অবস্থানের দিক থেকে নওগাঁ সদর, জেলার দক্ষিণ পূর্বাংশে; বগুড়ার শান্তাহার ট্রেন স্টেশন থেকে মাত্র চার মাইল পশ্চিমে। মূলত ছোট যমুনা নদীর তীরে নওগাঁ শহরের অবস্থান।
Advertisement
জেলার মোট জমির ৪৫ ভাগই বরেন্দ্র ভূমি। স্থানীয় বয়স্কদের কাছ থেকে জানা যায়, নওগাঁ শহরের প্রাচীন অধিবাসীরা আজমির শরীফ মতান্তরে বাগদাদ থেকে এসে চারশ বছর পূর্বে বসতি স্থাপন করেন। মুর্শিদাবাদের নবাব তাদের তরফদার উপাধি দেন।
তবে তারও আগে যে এখানে জনপদ ছিল, তার নিদর্শন মিলে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে ও মাটি খননের সময় পাওয়া প্রাচীন মূর্তির মাধ্যমে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রচীন জনপদ হওয়া সত্ত্বেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো প্রশাসনিক কার্যালয় নওগাঁয় দেখা যায় না। এমনকি এখন যে নওগাঁ শহর, ১৮৬২ সালের আগে সেখানে গ্রাম্য বাজারও বসত না।
Advertisement
নওগাঁ গ্রামের পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীর পূর্ব পাশে সুলতানপুর বাজার। চালের ব্যবসা এবং ইংরেজ বণিকদের রেশম কেনাবেচার জন্য বাজারটি বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। বাজারটি ছিল দুবলহাটী এবং নওগাঁর জমিদারের যৌথ মালিকানার।
খাজনা ভাগাভাগির টাকা নিয়ে উভয়ের মধ্যে বিরোধ চরমে উঠলে নওগাঁর জমিদার লাদুরাম সেখান থেকে ফিরে এসে নিজ এলাকায় বাজার বসানোর ঘোষণা দেন। জমিদারের ব্যক্তিগত প্রভাবে নওগাঁ অল্পদিনের মধ্যেই গ্রাম থেকে বাজারে পরিণত হয়।
সেই বাজারে দুবলহাটীর জমিদার ঘনদারানাথ ওরফে হরনাথ নিজেকে জাহিরের জন্য বিরাট দোকান দেন। যেখানে মসলাপাতি, বই-খাতা, কাপড়, এক কথায় মাটির পাতিল ও কলাপাতা বাদে সব পাওয়া যেত। অবশ্য বাজারের এক কোণে কুমারের দোকান ছিল। যেখানে তাদের তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিল পাওয়া যেত।
নওগাঁর জমিদারের বন্ধু তিনকড়ি সাহা, বলাই সাহা, মহেশ সাহা ও মাতম বানিয়া আলাদাভাবে দুবলহাটীর জমিদারের দোকানের চেয়ে সমৃদ্ধ করে ব্যবসায় নামেন। ১৮৬৪ সালে এসে দুবলহাটীর জমিদার একটি মধ্য স্কুল নির্মাণ করে দিলে নওগাঁর জমিদার দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করে দেন। তাদের এই দ্বৈরথ নওগাঁবাসীর শিক্ষা ও চিকিৎসাকে একধাপ এগিয়ে নেয়।
Advertisement
১৮৮২ সালে নওগাঁ মহকুমা হিসেবে যাত্রা করে। তবে আধুনিক যে নওগাঁ শহর, তার শুভ যাত্রা ১৯১৭ সাল থেকে; গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার পর। মূলত গাঁজা উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত সমস্ত কিছু দেখভাল করতো গাঁজা সোসাইটি।
পাশাপাশি সমিতির মাধ্যমে সমাজসেবামূলক বহু কাজও তারা করেন। চার বছর পর পর সমিতির নির্বাচনে ঠিক করা হত গাঁজা সোসাইটির নেতা-নেত্রী। নির্বাচনে জয়ের জন্য অনেকেই নওগাঁর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। সেই মোতাবেক ১৯২১ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে নেতৃত্বে আসা ব্যক্তিদের উদ্যোগে ক্যাসেল পার্ক নির্মাণের মাধ্যমে নওগাঁর সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যায়।
১৯২৩ সালে ছোট যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ হলে বাইরের এলাকার সঙ্গে নওগাঁর যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে। ১৯৩০ সাল নাগাদ ‘গাঁজা কালটিভেটরস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’-এর পক্ষ থেকে মসজিদ, মন্দির, সরাইখানা, ক্লাব, হাসপাতাল, কলেজ, মাদ্রাসা, স্কুল, রাস্তাঘাট ও সাঁকো নির্মাণ করে দেয়া হয়। গাঁজা মহালের টাকায় ১১টি স্কুল, ৬ থেকে ৭টি কলেজ, ১৮টি বিদ্যালয়, ৫টি মাদ্রাসায় সম্পূর্ণ অর্থ সহায়তা দেয়া হত।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলে তাদের নির্মাণ করা করনেশন হল, গাঁজা সোসাইটি দখলে নেয়। আগে যেখানে ব্রিটিশদের শপথবাক্য পাঠ করানো হত; সেই করনেশন হলে নাটক, যাত্রাপালা, বিভিন্ন মেলা, সমাবেশ, ধর্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
নওগাঁ শহরের সংস্কৃতিমনা মানুষদেরও নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল সেখানে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে নাটক কিংবা বিচিত্রা অনুষ্ঠানের ভার অলিখিতভাবেই তাদের ওপর বর্তায়। যারা এদিক থেকে সামনের সারির, টুনু মিয়া তাদেরই একজন।
নাটক করতে করতে ১৯৫১ সালে এসে ঘনিষ্ঠ হন রাজেন্দ্র কুমার গুহ ও মতিলাল বসুর সঙ্গে। তারা দুজনে ঢাকার ‘নিউ পিকচার হাউস’ এর মালিক ছিলেন। ব্যবসার কাজে ঢাকায় গিয়ে আত্মীয়তার সূত্রে মতিলাল বসুর বাড়িতে ওঠেন টুনু মিয়া। পরে ‘নিউ পিকচার হাউস’-এ চলচ্চিত্র দেখার পর ধনাঢ্য টুনু মিয়া সিদ্ধান্ত নেন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের।
নওগাঁয় ফিরে এসে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের জন্য কালক্ষেপণ না করে, ভাড়া নেয়া করনেশন হল ‘কমলা টকিজ’ প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তর করে চলচ্চিত্রের প্রদর্শন শুরু করেন। শুরুর দিকে সেখানে আমদানি করা বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হত।
দর্শক চাহিদা দেখে ভারতের রাজস্থান থেকে আসা বিষম্বর ঠাকুরও সিদ্ধান্ত নেন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের। মদের ব্যবসায়ী বিষম্বর ঠাকুর অবশ্য গাঁজার ব্যবসা, কাপড়ের দোকানসহ শহরের মধ্যেই প্রচুর জমি-জায়গাসহ অঢেল সম্পদের মালিক।
তবে এসবের বাইরেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবসাকে তিনি বেশি লাভজনক বলে মনে করেন। ১৯৫৪ সালে এসে আটশ আসন বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে ‘চিত্রবাণী লিমিটেড’ নামে চলচ্চিত্রের প্রদর্শন শুরু করেন।
নওগাঁয় প্রচুর চালকল থাকায়, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাশাপাশি সেখানকার চালকলের কর্মচারীদের কথা বিবেচনায় রেখে প্রেক্ষাগৃহের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এজন্য নিজের জমি জায়গা শহরের কেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও বিষম্বর ঠাকুর চেয়েছিলেন চালকলের আশেপাশে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করবেন।
শেষ পর্যন্ত পছন্দ মতো জমি না পাওয়ায়, সেরকম স্থানে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তাই বলে শহরের কেন্দ্রে নিজের জায়গায় প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণও করেননি তিনি। এর বদলে নদী পার হয়ে আড়াই বিঘা জমি কিনে তার একাংশে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের কাজ শুরু করেন; উদ্দেশ্য ছিল, নদীর ওপারের লোকজন যেনো সহজেই সেই প্রেক্ষাগৃহে আসতে পারে।
শুরুর দিকে প্রথম শ্রেণি এক টাকা চার আনা, দ্বিতীয় শ্রেণি নয় আনা ও বক্সের টিকিটের মূল্য ছিল আড়াই টাকা। প্রথমদিকে প্রেক্ষাগৃহে বেশিরভাগই চলত ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শন।
তবে রমরমা ব্যবসা হলেও মালিকপক্ষ খুব একটা লাভবান হতে পারেন না। কারণ, চলচ্চিত্রের মুনাফার অধিকাংশই চলে যেত ভারতে। সেইসঙ্গে টিকিটের ওপর অত্যধিক প্রমোদ কর। আগে পূর্ব পাকিস্তানে টিকিটের ওপর প্রমোদ কর ছিল ৭০ থেকে একশ ১০ শতাংশ; ১৯৬২ সালে এসে সেই পরিমাণ আরও পাঁচ শতাংশ বেড়ে যায়।
এ সময় কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিষম্বর ঠাকুর প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রেখেও কোনো সুরাহা পাননি। ১৯৫৮ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ করলে ‘চিত্রবাণী লিমিটেড’-এ চলতে থাকে উর্দু চলচ্চিত্র। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি করে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হলে এখানে একচেটিয়াভাবে উর্দু চলচ্চিত্রের প্রদর্শন হতে থাকে।
বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে দর্শক কম আসলেও উর্দু চলচ্চিত্রের দর্শক হত প্রচুর। প্রেক্ষাগৃহটির ব্যবস্থাপক নারায়ন সাহা বলেন, ‘সেসময় বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া হত উর্দু চলচ্চিত্র থেকে। আর বছর শেষে ‘লস প্রজেক্ট’ হিসেবে কর কম দেয়ার জন্য চালানো হত বাংলা ছবি।’
তবে ‘রূপবান’ নির্মাণের পর পরিস্থিতি একেবারেই বদলে যাওয়ার কথা জানান তিনি। ‘রূপবান’ এর পর দর্শক আস্তে আস্তে দেশি চলচ্চিত্র দেখতেও প্রেক্ষাগৃহে আসতে থাকেন। ‘বেহুলা’ থেকে শুরু করে ‘রাজা সন্ন্যাসী’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘রহিম বাদশা ও রূপবান’, ‘বনবাসে রূপবান’ দেখার জন্য শো শুরুর অনেক আগে থেকেই দর্শকের ভিড় সামলাতে হত প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্ট লোকজনদের।
এজন্য দুজন চৌকিদার সার্বক্ষণিক প্রেক্ষাগৃহেই দায়িত্ব পালন করতেন। দর্শকের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার সুবাদে এই দুজনকে প্রেক্ষাগৃহের মালিকের তরফ থেকে সম্মানিও প্রদান করা হত। নারায়ন সাহার ভাষায়, ‘এই চলচ্চিত্রগুলো দর্শককে বাধ্য করেছিল প্রেক্ষাগৃহে আসতে। তাছাড়া তখনকার অধিকাংশ দর্শকই ছিল মধ্যবিত্ত। চলচ্চিত্র ছিল তাদের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম।
নিম্নবিত্তদের কাছেও সেগুলো গ্রহণ করার মতো ছিল। কারণ তাদের শোনা গল্পের চরিত্রের সঙ্গে চলচ্চিত্রে তারা মিল পেত। আর পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে যেত যে, সিনেমাটা দেখাই লাগবে, না দেখলে চলবে না। ফলে ওই পরিস্থিতিতে মানুষজন তৃপ্তি মেটানোর জন্য সিনেমাহলে ছুটে আসত।’
প্রেক্ষাগৃহের সবে সুদিন ফিরেছে, ঠিক এরকম সময় দেশের পরিস্থিতি বেগতিক আন্দাজ করে বিষম্বর ঠাকুর ভারতে চলে যান। এসময় তার কর্মচারীরা প্রেক্ষাগৃহসহ অন্যান্য সম্পদের দেখভাল করত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিষম্বর ঠাকুরের বাড়িটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে চলে যায়। পরে পাক হানাদার বাহিনীই প্রেক্ষাগৃহ শেল মেরে ভেঙে দেয়। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন বিষম্বর ঠাকুর। কিন্তু তার প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ ভেঙে ফেলা হয়েছে জেনেও, দীর্ঘদিন আর সেই এলাকার আশেপাশেও যাননি তিনি।
কেএ/এলএ