তেমন কোনো কাজই করতে পারে না। মসজিদের খাদেম। রিজুফা অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ ও রাস্তায় মাটি কেটে অনেক কষ্টে তিনটি ঘর বানিয়েছিলেন। দিনভর খাটুনি শেষে এক মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে রাতটা কাটাতেন সে ঘরে। নিজের ঘরে অর্ধাহারে শুইলে অন্তত ক্লান্তি থাকতো না। কিন্তু সেই প্রশান্তির জায়গাটুকুও নেই। বন্যায় তার তিনটি ঘর ভেসে গেছে। ভেসে গেছে ঘরের জিনিসিপত্র। রাত গভীরে পানির হানায় কোনোমতে দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে ঘর থেকে বের হন। মুহূর্তে পানিতে ভেসে যায় তার ঘরবাড়ি। এখন সন্তানদের ঘুমপাড়ানো তো দুরের কথা খাওয়ানোরও কিছু নেই। সারাদিন সন্তানদের নিয়ে বসে তাকিয়ে থাকেন যেদিকে তার ঘরগুলো চলে গেছে সেদিকে।

রিজুফা বেগম বলেন, ‘বাড়ি-ঘর গুল্যা নিয়্যা গেইল সবকিছু। ঘরের একমুঠ দানাও বের করবার পাই নাই’। ছাওয়াগুলাক নিয়্যা খুব কষ্টে আছি। খাবারও নাই; শুব্যারও জায়গা নাই। খুব কষ্ট কইরা ঘর তিনটা করছি। এ্যাহন যদি দশজনে সহযোগিতা করিল হয়।

কুড়িগ্রামে দ্বিতীয়দফা বন্যা শুরু হয়েছিল জেলার উত্তরের ভারত লাগোয়া উপজেলা ভুরুঙ্গামারী থেকে। এ বন্যায় জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে ভুরুঙ্গামারী উপজেলায়। বন্যার স্রোতে দু’জন ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। শতাধিক ঘর-বাড়ি। আসবাবপত্র টাকা ও ধান-চাল। সেগুলো খুঁজেও পাওয়া যায়নি।

Advertisement

উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়নের তিন নং ওয়ার্ড দক্ষিণ ভরতেরছড়া। এ ওয়ার্ডেরই প্রায় ৭০ বাড়ির হদিস নেই। ভাটিতে চলে গেছে। হাফ কি.মি এক কি.মি. ভাটিতে কয়েকটি ঘরের টিন মিললেও তা ব্যবহার উপযোগী নয়। এছাড়াও শতাধিক বাড়ি ঘর ভেঙে পড়েছে। বাদ যায়নি পাকা ঘর। পাকা সড়ক। গাছ-পালাসহ সবজি ক্ষেত।

অনেকের গবাদিপশু ও হাস-মুরগী ভেসে গেছে। ওই এলাকা দেখলে মনে হচ্ছে যেন সদ্য হয়ে গেল ঘুর্ণিঝড়। ঠাঁই নেই অনেকের, রাস্তার উপরে কারও ঠাঁই মিললেও মিলছে না তিনবেলা খাবার।

বর্তমানে দক্ষিণ ভরতের ছড়া গ্রামের বাসিন্দা ওমর আলী ছিলেন গুনাইরকুটি গ্রামের বাসিন্দা। গত বছরের শেষ বন্যার রাক্ষসী দুধকুমরের গ্রাসে চলে যায় ভিটে-মাটি। সবকিছু হারিয়ে আট মাস আগে দক্ষিণ ভরতের ছড়ায় এসে বাড়ি করেন ছেলে জহুরুল ইসলাম। সবেমাত্র ঘর-বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। সে সময়ে বন্যা এসে সবকিছু ভেঙে ওলপ-পালট করে দিল। এতে নির্বাক হয়ে গেছেন ওমর আলী।

ছেলে জহুরুল ইসলাম বলেন, বাবার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। গেল বছরের বন্যায় বাড়ি ভাঙ্গি নিল দুধকুমর। কী কষ্ট করে বাড়িটা করলাম। কাজ শেষ না হতেই বাড়ি শেষ। এসব টিন কাঠ যা আছে কিছুই চলবে না। তার বাবার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলে শুধু বলেন ‘নাই বাহে সব গেইছে’।

Advertisement

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ঘরবাড়ির সঙ্গে রাস্তা-ঘাটেরও বেহাল অবস্থা। সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে ভুরুঙ্গামারী বাসস্ট্যান্ড সড়কে প্রায় ২৫ স্থান ভেঙেছে। এর মধ্যে তিন স্থানে ড্রামের তৈরি ভেলা দিয়ে লোকজন পারাপার করছে। সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে অনেক। ঘরবাড়ি, অর্থ-সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব বানভাসীরা এখন তাকিয়ে সরকারের দিকে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী জানান, ভুরুঙ্গামারীর সবচেয়ে বেশি হয়েছে বঙ্গসোনাহাটে। জেলার অন্য কোন ইউনিয়নে এত ক্ষতি মনে হয় হয়নি। আমরা তালিকা করেছি।

ভুরুঙ্গামারী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রবিউল ইসলাম বলেন, ভুরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজাহারুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, যারা একদম বাড়ি-ঘর হারিয়েছে, যাদের ভেঙে পড়েছে এবং যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব তালিকা করা হয়েছে। অনেককে আগে থেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা সরকারি টিন বরাদ্দ চেয়েছি। পাওয়া গেলে তাদের বিতরণ করা হবে।

এছাড়া যদি কেউ গুচ্ছগ্রাম বা অবাসনে যেতে চায় ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। সরকারের সামাজিক বেস্টনীর যেসব কর্মসূচি রয়েছে তাতে বন্যার্তদের অগ্রাধীকার দেয়া হবে। নাজমুল হোসেন/এফএ/পিআর