স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সাল থেকে করনেশন হল ভাড়া নিয়ে আবার চলচ্চিত্রের প্রদর্শন চালাতে থাকেন টুনু মিয়া। এবার ‘কমলা টকিজ’র বদলে ‘মুক্তি সিনেমা’ নাম দেন তিনি। বিনোদনের অন্য কোনো মাধ্যম না থাকা এবং নওগাঁ শহরজুড়ে মাত্র একটি প্রেক্ষাগৃহ হওয়ায় দর্শকের ভিড় সামাল দিতে খানিকটা হিমশিম খান টুনু মিয়া।
Advertisement
তার ওপর করনেশন হল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনে এবং বিভিন্ন দিবসে চলচ্চিত্রের প্রদর্শন বন্ধ রাখতে হত। এসব সঙ্কটের কারণে টুনু মিয়া বিকল্প চিন্তা করতে থাকেন।
সরকারিভাবে ১৯৭৮ সালে দ্বি-বার্ষিক পুঁজি বিনিয়োগ কর্মসূচিতে বেসরকারি খাতে প্রায় দুই শতাধিক স্বল্প ব্যয়ের প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। পাশাপাশি শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থাকে ঋণ দেয়ার নির্দেশ দিলে বিষম্বর ঠাকুরের এক বন্ধু সেই ঋণ নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করবেন বলে জানান তাকে।
তৎক্ষণাৎ বিষম্বর ঠাকুর সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজের টাকায় আবার প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করবেন। ১৯৮০ সালে ৯৭০ আসনে আগের ‘চিত্রবাণী লিমিটেড’র স্থলে ভবন নির্মাণ করে নাম দেন ‘তাজ সিনেমা’। চাষী নজরুলের ‘ওরা এগারো জন’ দিয়ে প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন করলে বিপুলসংখ্যক দর্শক হয়। এরপর ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘বাঘা বাঙ্গালী’ দেখানোর সময়ও এই ভিড় লক্ষ করা যায়।
Advertisement
তাজ সিনেমার ব্যবস্থাপক নারায়ণ সাহা জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, সাহিত্যধর্মী এবং চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার মতো সিনেমাগুলো এখানে ভালো চলত।’ অন্যসব চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতেও সব শ্রেণির দর্শক আসত। সে কারণে তিনটি শো থেকে বাড়িয়ে চারটি শো চালানো হত।
তাজ সিনেমার কাউন্টার মাস্টার শক্তিচরণ সাহা বলেন, ‘সিনেমা হলের টাকা হলো কাঁচা টাকা। এর চেয়ে লাভজনক ব্যবসা আর দ্বিতীয়টি নেই।’
১৯৮২ সালে এসে টুনু মিয়া ‘মুক্তি সিনেমা’ চালানোর টাকায় নিজের জমিতে ‘রুবী সিনেমা’ নামে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। একই শহরে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ থাকার পরও দর্শক চাহিদার কারণে অতিরিক্ত চেয়ার ঢুকাতে হতো বলে জানান নারায়ণ সাহা।
তার ভাষায়, ‘কোন সিনেমার কথা আলাদাভাবে বলব? তখনকার সব সিনেমাই ব্যবসা করত। রাজ্জাক, কবরী, ববিতা, ফারুক, আলমগীর, শাবানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনূর কিংবা মান্না; সবার সিনেমা দেখার জন্য মানুষজন সিনেমাহলে এসেছে।
Advertisement
তবে বেদের মেয়ে জোসনা যখন ‘রুবী সিনেমা’য় পাঁচ মাস ধরে চলে; তখন আমাদের এখানে কয়েকদিন লোকজন আসেনি। পরে অবশ্য সেটা ঠিক হয়ে গেছে।’
নারায়ণ সাহার বাবার বন্ধু বিষম্বর ঠাকুর। সেই সূত্র ধরেই বিষম্বর ঠাকুর তার প্রেক্ষাগৃহ দেখভালের দায়িত্ব নারায়ণকে দেন। বিএ পাস নারায়ণ কোনো চাকরি না করে মাসিক এক হাজার তিনশ টাকা সম্মানিতে প্রেক্ষাগৃহে থেকে গেছেন কেবল সম্মানের জন্য।
তার ভাষায়, ‘সেসময় যখন সিনেমা হলে কাজ করছি এটা ছিল অনেক সম্মানের। তার ওপর আমি তো হলের ম্যানেজার। চাইলেই যে কাউকে টিকিট দিতে পারি। বন্ধু-বান্ধব সবাই আমার কাছে আবদার করত, অমুক দিন সিনেমা দেখতে আসব দোস্ত, একটু টিকিট মেনেজ করে দিস। ভালো লাগত।’
তাজ সিনেমার অন্যসব কর্মচারীও উচ্চশিক্ষিত। হিসাবরক্ষক শুধাংশু মৈত্র বিএ পাস। পেশায় তিনি জেলা পরিষদের অফিস সুপার। শক্তিচরণ সাহাও উচ্চ মাধ্যমিক পাস। তিনি বলেন, ‘হল থেকে আর কয় টাকাইবা বেতন দেয়। আগে সিনেমা ভালো চলত, টাকা এমনিতেই চলে আসত। আমার পাড়ার লোকদের মধ্যে আমার বাড়িতে সব থেকে ভালো রান্না হত। সবাই বলত শক্তির হলের টাকা, ওর সাথে কি আর আমরা পারি।’
তার ওপর ১৯৮৪ সালে এসে প্রেক্ষাগৃহের আসন সংখ্যার ভিত্তিতে কর দেয়া শুরু হয়; ফলে কর নির্ধারণ হয়ে যায়। এতে অতিরিক্ত আয় থেকে সরকারকে কোনো কর দিতে হতো না। এসময় বিষম্বর ঠাকুর সেই লাভের অংশ থেকে হলের কর্মচারীদেরও একটা অংশ দিতেন।
নারায়ণ সাহা বলেন, ‘রসের বাইদানী’, ‘রঙিন রূপবান’, ‘দহন’, ‘তোলপাড়’, ‘রাঙা ভাবী’ চালিয়ে ব্যাপক ইনকাম হইছে সেসময়। পরিস্থিতিটা এমন, ঠাকুরের সব ব্যবসার চেয়ে হলের ইনকাম ছিল সব থেকে বেশি। সে কারণে অন্য কোনো দোকানে তিনি যেতে না পারলেও দিনে অন্তত একবার সিনেমা হলে আসতেন। তার বাড়িতেও সিনেমা হলের লোকজনের আপ্যায়ন ছিল সবার থেকে আলাদা।’
প্রেক্ষাগৃহের সুপারভাইজার নিজ থেকেই বলেন, ‘আগে এখানকার ডিসি, এসপি, ম্যাজিস্ট্রেট সবাই এক নামে আমাকে চিনত। দেখা হলেই খোঁজখবর নিত। বাড়ির লোকজনদের নিয়ে যেদিন সিনেমা দেখতে আসত, বাচ্চা-কাচ্চার খাবার-দাবার কিনে দেয়া থেকে কান্নাকাটি করলে সামলানোও আমাকেই করতে হতো। সিনেমা দেখে যাওয়ার সময় বকশিশও দিয়ে যেত তারা। আমার পাড়ার কেউ ভেজাল-ক্যাচালে পড়লে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। ওরা ভাবে সবার সঙ্গে তো আমার ভালো সম্পর্ক।’
তবে অনেকটা আক্ষেপের সুরে নারায়ণ সাহা জানান, ‘ওই সময় (আশির দশক) ‘দহন’, ‘পেনশন’, ‘মোহনা’র মত কিছু অফ বিট ভালো ছবি নির্মাণ হলেও ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকার মত বাণিজ্যিক ধারার ভালো ছবি হয়নি। তার অবশ্য কারণও আছে। তখনকার সরকার হয়তো তেমন ছবি বানানোর জন্য অনুমতি দিত না। কেবল চাকচিক্য, রূপকথা নিয়ে সিনেমা হত। মানুষজনকে কল্পনার জগতে মানে রূপকথার জগৎ দেখিয়ে ভুলিয়ে রাখা হতো। ‘দহন’-এর মত ভালো মানের সিনেমা তো আর দেখলাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপন্যাস অবলম্বনে মৌলিক কাহিনিনির্ভর ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘রামের সুমতি’র মত কিছু ছবি হয়েছে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ব্যাপক ব্যবসা করেছে। আর অন্য যেসব সিনেমা হয়েছে একেবারে বিশ্রি অবস্থা। নাচগান আর ফ্যান্টাসি মার্কা সব সিনেমা।’
নারায়ণ সাহাকে থামিয়ে শক্তিচরণ সাহা বলেন, ‘তার অবশ্য কিছু কারণও আছে। ওই যে দু-একটা সিনেমার ব্যবসা দেখে সবাই একইরকম সিনেমা বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তাছাড়া নতুন ধরনের সিনেমা বানাতে যে মেধার দরকার হয়; আমাদের দেশের পরিচালকদের সেই মেধা নেই। নকল করতে করতে তো ইন্ডাস্ট্রিটাই শেষ করে দিল।’
তারপরও সেসব চলচ্চিত্রের দর্শক হতো প্রচুর। সেসময় নারী দর্শকই বেশি হতো বলে জানান শক্তিচরণ। তার কাছেই জানতে পারি, নারীদের আলাদা জায়গায় বসতে দেয়ার জন্য টর্চলাইট নিয়ে তাজ সিনেমা হলে লোক থাকত। নারীদের যাতে সিট পেতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে ব্যাপারে ওই লোক সহযোগিতা করত।
তিনি আরও জানান, ‘নারী দর্শকের ভিড় কেবল আমাদের হলেই যে হত, তা কিন্তু নয়। যে কোনো সিনেমা হলেই দেখবেন নারীদের জন্য আলাদা কাউন্টার রয়েছে। তাদের সংখ্যা কম হলে কি আরেকজনকে নারীদের জন্য টিকিট বিক্রি করতে আলাদা কাউন্টারে বসানো হত’, প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।
তবে চলচ্চিত্রের মান যেমনই হোক না কেন, সেসময় প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারীদের যে সুদিন ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নতুন কোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আগে থেকেই দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে আসার জন্য মুখিয়ে থাকত। প্রেক্ষাগৃহে কোন চলচ্চিত্র চলছে সেটা কিন্তু পারিবারিক আলোচনারই অংশ ছিল।
টেলিভিশন তেমন একটা না থাকলেও রেডিওতেই নতুন চলচ্চিত্রের খোঁজখবর জানতে পারত নওগাঁ সদরের দর্শকরা। সংবাদপত্রেও চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন দেয়া হত। তবে রেডিওতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে নতুন কোনো চলচ্চিত্রের কাহিনি হালকাভাবে বর্ণনা করে দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে টানার চেষ্টা চলত। আর প্রেক্ষাগৃহের প্রচারম্যানরা তো বিভিন্ন এলাকায় ভ্যানের ওপর দোচালা করে পোস্টার সাঁটিয়ে নিয়ে ঘুরে ঘুরে চলতি কোনো চলচ্চিত্রের প্রচার চালাত।
ফলে একপর্যায়ে চলচ্চিত্র আকর্ষণে নিজের তৃপ্তি মেটানোর জন্য দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ছুটে আসত। নারায়ণ সাহার ভাষায়, ‘তখনকার দর্শকের এখনকার মত এতো মাধ্যম ছিল না। টেলিভিশন সব বাড়িতে ছিল না; ভিসিআর কিংবা ডিভিডিও তেমন ছিল না; আর ফোন তো কয়দিন হল হাতে হাতে এসেছে। তখনকার দিনে তাদের সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হলেই আসতে হত। আর সিনেমা হল ছিল বিনোদনের প্রধান স্থান।’
কেএ/এলএ