বিবিধ

বাবা-মায়ের স্মৃতি বলতে শুধুই রক্তাক্ত লাশ

‘শুধুই বাবার লাশ, সাদা গেঞ্জি পরা। সিঁড়ির চৌকিতে পড়ে আছে লাশটি, গলায় গুলির রক্তাক্ত দাগ। গুলির সেই দাগটি এখনও স্মৃতিতে অম্লান। হ্যাঁ, আরও একটি দৃশ্য স্মৃতিতে আটকে আছে, বাবা-মার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর সিঁড়িতে পড়ে থাকা জমাট বাঁধা রক্ত।’

Advertisement

‘বাবা-মার আদর-আলিঙ্গন, হাসি-কান্না কোনো কিছুই আর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে না।’

১৫ আগস্টের দুর্বিষহ সেই স্মৃতির কথা জাগো নিউজ’র কাছে এভাবে ব্যক্ত করছিলেন ওই সময় প্রাণে বেঁচে যাওয়া মাত্র চার বছর বয়সী শিশু, বর্তমানে ৪৯ বছর বয়সী যুবক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। শৈশবে যেখানে দুরন্তপনা, বাবা-মায়ের ভালোবাসার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকার কথা সেখানে শৈশব স্মৃতির ফ্রেমবন্দি হয়ে আছে বিভীষিকাময় ওই রাতের দুর্বিষহ চিত্র।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকের গুলিতে বাবা শেখ ফজলুল হক মণিসহ অন্তঃসত্ত্বা মা আরজু মণিকে হারান অবুঝ দুই শিশু শেখ ফজলে শামস পরশ (৬) ও শেখ ফজলে নূর তাপস (৪)।

Advertisement

বাবা শেখ ফজলুল হক মণি (৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯-১৫ আগস্ট ১৯৭৫) ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনী তার নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়। তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়।

শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস আরও বলেন, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটানো মধুর সময়ের পরিষ্কার কোনো চিত্র আমার স্মৃতিতে নেই। অনেক ভেবেছি, অনেক চিন্তা করেছি, খুঁজেছি কিন্তু কোনো স্মৃতিই হৃদয়পটে আসেনি। শুধু খুব আবছা একটি চিত্র সব সময় আমার মাথায় এসেছে। যেটি শৈশবের খুঁজে পাওয়া একমাত্র স্মৃতি, আমার বাবার রক্তাক্ত লাশ।’

সেই রাতে ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল, শেখ মণির ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু খান।

ওই সময় বাবা-মা হারা দুই এতিম সন্তানের একমাত্র ছায়া হয়েছিলেন দাদি বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম। বেঁচে থেকেও পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়েছিল শেখ ফজলুল হক মণির দুই ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও শেখ ফজলুর রহমান মারুফকে।

Advertisement

সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমাদের বোঝানোর জন্য বলা হতো, বাবা-মা বিদেশে আছে। তোমরা কেঁদ না, এই তো চলে আসবে। কিছুদিন পরই চলে আসবে- এমনভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হতো। আত্মীয়দের বাসায় কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। প্রায় দুই বছর লুকিয়ে থাকার পর ১৯৭৮ সালে আমরা ভারতে চলে যাই। দাদি আমাদের সেখানে নিয়ে যান। চাচারা সবাই আগেই পালিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। কিছুদিন ভারতে থাকার পর আবার দেশে ফিরে আসি।’

তাপস বলেন, ‘আমরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যেতাম, আমাদের কেউ বাসা ভাড়া দিত না। আমরা বাসা ভাড়া পেতাম না। আত্মীয়দের বাসায় থাকতাম। অনেক দিন পর লালমাটিয়ার একটি বাসায় উঠি।’

আমাদের পড়ালেখা করতেও বাধা দেয়া হতো- জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কষ্টে পড়ালেখা শুরু করি। আমাদের স্কুলেও বেশিদিন থাকতে দেয়া হতো না। স্কুল কর্তৃপক্ষ শঙ্কার মধ্যে থাকত, যদি আমাদের কারণে স্কুলের ওপর খড়্গ নেমে আসে কি না! অনেক প্রতিকূলতার পরও আমাদের দাদি-দাদা, দুই চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, সর্বোপরি জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে ফিরে আসার পর আমাদের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। তাদের ভালোবাসা, আদর ও স্নেহে আজ এ অবস্থানে এসে পৌঁছেছি।’

বাবা-মায়ের আশা ছেড়ে দিতেই জীবনে নেমে এলো অন্য রকম এক বিষাদ। তাপস বলেন, ‘আমরা যখন উপলব্ধি করতে পারলাম বাবা-মাকে আর পাব না, তাদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময় আরও একটি উপলব্ধি এলো, ওই অন্যায়ের কোনো বিচার আমরা পাব না। বিষয়টি দীর্ঘদিন আমাদের তাড়িত করেছে। বিচারহীনতার কষ্ট অন্য রকম। আমার মৌলিক অধিকার কিন্তু সেটি আমাকে দেয়া হবে না! ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যখন বিচার কার্যক্রম শুরু হলো, নতুন এক শঙ্কায় পেয়ে বসল। হয়তো এ বিচার কার্যক্রম শেষ হবে না। বিচার সম্পন্ন করতে পারব না। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর সেই বিচারের কার্যক্রম শেষ হয়েছে, ফাঁসির আদেশও কার্যকর হয়েছে।’

শেখ মণির ছেলে বলেন, আগস্ট মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের বুকের ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের মনটা কালো ছায়ায় ঢেকে থাকে। তবুও এখন সান্ত্বনা পাই, বিচারটা সম্পন্ন হয়েছে। আমি নিজেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন এই বিচার না দেখে বুকভরা কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। এখনও অনেক খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। আমাদের দাবি থাকবে, তাদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা।

‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছাও উৎসর্গ করতে হয়েছে। ছোট চাচার অনুপ্রেরণায় বাবা-মায়ের হত্যার বিচারের জন্যই আইন বিষয়ে লেখাপড়া করি। আইন পেশায় যুক্ত হওয়া, রাজনীতিতে এসে আমার বাবার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা; জাতি গঠনে কিছুটা হলেও যদি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারি, সেই প্রয়াস এখন চালিয়ে যাচ্ছি।’

‘ছোট চাচা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আইন বিষয়ে পড়ার জন্য। আমার ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার, সাইন্স খুব ভালো লাগত কিন্তু চাচা আমাকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। পরবর্তীতে আমি সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। আইন বিষয়ে পড়ালেখা করলে এবং আইন পেশায় আসলে হয়তো আমার সুযোগ আসতে পারে বাবার হত্যার বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার। সেই সুযোগ আমি পেয়েছি।’

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যেও ফেলেছেন আওয়ামী লীগ আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব শেখ ফজলে নূর তাপস। দু’বার তিনি হামলার শিকার হয়েছেন। পুরানা পল্টনের বাংলার বাণী অফিসে তার ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগেই ওই হামলার পরিকল্পনা করা হয়। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এরপর হাজারীবাগের পার্কের মধ্যে দ্বিতীয় হামলার শিকার হন তিনি। এ বিষয়ে তাপস বলেন, ‘আমি মনে করি প্রতিটি ঘটনাই একই সূত্রে গাথা। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তাদেরই প্রচেষ্টা এটা। তাদের প্রচেষ্টা এখনও আছে, ষড়যন্ত্র এখনও চলছে।’

‘নিজেকে শেখ ফজলুল হক মণির সন্তান হিসেবে গর্ববোধ করি’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এটাই আমার গর্ব এবং জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির বিষয় হলো, আমি শেখ ফজলুল হক মণির সন্তান। তিনি তার সারাটা জীবনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেকে উজ্জীবিত করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন উন্নত জাতি গঠনে। মেধাভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনে। তিনি সব সময় বলতেন, এই জাতিকে সঠিক পথে নিতে হলে জ্ঞাননির্ভর, মেধানির্ভর যুবসমাজ গড়ে তুলতে হবে। নিজেকে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত করেছিলেন, যেটা তার নেশার মতো ছিল। তার জীবনের আরেকটি অঙ্গ ছিল সাংবাদিকতা।’

তাপস বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা তো একটা বিপ্লব ছিল। আমার বাবার একটা লেখা ছিল, বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব হতে পারে। যারা পরাজিত শক্তি তারা বিলীন হয়ে যায়নি। তারা হয়তো নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। পরবর্তীতে সেই সুযোগ তারা নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু এত বড় নেতা ছিলেন যে তারা জানত কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনৈতিক দর্শনকে পরাজিত করা যাবে না। শুধুমাত্র তাকে হত্যা করেই সেটা সম্ভব। সেই পথটাই তারা বেছে নিয়েছিল। হত্যা করেই তার আদর্শ নির্মূল করতে চেয়েছিল।’

তিনি বলেন, বাঙালি জাতির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। বাঙালি জাতি সব সময় প্রগতির পক্ষে ছিল, জাতীয়তাবাদী ছিল। যে কারণেই আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পেরেছে। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পেরেছে। বাঙালি জাতি সমর্থন না দিলে তো বিচার করা সম্ভব হতো না। আমরা চাই প্রগতির এই ধারাবাহিকতা অটুট থাকুক।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে যাক। একটি জাতির সৃষ্টির সুফল পেতে একটু সময় লাগবে’- যোগ করেন শেখ মণির ছোট ছেলে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস।

এইউএ/এমএআর/আরআইপি