মতামত

একুশে আগস্ট : চিরতরে বিভক্ত করেছে বাংলাদেশের রাজনীতিকে

১৫ আগস্ট গেলো, সমাগত একুশে আগস্ট। ইতিহাসে জঘন্যতম কলঙ্কের দিন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার দলকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের এ দিনে বর্বরতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিলো। নির্মম হামলার ঘটনায় শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিরপরাধ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। হামলায় শত শত মানুষ মারাত্মক জখম হন, চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। এক যুগের বেশি সময় গেলো, কিন্তু বিচার কাজ শেষ হলো না।

Advertisement

বিচার কাজ শেষ হয়নি, কিন্তু তথ্য উপাত্ত এটাই প্রমাণ করে, সেদিন একমাত্র লক্ষ্য ছিলো শেখ হাসিনাকে হত্যা করা এবং সেই সাথে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা। সে সময় সরকারে জামায়াত-বিএনপি জোট এবং সেই সরকারের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু তা শুধু চূড়ান্ত প্রমাণাদিই বলবে। তবে, তখনকার সরকার এতটুকু গুরুত্বও দেয়নি ঘটনাকে। বরং সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেছে বিচার যেন না হয়।

সিআইডির তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান গ্রেনেড হামলার প্রথম পরিকল্পনাকারী। তিনি রাজধানীর পশ্চিম বাড্ডায় সংগঠনের নেতা কাজলের বাসায় অন্যদের নিয়ে ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় বৈঠক করেন। পরদিন সকালে ঐ বাসায় আবার বৈঠক করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। একই দিন বিকালে কাজল ও জান্দাল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে এলাকা রেকি করে। এরপর সন্ধ্যায় মুফতি হান্নান, মওলানা তাহের, তাজউদ্দিন, কাজল ও জান্দাল তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির সরকারি বাসায় বৈঠক করেন। পিন্টুর ভাই তাজউদ্দিন হামলার পর প্রশাসনিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে জান্দাল ও কাজলের কাছে ১৫টি গ্রেনেড দেন। তাজউদ্দিন এ বলে আরো নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে চলে যাবে। আর এ কাজটি বড়ভাই (পিন্টু) করে দেবেন।

একুশে আগস্ট সকালে বাড্ডায় কাজলের বাসায় আক্রমণের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা একত্র হয়। সবাই একসঙ্গে জোহরের নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খায়। তারপর সবার উদ্দেশে মওলানা সাইদ জিহাদ বিষয়ক বয়ান করেন। মুফতি হান্নান হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড দেন। আছরের নামাজের সময় সবাই যার যার মতো গিয়ে গোলাপ শাহ মাজারের কাছে মসজিদে মিলিত হয়। সেখান থেকে তারা সমাবেশ মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকটির তিন দিকে অবস্থান নেয়। শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ট্রাকে তৈরি মঞ্চে গ্রেনেড আক্রমণ করা হয়। এরপর তারা সমাবেশে উপস্থিত লোকদের সঙ্গে মিশে গা ঢাকা দেয়।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকার সে সময় বিচারতো করেইনি, উল্টো তদন্তের নামে জজ মিয়া নাটক করে বিচার ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরস্থায়ীভাবে বিভাজিত করেছে একুশে আগস্টের ঘটনা। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আর ২০০৪ সালের একুশে আগস্টকে আলাদা করে দেখা যায় না। যে শক্তি ১৯৭৫-এর ঘটনা ঘটিয়েছিলো, তারা এবং তাদের উপকারভোগীরা ক্ষমতায় বসে এ একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজনের একটি নাতি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ধর্মকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করে, তাদের পেশিশক্তিও কম নয়। এরা রগ কাটে, এরা খুন করে যেমন করে এরা করেছিলো ১৯৭১-এ। তারা আগুন সন্ত্রাস করে, তারা গ্রেনেড হামলা করে।

একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তারাই একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে, তারাই লাগাতার দেশের নানা অঞ্চলে মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করেছে, তেমনি এরা ভিন্ন ধর্মই কেবল নয়, ইসলাম ধর্মের ভেতরকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রুপগুলোকেও তাদের আক্রোশের লক্ষ্য করেছে। বাংলাদেশের বেঁচে থাকার প্রধান স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা আজ ভয়ংকর চাপে পড়েছে এ গোষ্ঠীর তৎপরতায়। অতিথিপরায়ণ বাংলাদেশে নিরপরাধ বিদেশিকে খুন করে আজ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তারা ধ্বংস করতে চায়। মসজিদে হামলা, ধর্মযাজকদের গলা কাটার চেষ্টা আর হুমকি, সবই ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট আর ২০০৪ এর একুশে আগস্টের সাথে সম্পর্কিত।

আতংকিত মানুষ এখন উন্নত দেশে, আমাদের দেশেও। এই আতংক সমাজে পরাজিত হয় যদি রাজনীতি তার সঙ্গী না হয়। পাশ্চাত্যে সব শক্তি একাট্টা অন্ধকারের শক্তিকের পরাভূত করতে। কিন্তু আমাদের দেশে মৌলিক জায়গায় গোলযোগ। ধর্মের নামে খুনের কারবারিরা যা চায়, তা তাদের হাতে তুলে দিতে তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে আচমকাই বিতর্ক তুলে, অশ্লীলভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করে। এ সবই মসজিদে হামলাকারী, লেখক হত্যাকারীদের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন।

Advertisement

হত্যাকারীদের অনুসারীরা এখনো আমাদের আশপাশে, প্রশাসনযন্ত্রের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। আওয়ামী লীগকে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল দিয়ে তা প্রতিহত করতে হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করতে চেয়েছিলো। সে চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে তার প্রমাণ এবার ১৫ আগস্ট পান্থ পথে, ধানমন্ডি ৩২-এর খুব কাছে আত্মঘাতী জঙ্গির অবস্থান। পুলিশের তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টা আর দৃঢ়তায় তা ভুন্ডুল হয়।

এ সন্ত্রাসী শক্তির পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাশকতা, ধ্বংসলীলা বন্ধ করতে সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে সংগঠিত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির ঐক্য গড়ে উঠা জরুরি। ধর্মদ্রোহীদের সঙ্গে আপস নয়। মুক্তিযুদ্ধ জনগণের বিজয় এনে দিয়েছে, তাকে ধরে রাখতে সব ধর্মের মানুষ চাই।

একুশে আগস্ট, বাংলাদেশকে রাজনীতির ইতিহাসে একটি ভয়াবহ, কুৎসিত হিংস্র দিন। এ ভয়াবহতম হিংসাত্মক রাজনীতির ন্যক্কারকজনক হামলার উদ্দেশ্য ছিলো, নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা। সেটা করতে পারলে, মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য চেতনাকে নস্যাৎ করা সম্ভব হবে। এটাই তাদের ভাবনা ছিলো। উনিশ শ’ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বকে খতম করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন নষ্ট করে দেয়া সম্ভব। এই দর্শনের সরাসরি প্রতিফলন ছিল একুশে আগস্ট। যতদিন এই ঘটনার দগদগে স্মৃতি থাকবে ততদিন কোন ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব নয় এদেশে। চিরস্থায়ীভাবে বিভাজিত পথেই চলবে রাজনীতি– মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাংলাদেশ, নেতৃত্বে শেখ হাসিনা এবং অন্যটি বাংলাদেশ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/জেআইএম