বাংলাদেশ থেকে ইউরোপগামী হাজারো অভিবাসীর কাছে পর্তুগাল অনন্য এক নাম। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনিয়মিত হয়ে পড়া অনেকেই পর্তুগালে পাড়ি জমান ‘রেসিডেন্স পারমিটের’ আশায়। ইউরোপে অভিবাসীদের ‘স্বর্গরাজ্য’ খ্যাত পর্তুগালে তাই দিনকে-দিন বাড়ছে বাংলাদেশিদের সংখ্যা।
Advertisement
মূলত ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশ থেকে হাতে গোণা অভিবাসী আসা শুরু হয় পর্তুগালে। এরপর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে পর্তুগালে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা।
ইউরোপের শেনঝেন অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহজতম অভিবাসন আইন পর্তুগালে। অনেকের কাছে ইউরোপে অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য খ্যাত পর্তুগালকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও বেছে নেন অনেকে।
বর্তমানে পতুর্গালের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি। কিন্তু উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের উন্নত এ দেশে এলেও ভালো নেই অভিবাসী বেশিরভাগ বাংলাদেশি।
Advertisement
জানা গেছে, বিভিন্ন কাজে পর্তুগালে আসা বাংলাদেশিদের অনেকেই এখন নানাভাবে বিরুপ পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন। এরা যতটা না স্থানীয়দের কারণে সমস্যায় ভুগছেন, তার চেয়েও বেশি সমস্যা পোহাচ্ছেন অভিবাসী স্বদেশিদের কারণে।
পতুর্গালে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে সহজে বৈধ অভিবাসন স্বীকৃতি পাওয়ার মতোই সহজেই, কিছু অর্থ থাকলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করা যায়। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মত জটিল না হওয়ায় এখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করা সহজ। এ সুযোগে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা চালু করেছেন অনেক বাংলাদেশি। অধিকাংশই মিনি সুপার মার্কেট। পর্তুগালের প্রায় সব সড়ক, অলি-গলিতে রয়েছে বাংলাদেশিদের মিনি সুপার শপ।
পতুর্গালে বৈধ অভিবাসীর স্বীকৃতি পেতে প্রথমে কোনো কাজের চুক্তিপত্র প্রয়োজন হয়। পর্তুগিজ মালিকরা বাংলাদেশিদের কিছু কিছু কাজ দিলেও সহজে কাজের চুক্তিপত্র দেন না। ফলে অনেক বাংলাদেশি বৈধতা পেতে সমস্যায় পড়েন। এর সমাধান পেতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হন অনেকে।
পতুর্গালে বৈধতা পাবার আশায় স্বদেশিদের কাছে কাজের চুক্তিপত্র পেতে ছুটে গেলেও অনেক বাংলাদেশিই এখন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাছে এখন নগদ অর্থের বিনিময়ে কাজ দেওয়া ও চুক্তিপত্র বিক্রির প্রস্তাব দেন স্থানীয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়েই অর্থের বিনিময়ে (২ থেকে ৪ হাজার ইউরো) কাজ নেন অভিবাসী বাংলাদেশিরা।
Advertisement
মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কাজের চুক্তিপত্র কিনলেও সারাদিন কাজ করার শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকে। ফলে ভুক্তভোগী অভিবাসীদের স্বদেশি ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানেই খুব সকাল থেকে শুরু করে রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।
অনেকটা দাসপ্রথার মতো এ ব্যবস্থাতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের চলতে হয় মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি কাজ করেও বেতন পেতে নানা রকম হয়রানির শিকার হন তারা। তার ওপর পারিশ্রমিক প্রদানে দেশটিতে প্রচলিত ন্যূনতম বেতন কাঠামো অনুসরণ করা হয় না।
আবার নূন্যতম বেতন কাঠামো অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হলেও স্যোস্যাল সিকিউরিটিতে পরিশোধের করার কথা বলে অর্থ কেটে রাখেন মালিকরা। আবার সাপ্তাহিক ছুটি পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয় অভিবাসী কর্মজীবীদের। কিন্তু বৈধ নাগরিকত্ব বা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে অভি্বাসনের সুযোগের আশায় নিজ দেশীদের হাতেই এভাবে দিনের পর দিন মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করে থাকেন তারা।
এদিকে, কাজের নামে মানসিক হয়রানিতে অনেকেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। নিজ দেশীদের নির্দয় আচরণে ভেঙে পড়লেও অভিবাসন প্রক্রিয়া নিয়মিত রাখতে এসব নিয়ে কেউ মুখ খোলেন না।
অন্যদিকে, কাজের চুক্তিপত্র বিক্রির নামে চলে আরেক প্রতারণা। চুক্তিপত্রের কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে ইউরোপের অন্যত্র চলে যাওয়ারও নজির রয়েছে অনেক। অনেক ব্যবসায়ী ঠিক সময়ে স্যোসাল সিকিউরিটি ট্যাক্স পরিশোধ করেন না, এতে বিপাকে পড়েন কর্মচারীরা। তাছাড়া কাজের চুক্তিপত্রের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণার নজিরও রয়েছে অনেক।
তবে স্বদেশি বা যে কারো মাধ্যমে প্রতারিত বা হয়রানির শিকার হলে তার প্রতিকার পাবার সুযোগ রয়েছে পর্তুগালে। কিন্তু বেশিরভাগ অভিবাসী বাংলাদেশিই তা জানেন না। এখানে কর্মরতদের জন্য অনেক সরকারি ও সামাজিক সংগঠন রয়েছে, যারা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অভিযোগ করলে প্রতিকার ও আইনি সহায়তায় পাবার সুযোগ রয়েছে।
পতুর্গালের সচেতন বাংলাদেশিরা জানান, এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। কর্ম চুক্তিপত্রের বাইরে মালিক বাড়তি কাজ করাতে চায় বা ঠিকমতো বেতন পরিশোধ না করেন অথবা মানসিকভাবে নির্যাতন বা জিম্মি করেন; এসবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এজন্য নিজেকেই প্রতিবাদী হতে হবে। অধিকার আদায়ে কথা বলতে হবে। এছাড়া কর্ম চুক্তিপত্রের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন না করতেও সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসআর/পিআর