দেশজুড়ে

ঘুরে দাঁড়িয়েছে মৃৎশিল্প

কুমিল্লার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান মৃৎশিল্পের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে মাত্র দেড়শ টাকা আমানত সংগ্রহ করে কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরে রুদ্রপাল বংশের ১৫ সদস্য নিয়ে ১৯৬১ সালে সমবায়ী সংগঠন রুদ্রপাল সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সমিতির সদস্য ছাড়াও প্রায় ৭শ পরিবার এখন এই মৃৎ শিল্পের মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। সময়ের বিবর্তনে ও চাহিদার কারণে ক্রমেই এই মৃৎশিল্পে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বর্তমানে এখানকার পণ্য-সামগ্রী দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বেশ সুনাম অর্জন করেছে।

Advertisement

অবস্থান

বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎ শিল্পের অবস্থান কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কের কোলঘেঁষে জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরে। জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলাধীন দক্ষিণ বিজয়পুর, গাংকুল, টেগুরিয়াপাড়া, নোয়াপাড়া, বারপাড়া, উত্তর বিজয়পুর ও দুর্গাপুরসহ মোট ৭টি গ্রামের (কুমার) মৃৎশিল্পীগণ এ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছেন। শুরুর দিকে মাত্র ১৫ জন সদস্য সমন্বয়ে সমিতি গঠন করা হলেও পর্যায়ক্রমে সমিতির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৩ শতাধিক উন্নীত হয়েছে। রয়েছে নারী সদস্যও। এলাকায় বসবাসকারী ৭০০ পরিবারের প্রায় অধিকাংশ সদস্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

প্রতিষ্ঠা ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর গ্রামের মৃৎশিল্প বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। তবে ষাটের দশকে এ শিল্প দৈন্যদশায় পড়ে। ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে ষাটের দশকে এদেশের সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী প্রয়াত ড. আখতার হামিদ খান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তারই অনুপ্রেরণায় ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল বিজয়পুর গ্রামে ‘প্রগতি সংঘ’ নামীয় যুব সংগঠনটিকে রূপান্তরিত করা হয় ‘বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি’ নামে।

Advertisement

ওই সময় থেকে কুমিল্লার মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য বজায় রেখে এ সমবায় প্রতিষ্ঠানটি সুনাম ও ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী এ মৃৎশিল্প সমিতির অফিস ও মৃৎশিল্প উৎপাদন কেন্দ্রটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে মৃৎশিল্প সমিতিটি পুরো বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুমিল্লায় আসলে তাকে এ মৃৎশিল্পটির কথা জানানো হয়। ৭৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ায় এ মৃৎশিল্পটি, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে আপন ঐতিহ্যে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা ও বিস্তার ঘটানোর জন্য এখানে মৃৎশিল্পের উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ মৃৎশিল্পী তৈরি করা হচ্ছে। চার যুগের অধিক সময় ধরে এলাকার হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৭শ পরিবারের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে যাচ্ছে এই মৃৎশিল্প।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে

দেশের চাহিদা মিটিয়ে ক্রমান্বয়ে এসব মাটির তৈরি সামগ্রী এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি রোটারিয়ান তাপস কুমার পাল জানান, কুমিল্লায় উৎপাদিত মৃৎ পণ্যগুলো বিদেশের বাজারেও বেশ সমাদৃত। এসব পণ্য আমেরিকা, লন্ডন, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, জাপান, হল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে রফতানি করে আসছে। ইতোমধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, অক্সফোর্ড ভার্সিটির একটি প্রতিনিধি দল, পাকিস্তানের মিলিটারি চিফ, ইংল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাসহ বিদেশি ব্যক্তিবর্গ এখানে এসে পরিদর্শন করে তাদের উৎপাদিত পণ্য দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

Advertisement

যে কারণে বাড়ছে মৃৎ শিল্পের চাহিদা

প্রাচীনকালে মৃৎশিল্প মানেই যে কেউ বুঝতো মাটির জিনিসপত্র। কখেনো কখনো তা ছিল গরীবের পণ্য। পণ্যের তালিকায় ছিল মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিল, কলস, সরা, বাসন, দইয়ের মালসা, সাজের হাড়ি, মাটির ব্যাংক, শিশুদের বিভিন্ন খেলনা। কিন্তু ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে পণ্য তালিকা। মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মৃৎ শিল্পে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বর্তমানে মৃৎ শিল্পের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে মানুষ শৌখিনতার জন্য মাটির তৈরি জিনিসপত্র ঘরের বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে ঘরের শোভা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে, কেউবা অফিসে।

এছাড়া বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব লোক দ্বারা নিত্য নতুন ডিজাইনের মাটির জিনিস বাজারে বিক্রয়ের পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করছে যা আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। গত অর্থ বছরে খরচ মিটিয়ে এ সমিতির প্রায় ১০ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সম্ভাবনার মাঝেও আছে সমস্যা

এতসব সম্ভাবনার মাঝে সমস্যাও কম নয়। বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি রোটারিয়ান তাপস কুমার পাল এবং এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা জানান, গত তিন বছর যাবত গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিপুল ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। প্রতিদিন গ্যাসের চাপ খুব কম থাকায় মালামাল তৈরিতে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। তাই বিকল্প উপায়ে অন্যান্য জ্বালানী দিয়ে মাল তৈরি করতে খরচ বেশি হচ্ছে। এতে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

গ্যাস সংকটের কারণে উচ্চ মূল্যে জ্বালানী ও মাটি ক্রয় করতে গিয়ে পণ্য সামগ্রীর দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়েছে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি। তাই প্রতিটি পণ্যের তৈরির পেছনে আগের চেয়ে মূল্য ক্রমেই বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও ইতিবাচকভাবে না নেয়ায় কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাওয়া যায় না।

কামাল উদ্দিন/এফএ/এমএস